তামাক নিয়ন্ত্রণের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ চাই

ইকবাল মাসুদ
Published : 5 May 2019, 01:22 PM
Updated : 5 May 2019, 01:22 PM

তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে দেশে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়। এজন্য বিশ্বব্যাপী তামাক নিয়ন্ত্রণে সোচ্চার হয়েছে জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। আর তামাক নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণয়ন করেছে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)। বাংলাদেশ এফসিটিসি প্রণয়নে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছে ও প্রথম স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছে। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয় এবং ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করে আরও যুগোপযোগী করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধিমালা পাস করা হয়েছে। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অগ্রগতি নিরূপণে প্রণীত সরকারের এসডিজি পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন ফ্রেমওয়ার্কে তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বছরভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আরো পরিস্কারভাবে বললে এসডিজি'র স্বাস্থ্য সংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রা তিন এর অংশ হিসেবে এফসিটিসিকে বাংলাদেশ সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তামাক নিয়ন্ত্রণকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

এখন আমরা যদি দেখি তামাক ব্যবহার জনিত সমস্য আমাদের কতটকুু বা এর ক্ষতির পরিমান কি তাহলে দেখব Global Adult Tobacco Survey ২০১৭ হিসাব মতে বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৫.৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক (১৫ বছর এবং তদূর্ধ্ব) মানুষ তামাক সেবন করেন। নারীদের মধ্যে এই হার ২৫.২ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ। দেশে ধোঁয়াবিহীন তামাক বা গুল, জর্দা, সাদাপাতা ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে নারী ২৪.৮% এবং পুরুষ ১৬.২% যা মোটের হিসেবে ২০.৬ শতাংশ এবং ধূমপায়ী ১৮ শতাংশ এর মধ্যে পুরুষ ৩৬.২%, নারী ০.৮%। এ পরিসংখ্যান মতে বিশ্বের তামাক ব্যবহারকারী দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখনো অন্যতম। তামাকের ব্যবহার ও অন্যান্য কারণে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের প্রকোপও দিন দিন বেড়ে চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে হৃদরোগে কারণে মৃত্যুর ৩০ শতাংশের, ক্যান্সারে মৃত্যুর ৩৮ শতাংশের, ফুসফুসে যক্ষার কারণে মৃত্যুর ৩৫ শতাংশের এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে মৃত্যুর ২০ শতাংশের জন্য ধূমপান দায়ী।

তবে কিছুটা হলেও আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে গ্যাটস এর গবেষণায় দেখা গেছে ২০০৯ এর তুলনায় ২০১৭ সালে সার্বিকভাবে তামাকের ব্যবহার ১৮.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে নারীদের মধ্যে হ্রাস পেয়েছে মাত্র ১২.২ শতাংশ, যার চিত্র খুবই হতাশাজনক। এসময়ে পুরুষদের মধ্যে তামাকের ব্যবহার কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ। ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য ব্যবহার পুরুষদের মধ্যে ২০০৯ এর তুলনায় ২০১৭ সালে প্রায় ৩৯ শতাংশ হ্রাস পেলেও নারীদের মধ্যে হ্রাস পেয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ। গ্যাটসের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, বিগত আট বছরে তামাকের ব্যবহার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হ্রাস পায়নি।

অন্যক্ষেত্রে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে চিকিৎসা ব্যায় বহুগুণে বেড়ে গেছে যা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিশাল বোঝা। এছাড়া সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবেও দেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন (আইএইচএমই) ২০১৩ গবেষণা অনুসারে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ অকালমৃত্যু বরণ করে। তামাকখাত থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পায় তামাক ব্যবহারের কারণে অসুস্থ রোগীর চিকিৎসায় সরকারকে স্বাস্থ্যখাতে তার দ্বিগুণ ব্যয় করতে হয়। এভাবে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশ। তামাকজনিত ক্ষয়ক্ষতি হিসেব করে দেখা গেছে, প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৩ শতাংশ নষ্ট হচ্ছে তামাকের কারণে।

