রক্তাক্ত শ্রীলংকা: কারা নিরাপদ ও শঙ্কামুক্ত?

Published : 6 May 2019, 09:17 AM
Updated : 6 May 2019, 09:17 AM

শ্রীলংকা, দক্ষিণ এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। এর সরকারি নাম গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী শ্রীলংকা। ১৯৭২ সালের আগে উক্ত দ্বীপ সিলন নামেও পরিচিত ছিল। এর প্রশাসনিক রাজধানীর নাম শ্রী জয়াবর্ধেনেপুরা কোট্টে। এর প্রধান শহর কলম্বো। ভারতের দক্ষিণ উপকূল হতে ৩১ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত। প্রায় ২ কোটি জনসংখ্যার বসবাস শ্রীলংকায়। সিংহলি সম্প্রদায় এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। উত্তর-পূর্ব দিকের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে তামিল সম্প্রদায় দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে মূর, বার্ঘের, কাফির, মালয় ঊল্লেখযোগ্য। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংবলিত সমুদ্রসৈকত, ভূদৃশ্য এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শ্রীলঙ্কাকে সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এখন তো শ্রীলংকার মোট জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ পর্যটন খাত থেকেই আসে। তবে রক্তাক্ত বোমা হামলার ঘটনায় পর্যটন খাতে বড় ধরণের ধাক্কা খেলো শ্রীলংকা। এই ঘটনা শ্রীলংকার অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলংকা অনেক নামে পরিচিত হয়ে আসছে। প্রাচীন গ্রীক ভূগোলবিদগণ একে তপ্রোবান এবং আরবরা সেরেনদীব নামে ডাকত। ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজরা এই দ্বীপে পৌঁছে এর নাম দেয় শেইলাও যার ইংরেজি শব্দ হল Ceylon. ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের অধীনে থাকা অবস্থায় তারা এই নামেই পরিচিত ছিল। ১৯৪৮ সালে এই নামেই স্বাধীনতা পায় এবং পরে ১৯৭২ সালে দাপ্তরিক নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়- মুক্ত, সার্বভৌম ও স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী শ্রীলংকা। শ্রীলংকা নামটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ "শ্রী" ও "লংকা" থেকে। শ্রী শব্দের অর্থ পবিত্র এবং লংকা অর্থ দ্বীপ। অর্থ্যাৎ শ্রীলংকাকে পবিত্র দ্বীপ হিসেবে মানত তারা।

সম্রাট অশোক ও শ্রীলংকায় বৌদ্ধধর্ম প্রচার

মৌর্যবংশীয় সম্রাট অশোকের জন্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে। তিনি ছিলেন অমিত্রাঘাত বিন্দুসারের পুত্র। মায়ের নাম ছিল বিদিশা। কনিষ্ঠ ভাইয়ের নাম ছিল বীতশোক। সম্রাট অশোকের এক পুত্র এবং এক কন্যা সন্তান ছিল। পুত্রের নাম মহেন্দ্র এবং কন্যা সংঘমিত্রা। সম্রাট অশোকের রাজ্য ছিল সুবিশাল। পূর্বে বঙ্গদেশ ও কামরূপ রাজ্য, দক্ষিণে কলিঙ্গ (উড়িষ্যা), বিন্দাচল ও মহিষমন্ডল (মহীশূর) রাজ্য, পশ্চিমে মহারাষ্ট্র, সুরাট, গুজরাট, বিরাট, সমগ্র, সিন্ধুতট ও তক্ষশিলা, রাজ্য, এবং উত্তরে কাশ্মীর, ও হিমাচল, অঞ্চল। রাজধানী পাটলিপুত্র। তখন এদেশটি জম্বুদ্বীপ নামে খ্যাত ছিল। এই বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন সম্রাট অশোক।

তিনি প্রথম জীবনে চন্ডাশোক নামে পরিচিত ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩ অব্দে পিতার মৃত্যুর পর সম্রাট অশোক সিংহাসনে আরোহন করেন। সিংহাসনে আরোহনের তেরো বর্ষে খ্রিস্টপূর্ব ২৬০ অব্দে তিনি কলিঙ্গ রাজ্য আক্রমণ করেন। সে ভয়ংকর যুদ্ধে অগণিত সৈন্য হতাহত হয়। যদ্ধের এই বীভৎসতার অমানবিক দৃশ্য দেখে তাঁর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। এই যুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তিনি সেদিনই রাজ্য জয়ের লিপ্সা পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং বুদ্ধের অহিংস-মৈত্রীর পথ অনুসরণ করার সংকল্পবদ্ধ হন। কলিঙ্গ যুদ্ধ ছিল তাঁর জীবনের শেষ যুদ্ধ। পরে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে সারাবিশ্বে বৌদ্ধধর্ম ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষে মগধ থেকে পৃথিবীর দেশে দেশে ধর্মদূত প্রেরণ করেছিলেন। মূলত, ধর্ম প্রচারের জন্যই তাঁদেরকে প্রেরণ করা হত। তিনি নিজের একমাত্র পুত্র এবং কন্যা ভিক্ষু-ভিক্ষুণীধর্ম গ্রহণ করার পর তাদেরকে শ্রীলংকায় (তাম্রপন্নি) প্রেরণ করেছিলেন। শ্রীলংকায় সম্রাট অশোক পুত্র থের মহেন্দ্র (মহিদ) এবং কন্যা থেরী সংঘমিত্রা (সংঘমিত্তা) সর্বপ্রথম বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। তাঁদের হাত ধরেই মূলত শ্রীলংকায় বৌদ্ধধর্ম প্রবেশ করে।

সুদীর্ঘকাল ধরে বৈশ্বিক বাণিজ্যপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হওয়ার কারণে শ্রীলংকায় কয়েক শতাব্দী ধরে নানা ধর্মের লোকের আগমন ঘটেছে। এ কারণে এখানে ধর্মীয় বৈচিত্র বহু আগে থেকেই ছিল। খ্রিষ্টের জন্মের অন্তত কয়েক শত বছর আগে থেকেই এখানকার জনপদের সঙ্গে বৌদ্ধ দর্শনের যোগ ছিল। এর কয়েক শতক পর এখানে হিন্দুধর্মের আগমন ঘটে। মধ্য যুগে আরব দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য প্রসারের হাত ধরে এখানে মুসলমানরা আসেন। অন্যদিকে ষোড়শ শতকের দিকে ইউরোপীয় উপনিবেশের পর এখানে খ্রিষ্টানদের বসবাস শুরু হয়। এভাবে শ্রীলংকার ধর্মীয় বৈচিত্রতা যুগে যুগে সমৃদ্ধ হতে থাকে।

দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আসা শ্রীলংকা

শ্রীলংকার আছে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের এক বিভীষিকাময় ইতিহাস। এটি ছিল পুরো শ্রীলংকা দ্বীপ জুড়ে সংঘটিত হওয়া একটি সশস্ত্র সংঘাত। ১৯৮৩ সালের ২৩ জুলাই তারিখ থেকে শুরু হওয়া সরকারের বিরুদ্ধে বিরতিহীন এই বিদ্রোহটি ছিল লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম (এলটিটিই; যারা তামিল টাইগার নামেও পরিচিত) কর্তৃক দ্বীপের উত্তর ও পূর্ব অংশ নিয়ে তামিল ইলম নামে তামিল জাতিগোষ্ঠীর জন্য একটি স্বাধীন তামিল রাষ্ট্র গঠনের লড়াই। টানা ২৬ বছর ধরে সামরিক অভিযান পরিচালনার পর শ্রীলংকার সামরিক বাহিনী গত ২০০৯ সালের মে মাসে তামিল টাইগারদেরকে পরাজিত করার মাধ্যমে এই রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হয়।

ইতিহাস মতে, শ্রীলংকার তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দেশটির উত্তরাঞ্চলে সামরিক বাহিনীর ১৩ জন সৈন্যকে হত্যার মাধ্যমে তাদের সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেছিল অন্তত ত্রিশ বছর আগে। এই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি সম্প্রদায়ের উত্তেজিত জনতা পাল্টা হামলা চালায়। প্রতিহিংসার এই হামলায় তামিল সম্প্রদায়ের প্রায় তিন হাজার মানুষ নিহত হন। এর পর টানা ২৬ বছর ধরে চলে এই গৃহযুদ্ধ। নিহত হয়েছেন আশি হাজারেরও বেশি মানুষ। দেশ ছাড়া হন হাজার হাজার সাধারণ তামিল জনগোষ্ঠী। ১৯৮৩ সালের ২৩ শে জুলাইয়ের ঐ ঘটনাকে দেশটির ইতিহাসে 'ব্ল্যাক জুলাই' বা কালো জুলাই নামে বর্ণনা করা হয়।

২৫ বছরেরও অধিক সময় ধরে চলা এই যুদ্ধে দেশের জনসংখ্যা, পরিবেশ ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণের ক্ষতির সৃষ্টি হয়, যা প্রাথমিক হিসাব অনুসারে ৮০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ মানুষের জীবনহানির কারণ হয়েছে। ২০১৩ সালে জাতিসংঘের প্রেরিত দল যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে অতিরিক্ত মৃত্যুর ঘটনা ঘটার বিষয়টি উল্লেখ করেছিল: "প্রায় ৪০,০০০-এরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, যদিও অন্যান্য স্বাধীন প্রতিবেদনগুলি আনুমানিক মৃত্যুর সংখ্যা ১,০০,০০০ অতিক্রম করার কথা দাবী করছে।" সংঘর্ষের প্রাথমিক পর্যায়ে শ্রীলংকার সেনাবাহিনী এলটিটিই কর্তৃক দখলকৃত এলাকা পুনর্দখল করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়। সরকারি বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে নেয়া লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলমের কর্মপন্থার কারণে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলিসহ ৩২টি দেশে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভূক্ত গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। শ্রীলংকার সরকারি বাহিনীকেও মানবাধিকারের অপব্যবহার, নিয়মিত শাস্তি প্রদানের দ্বারা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, আটকদের প্রতি মানবিক সম্মান প্রদর্শনের অভাব এবং জোরপূর্বক অন্তর্ধান সম্পর্কিত অভিযোগসমূহের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর অসফল চেষ্টার অংশ হিসেবে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনীর উপস্থিতিসহ দুই দশকের যুদ্ধ এবং শান্তি আলোচনার চারটি প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে, এই সংঘর্ষের একটি স্থায়ী সফল নিষ্পত্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল যখন ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয় এবং ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের সহায়তায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তীতে, ২০০৫ সালের শেষের দিকে সীমিত শান্তির অবসান ঘটিয়ে যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং জুলাই ২০০৬ সালে সরকার পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে এলটিটিই'র বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি প্রধান সামরিক অভিযান শুরুর দ্বারা সমগ্র পূর্বাঞ্চল থেকে এলটিটিইকে সরিয়ে দেয়ার জন্য অভিযান চালানো শুরু না-করা পর্যন্ত তা বজায় থাকে। এলটিটিই তখন ঘোষণা করে যে তারা "নিজেদের জন্য একটি পৃথক রাজ্য অর্জনের জন্য তাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম পুনরায় শুরু করবে"। পরবর্তীতে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ২০০৯ সালের মে মাসে। তবে উত্তরের তামিলরা ১৮ মে দিনটিকে নীরব গুমট আবহাওয়ায় মৃত্যু দিবস হিসেবেই পালন করে। আর কলম্বোতে দিনটিকে বিবেচনা করা হয় বিজয় দিবস হিসেবে।

আবার রক্তের হোলিখেলা শুরু

২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মাঝখানে এক দশক সময়ের ব্যবধানে শ্রীলংকায় পুণরায় শান্তি ফিরে আসতে শুরু করেছিল। তবে এই এক দশক সময়ের মধ্যে শ্রীলংকায় উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে শুরু করে। কখনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আবার কখনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মত ঘটনা ঘটে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলমানদের অনেক বাড়িঘর, দোকানপাট এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও হামলার ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন অজুহাত এবং গুজব রটিয়ে এসব হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরোয়। সময়ের ব্যবধানে এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনা বেড়েই চলেছে। কারণ নাগরিকদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ থাকা ভাল কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ কখনো ভাল ফল বয়ে আনে না। এটা পৃথিবীর দেশে দেশে প্রমাণিত। বিশ্ব আজ উগ্র জাতীয়তাবাদে ভুগছে। শ্রীলংকায় বা যেকোনো দেশে এই উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সংখ্যা হয়তো সাধারণ জনগণের চেয়ে খুব বেশি নয়। কিন্তু এই বিষয়ে সাধারণ জনগণের নীরবতা, সহযোগিতার ঘাটতি, রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা কিংবা উদাসীনতার কারণে এরা দাপিয়ে বেড়ায়। এরা দিনের পর দিন সংখ্যা, কৌশল, শক্তি এবং সামর্থ্যের দিক দিয়ে বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে হাতেগোনা কিছু মানুষ সমগ্র জনগোষ্ঠীকে আতংকিত কিংবা জিম্মি করে রাখার মত দৃষ্টতা দেখানোর সুযোগ পেয়ে বসে। এদিকে নিরাপদ জীবনযাপন করার মত সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও তাদের হাতে মরতে হয় রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণকে। সেই নির্দয় মৃত্যুর তালিকায় কোলের শিশু, নারী, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে জাতিধর্ম নির্বিশেষে কেউ বাদ যায় না। মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, বিহার কিছুই অক্ষত থাকে না। যে ধর্মের ঘরে মানুষ শান্তি আর পবিত্রতার খোঁজে আসে সেখানেই আজ তার জীবন অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। গত ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে আল নূর মসজিদে এক বন্দুকধারী সন্ত্রাসী হামলা করে অর্ধ শতাধিক মানুষ হত্যা করে। পুরো বিশ্বকে হতবাক করে দেওয়া এই নৃশংস ঘটনার মাত্র পয়ত্রিশ দিনের ব্যবধানে সন্ত্রাসী সিরিজ বোমা হামলায় শ্রীলংকা রক্তাক্ত হল। এখানেও মোট নিহতদের বেশির ভাগ প্রাণ হারাল ধর্মের ঘরেই, বাকীরা হোটেলে।

রক্তাক্ত হয় যেভাবে

গত ২১ এপ্রিল রোববার সকালে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ইস্টার সানডের দিনে শ্রীলংকার কলম্বোর তিনটি গির্জা, তিনটি বিলাসবহুল হোটেল এবং আরও দুই স্থানে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় প্রথম দিকে নিহতদের সংখ্যা ৩৫৯ জন বলা হলেও গত ২৫ এপ্রিল শ্রীলংকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, একই মরদেহ একাধিকবার গণনা করায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। ময়নাতদন্ত শেষে দেখা যায় নিহতের সংখ্যা ৩৫৯ নয়, ২৫৩ জন। শ্রীলঙ্কার উপপ্রতিরক্ষা মন্ত্রী রুয়ান বিজেবর্ধনের বরাত দিয়ে বিবিসির এক খবরে বলা হয়, মর্গ থেকে নিহতের ভুল সংখ্যা জানানো হয়েছিল। রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়, হামলার পর এত বেশি বিচ্ছিন্ন শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এসেছিল যে, সেই সময় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। লাশের ময়নাতদন্তের পর জানা গেল লাশের সংখ্যা আরো একশ কম। এই নৃশংস ঘটনায় আরো কমপক্ষে ৫০০ জন আহত হন। শিশু, নারীসহ দেশি-বিদেশি নাগরিকের অসংখ্য লাশের এই তালিকায় আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ সেলিমের নাতি জায়ানও রয়েছে। একই ঘটনায় জায়ানের বাবাও এখন প্রাণসংকটে রয়েছেন।

ঘটনা ঘটানোর দুই দিন পর ২৩ এপ্রিল মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) হামলার দায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে এবং তারা এই ভয়ংকর সিরিজ বোমা হামলায় সফল হওয়ায় রীতিমত দিনটি উদযাপনও করে। ঘটনার পর পর শ্রীলংকা সরকার দেশের অভ্যন্তরে গড়ে উঠা 'ন্যাশনাল তাওহীদ জামাত' (এনটিজে) এবং 'জামিয়াতুল মিল্লাতু ইব্রাহিম' এই দুইটি সংগঠনকে ঘটনার জন্য দায়ী করে। তবে এটাও বলে যে, আন্তর্জাতিকভাবে সহযোগিতা ছাড়া তাদের পক্ষে এতবড় হামলা চালানো সম্ভব নয়। তখন আইএস সম্পৃক্ততার বিষয়টি সামনে চলে আসে। ঘটনার দুই দিনের ব্যবধানে আইএস ঠিকই এই ঘটনার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয় এবং বুনো উল্লাস প্রকাশ করে। এরপর থেকে নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে রক্তাক্ত শ্রীলংকা।

কেন এই হামলা?

ঘটনার পর থেকে বিশ্বজুড়ে চলছে নানা তর্কবিতর্ক এবং আলোচনা-সমালোচনা। শ্রীলংকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রুয়ান উইজেওয়ারদানা গত ২৩ এপ্রিল মঙ্গলবার দাবি করেন, গত ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে হামলার প্রতিশোধ নিতেই ইসলামি চরমপন্থীরা শ্রীলঙ্কায় সমন্বিত এই হামলা চালিয়েছে। তবে এই দাবীকে অস্বীকার করেছে নিউজিল্যান্ড। শ্রীলংকার পক্ষ থেকে এমন দাবী উঠার পরপর নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, এমন কোনো তথ্য তার সরকারের কাছে নেই যে, ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার পাল্টা জবাবে শ্রীলংকার এই ঘটনা ঘটেছে। তাহলে কেন এই হামলা করা হল?

লেখকের বিশ্লেষণ

শ্রীলংকায় দীর্ঘদিন ধরে শত্রুতা, বিরোধ, রক্তারক্তির ঘটনা ঘটেছে তামিলদের সাথে। মুসলমানদের সাথে তামিলদের কোনো শত্রুতা নেই । শ্রীলংকায় তামিল সম্প্রদায় যেমন ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তেমনি মুসলমান সম্প্রদায়ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু। ব্যবধান হল, তামিল সম্প্রদায় শ্রীলংকার সবথেকে বড় ধর্মীয় সংখ্যালঘু। শ্রীলংকার খ্রিস্টানদের সাথেও মুসলমানদের কোনো অপ্রীতিকর কিংবা সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়নি। বরং কিছু সাম্প্রদায়িক ঘটনা কিংবা সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে কেবল সিংহলী বৌদ্ধদের সাথে। স্থানীয় সিংহলী বৌদ্ধদের কিছু উগ্র এবং সাম্প্রদায়িক লোকজন বিভিন্ন সময় মুসলমানদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট এবং ধর্মীয় স্থাপনায় হামলা করেছেন। রাগ, ক্ষোভ, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ স্পৃহা থাকলে সিংহলী বৌদ্ধদের উপর থাকার কথা। কিন্তু হামলা হল খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষের উপর। যদিও সকল সম্প্রদায়ের লোকজন ওই নিহতদের তালিকায় আছেন কিন্তু হামলার মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল খ্রিস্টান সম্প্রদায়। তাই হামলার স্থান এবং দিনক্ষণ সেভাবে বেছে নেওয়া হয়েছে। যেভাবে গত ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডে বেছে নেওয়া হয়েছিল মসজিদ। কারণ ওই সন্ত্রাসী হামলার লক্ষ্যবস্ত ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ হত্যা করা। আমি মনে করি, নিউজিল্যান্ডের ওই নৃশংস ঘটনার সহিংস প্রতিক্রিয়া জানাতে শ্রীলংকায় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উপর এই আঘাত হানা হয়েছে। যেহেতু নিউজিল্যান্ডের ওই বর্বর ঘটনাটি যে শেতাঙ্গ বন্দুকধারী ব্যক্তি ঘটিয়েছিলেন তিনি ধর্মীয় পরিচয়ে খ্রিস্টান ছিলেন। অবশ্য আইএস এর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও সে কথা সরাসরি বলা হয়নি। হয়তো বা পরবর্তীতে কিছু সময় পর এটা আরো খোলাসা হয়ে যাবে। কিন্তু এবার শ্রীলংকায় বৌদ্ধ বিহার, স্থাপনা কিংবা বৌদ্ধদের উপর হামলা হবে না, এটা দায় নিয়ে বলার কোনো সুযোগ নেই।

একইসাথে এটাও বলা দরকার যে, সর্বশেষ ২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর সেদেশের উগ্র জাতীয়তাবাদী সামরিক বাহিনী যে বর্বর অভিযান চালিয়েছে এবং তাদেরকে নিপীড়ন-নির্যাতন করেছে তার প্রভাব যে বৌদ্ধদের উপর পড়বে না একথা আপাতত আমি বিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু আমরা জানি না যে, ঠিক কোথায়, কখন, কোন দিন, কোন স্থানের বৌদ্ধদের উপর আঘাত হানা হবে। কিন্তু আঘাত আসবেই। কেবল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। সঙ্গতকারণে বাংলাদেশী বৌদ্ধ এবং তাদের ধর্মীয় স্থাপনাগুলো সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। কারণ উগ্রপন্থী এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নকে দেখে কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে। তাদের মতে, এটা পুরোপুরি মুসলমান বনাম বৌদ্ধ সমস্যা। মিয়ানমারে বৌদ্ধরা মুসলমানদের নির্যাতন-নিপীড়ন করেছে এটাই তাদের মনোভাব, প্রচারণা এবং যুক্তি। যেহেতু সেদেশের অধিকাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং নিপীড়নকারী সামরিক বাহিনীও একই ধর্মে বিশ্বাসী লোক। সেই বিচারে বৌদ্ধ মাত্রেই আঘাত হানার যোগ্য।

আবার একই মানুষগুলো কিংবা একই প্রকৃতির মানুষগুলো শ্রীলংকার বোমা হামলার ঘটনার মত কোন সাম্প্রদায়িক কিংবা সহিংসতার ঘটনা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী (ভুল ধারণা প্রসূত ধর্মান্ধ) কিছু উগ্র, বিপথগামী এবং সাম্প্রদায়িক লোক ঘটালে তখন তারা এটা মানেন যে, এসকল উগ্রবাদী এবং জঙ্গীরা পবিত্র ইসলাম কিংবা বিশ্ব ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা কেবল দুর্বৃত্তের দল। অথচ মিয়ানমার একমাত্র দেশ এবং জাতি নয় যে, যারা বিশ্ববৌদ্ধদের প্রতিনিধিত্ব করে। একইভাবে নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলাকারী এবং নৃশংস কায়দায় মুসলমান হত্যাকারী ওই শেতাঙ্গ সন্ত্রাসী এবং খুনীও একমাত্র ব্যক্তি নয়, যে কি না খ্রিস্টান কিংবা বিশ্বখ্রিস্টানদের প্রতিনিধিত্ব করে। ওইসব বিপদগামী এবং উগ্রবাদীদের বিচরণ এবং অস্থিস্ত পৃথিবীর দেশে দেশে। তাদের কোন নির্দিষ্ট ধর্ম, জাতি, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা স্থান নেই। তারা এখন পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের হাতে কেউ নিরাপদ নয়। তাদের মত বিপদগামীদের ধর্মের মাপকাঠিতে পরিমাপ করতে গিয়েই আজ বিশ্বময় সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রতা, ধর্মীয় মৌলবাদ, প্রতিহিংসা এবং অসহিষ্ণুতা বেড়েই চলেছে। তারা ঘটনা ঘটায় আর আমরা নেমে পড়ি তাদের করা অপকর্মকে কেন্দ্র করে পরস্পরের সাথে ধর্ম আর জাতের বিচারের লড়াইয়ে। তারা আমাদের এই দুরাবস্থা দেখে আরো অনুপ্রাণিত হয় এবং নতুন কোন ঘটনা ঘটানোর জন্য এগোয়।

সরকারেরও দায় আছে

শ্রীলংকায় এমন একটা সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটতে পারে বলে সরকারের কাছে আগাম গোয়েন্দা তথ্য ছিল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, প্রথম আত্মঘাতী হামলার দুই ঘণ্টা আগেও শ্রীলংকাকে সতর্ক করে দিয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী। আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হল, গত ৪ এবং ২০ এপ্রিল দুই দফায় একই ধরনের বার্তা শ্রীলংকা সরকারকে দিয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী। কিন্তু তাতে তারা সাড়া প্রদান করেনি। অবশেষে তথ্য অনুযায়ী ঘটনা ঠিকই ঘটে গেল। কোথায়, কাদের উপর এবং কারা এই হামলা করতে পারে এমন গোয়েন্দা তথ্য থাকার পরও শ্রীলংকা সরকার এই নৃশংসতা ঠেকাতে আগাম কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করল না। অথচ কোনো রাষ্ট্রে এমন ঘটনা কেবল সরকার কিংবা আইন-শৃংখলা বাহিনীর কাছে বিন্দুবিসর্গ আগাম তথ্য না থাকার কারণে ঘটার কথা। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা এবং ব্যর্থতার কারণে এতগুলো প্রাণ ঝরে গেল। এই ঘটনায় শ্রীলংকা সরকার কেবল দুঃখ প্রকাশ করেই খালাস! বড়জোর প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পুলিশ প্রধানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েই নৈতিক দায়িত্ব শেষ করল শ্রীলংকা সরকার! যাদের উপর রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের সম্পদ, জনগণ সবকিছুর সুরক্ষা ভার ন্যস্ত ছিল তাদের চরম গাফেলতিতে এতবড় একটা বর্বর ঘটনা ঘটে গেল। বিশ্বসম্প্রদায় কিন্ত স্পষ্টত এই প্রশ্নটা এখনও তোলেনি। শ্রীলংকার বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করায়নি, অথচ প্রয়োজন ছিল। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট বনাম প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উত্তেজনা শ্রীলংকার অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক পরিবেশকে এতটাই কলুষিত করেছিল যে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানের দায়বোধও তারা বেমালুম ভুলে গেলেন কিংবা গুরুত্বই দিলেন না। প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে বলেছিলেন, 'শ্রীলঙ্কান গোয়েন্দা সংস্থা সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে অবহিত ছিল ১০ দিন আগে থেকেই কিন্তু সেই তথ্য তারা কোনো মন্ত্রীকে জানাননি'। শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে। শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার মুখপাত্র রজিথা সেনারত্ন বলেছেন, এটা দুনিয়ার একমাত্র দেশ যেখানে নিরাপত্তা বাহিনী প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দেয় না। অভিযোগটা অনেকটা এরকম যে, রাষ্ট্রপতিপক্ষ প্রধানমন্ত্রীপক্ষকে গোয়েন্দা তথ্যটা জানাননি। তারা তা জেনেবুঝে গোপন করেছেন। কোন কারণে, কোন স্বার্থে এরকম একটা জীবন-মরণ প্রশ্নের তথ্য তারা গোপন করলেন? তাদের স্বার্থটা কোথায়? এটা খতিয়ে দেখা হবে না কেন? আরেকটা বিষয় হল, একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের বিশেষ একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান গোটা দেশব্যাপী পালিত হচ্ছে কিন্তু কোথাও কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হল না। শ্রীলংকা কি এতটাই ঝুঁকিমুক্ত রাষ্ট্র?

যারা এই আত্মঘাতী হামলা চালালো তারা সবাই শ্রীলংকার নাগরিক। ঘটনা পরবর্তী ঘটনার দায়ে কিংবা জড়িত থাকার সন্দেহে যাদের আটক করা হচ্ছে তারাও সবাই শ্রীলংকার নাগরিক। যারা বিভিন্ন সময় তাদের উত্থান কিংবা উপস্থিতিরও জানান দিয়েছিল; তারা এতটা বেড়ে যাওয়ার সুযোগ পেল কি করে? তারা তো রাতারাতি এতটা বেড়ে যায়নি! সেদেশের সাধারণ মুসলমান সমাজও তাদের বিরুদ্ধে সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক করেছিলেন। কোনো কিছুই আমলে নিলেন না। জাতিসংঘ হামলার ঘটনায় ক্ষোভ এবং নিন্দা প্রকাশ করেছে এটা ঠিক আছে কিন্তু শ্রীলংকার সরকারের কাছে কোনো বার্তা পাঠাল না। আমরা মনে করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত ছিল শ্রীলংকা সরকার ব্যর্থতার
আনুষ্ঠানিক দায় স্বীকার করার পর তাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া। নতুবা কোনো রাষ্ট্রের চরম গাফেলতির কারণে এত সংখ্যক সাধারণ মানুষ বলি হওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক করার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যকোন প্রান্তে কর্তব্য এবং দায়বোধ প্রশ্নে নতুন কোনো খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। যেমনি থেকে গেল মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিপীড়নের ক্ষেত্রে।

এখন শ্রীলংকার নৈতিক দায়িত্ব হল গোটা কয়েক বিপদগামীদের অপরাধের কারণে দেশের দশ শতাংশ মুসলমান সম্প্রদায়কে ঢালাওভাবে সন্দেহের চোখে না দেখে তাদেরকে অভয় দেওয়া এবং তাদের মনে সাহস যোগানো। বৃহত্তর সাধারণ মুসলমান সমাজকে সাথে নিয়ে সমস্ত জঙ্গীপনাকে মোকাবেলা করা। জঙ্গীবাদে কিংবা রাষ্ট্র, সমাজ এবং পরিবার বিরোধী কর্মকাণ্ডে যাতে জড়িয়ে না পড়ে এই বিষয়ে তরুণ সম্প্রদায়কে সচেতন করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা। কারণ এটা এক ধরণের সামাজিক ব্যাধি। তাই এই ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে হলে স্থায়ী প্রতিষেধক হিসেবে দরকার সামাজিক সচেতনতা এবং আন্দোলন। ঘটনার পরপর মসজিদ এবং মুসলমানদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের সংবাদ যেমন সুখকর, তেমনি এই ঘটনার বদৌলতে আতংকিত মুসলমানরা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র পালাচ্ছেন কিংবা কোন কোন স্থানে তাদের উপর হামলার ঘটনার সংবাদ খুবই দুঃখজনক। সরকারকে এসব সাম্প্রদায়িক ঘটনাকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। দেশের সব নাগরিকদের মধ্যে ঘৃণা, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা কিংবা সন্দেহ বিস্তারের পরিবর্তে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহিষ্ণুতা, আস্থা এবং বিশ্বাসের পরিবেশ সৃষ্টি করার জোর চেষ্টা চালাতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার এবং আইন-শৃংখলা বাহিনীর পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ট সিংহলী বৌদ্ধদের দায়দায়িত্ব এবং নৈতিক কর্তব্য কোন অংশে কম নয়।

শ্রীলংকা রাজনৈতিক এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পড়ে জাতীয় ঐক্যহীন হয়ে পড়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। এই দুরাবস্থা অচিরেই কাটিয়ে উঠতে না পারলে ভবিষ্যতে আরো বড় ধরণের মাশুল দিতে হতে পারে। একইসাথে শ্রীলংকার এই ঘটনা বিশ্ববাসীকে এই বার্তা দিয়ে গেল যে, জঙ্গীবাদ এখন কোনো নির্দিষ্ট দেশের একক সমস্যা নয়; এটা এখন বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তাই পুরো বিশ্ববাসী আজ এই ঝুঁকির অধীনে চলে গেছে। কোনো রাষ্ট্র, কোনো জাতিই আজ এই ঝুঁকির বাইরে নেই। বিশ্ববাসীকে এই সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গীপনার বিরুদ্ধে শান্তি, সাম্য এবং সহাবস্থানের স্বার্থে এক হয়ে লড়তে হবে। শান্তি আর মানবতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া বিশ্ব সন্ত্রাস এবং জঙ্গীবাদীরা আজ এক হতে পেরেছে; বিশ্বের সকল শান্তিকামী মানুষ এবং রাষ্ট্রকেও বিশ্বশান্তির স্বার্থে, মানবতার স্বার্থে পারতেই হবে। জাতি,ধর্ম, বর্ণের দোহাই দিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে চলমান এই নৈরাজ্য এবং অনাচারকে ঝেটিয়ে বিদায় করার সময় এসেছে।