তামাকজনিত ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর হার কমানোর জন্য যে সমন্বিত কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে কি না তা পর্যালোচনা করা জরুরী। এক্ষেত্রে আমরা সাধারণভাবে যা দেখি তাহলো যথাযথভাবে আইন বাস্তবায়নে ব্যর্থতা, ও বর্তমান আইনের কিছু দুর্বলতা, তামাক কোম্পনির বেপরোয়া মনোভাব, তামাকপণ্যের সহজলভ্যতা, নারী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কর্মকৌশল না থাকা এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ জাতীয় নীতি প্রণয়ন না করা ইত্যাদি বিষয়গুলো তামাকের কার্যকর নিয়ন্ত্রণকে ব্যহত করেছে। এছাড়া আমরা তামাক নিয়ন্ত্রণ বলতে অনেক সময় তামাকজাত সকল পণ্যকে না বুঝে শুধু ধূমপানকে বুঝি। অনেক সময় অন্যান্য তামাকপণ্য যেমন গুল, জর্দা, সাদাপাতা ইত্যাদিকে আমলে নেই না। এর ফলে সামগ্রীক তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে পড়ে ও প্রত্যাশিত ফলাফল লাভে ব্যর্থ হয়।

তামাক নিয়ন্ত্রণের আর একটি কার্যকর উপাদান হচ্ছে তামাকজাত সকল পণ্যের কর বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ নাজুক অবস্থায় আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বে সবচেয়ে কম দামে সিগারেট পাওয়া যায় এমন তিনটি দেশের মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস-এর এক প্রস্তাবনাপত্রে দেখা গেছে, বাংলাদেশের তামাকের বর্তমান কর কাঠামো বেশ জটিল। বলা হয়েছে, সম্পূরক কর (এক্সসাইজ ট্যাক্স), মূল্যে শতাংশ হিসেবে ধার্য রয়েছে। তামাক পণ্যের ধরণ এবং ব্রান্ডভেদে সম্পূরক করের উল্লেখযোগ্য তফাৎ রয়েছে। দামী ব্রান্ডের তুলনায় সস্তা ব্রান্ডের ওপর করের মাত্রা অনেক কম। সিগারেট ক্ষেত্রে স্তরভিত্তিক যে কর কাঠামো বিদ্যমান, যা ভিন্ন ভিন্ন অ্যাড-ভ্যালোরেম কর হিসেবে খুচরা মূল্যস্তরের ওপর ধার্য রয়েছে। বিড়ির ওপর ধার্য কর অত্যন্ত কম এবং তা কেবল সরকার নির্ধারিত ট্যারিফ ভ্যালুর প্রযোজ্য। এর বাইরে তামাক কোম্পানীর কর ফাঁকি ও প্রচারণার কৌশল তামাক নিয়ন্ত্রণকে বাধাগ্রস্থ করছে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ সিগারেটে মিথ্যা মূল্যস্তর ঘোষণায় প্রায় ৭'শ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। মূল্যস্তর কম দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির এ ঘটনা সম্প্রতি উচ্চ আদালতে প্রমাণ হওয়ায় অর্থ পরিশোধে নির্দেশ আদলত দিলেও কুটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে কর ফাঁকির অর্থ পরিশোধ না করে তারা মাফ পেয়ে গেছে।

গত ২০১৬ সালের ৩০-৩১ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত 'টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন' শীর্ষক সাউথ এশিয়ান স্পিকার'স সামিট এর সমাপনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এমতাবস্থায়, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির উপর তামাকের নেতিবাচক প্রভাবের কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন- "২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিমূর্ল করা" বাস্তবায়নে অবিলম্বে একটি কার্যকর শুল্কনীতি প্রণয়নের প্রস্তাব করছি। মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে কার্যকর শুল্কারোপের মাধ্যমে প্রতিবছর তামাকপণ্যের দাম বাড়াতে হবে যাতে তামাকপণ্য ক্রমশ: ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এছাড়া বিদ্যমান আইনের দূর্বলতা, বাস্তবায়ন এবং তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ ইত্যাদির কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী।