এই লাশ বিবেকের

মুহম্মদ নূরুল হুদামুহম্মদ নূরুল হুদা
Published : 8 July 2012, 03:52 PM
Updated : 8 July 2012, 03:52 PM

দুইপাশে দুই অপ্রাপ্তবয়স্ক নাতি। সামনে একমাত্র উপার্জনক্ষম মেয়ের লাশ। সত্তরোর্ধ বুড়ি-মা সেই যুবতী লাশের সামনে বুক চাপড়ে বিলাপ করছেন আর বলছেন, 'এখন কে আমাকে খাওয়াবে? কে লালন-পালন করবে এই অনাথ শিশু দুটিকে?' এবার বর্ষার শুরুতে অতি-বৃষ্টির ফলে চট্টগ্রামের খুলশি এলাকায় আকবর শাহ মাজার সংলগ্ন ইয়াছিন কলোনিতে আবার পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। সেই ধসে মাটিচাপা পড়ে নিহত আপন মেয়ের লাশের সামনে এভাবেই আহাজারি করছিলেন ভবিষ্যতহীন এই বৃদ্ধা। এমনিতেই চোখে কম দেখেন। তার ওপর অশ্রুহীন দু'চোখ জুড়ে ঘনীভূত হয়েছে জগৎ-সংসারের তাবৎ অন্ধকার।


এই অতিবর্ষণ, এই পাহাড়ধস, এই কাদা-কবর, এই আহাজারি আর এই লাশ নতুন কোনো বিষয় নয়। বুড়ি-মা বা তার মতো মানুষের জন্য যেন এই ঘটনা নিয়তি-নির্ধারিত। প্রতি বছর প্রথম কদম ফুল ফোটার রেশ ধরে আমরা, শহর-গ্রামের সৌভাগ্যবানরা, বর্ষাকে আনন্দিত চিত্তে আবাহন জানাচ্ছি, গান-কবিতা-নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করছি। তারপর বিরহ-বেদনায় কাতর হয়ে কবিতা আউড়াচ্ছি, 'এ ভরা ভাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর', কিংবা 'এমন দিনে তারে বলা যায়', কিংবা 'কেঁদেও পাবে না তারে বর্ষার অজস্র জলধারে… ' ইত্যাদি আরও কত আনন্দ-বেদনার পঙক্তি-বৃষ্টি।

তারই পাশাপাশি পাহাড়-সমুদ্র-নদী-খচিত এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দেশে বুড়ি-মার বিলাপের মতো মর্মান্তিক খবরও বর্ষারম্ভের একটি নিত্য-নবায়িত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এক মৃত্যু থেকে দুই মৃত্যু, ক্রমে তা শত মৃত্যুতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।

আমরা এ-ধরনের দুর্ঘটনা সম্পর্কে পত্রিকাজোড়া খবর দেখছি, তারপর স্বাভাবিকভাবেই ত্রাণ নিয়ে ছুটছি হন্তদন্ত। কেউ কেউ কর্তৃপক্ষের যুৎসই সমালোচনা করছি, সুযোগমতো লাগসই বক্তৃতা-বিবৃতিও দিচ্ছি। তারপর বর্ষার জল নেমে যাওয়ার আগেই সবকিছু মন থেকে ধুয়ে-মুছে আপন আপন কাজে নিয়মমাফিক মনোনিবেশ করছি। আমরা সমস্যার সাময়িক সমাধানের লক্ষ্যে প্রলেপ-জাতীয় অষুধ দিয়ে আগামী বছরগুলোর জন্য স্থায়ী সমাধানের কথা না ভেবেই রণে ভঙ্গ দিচ্ছি। শুধু এই সমস্যা নয়, জাতীয় বা আঞ্চলিক সব সমস্যার ক্ষেত্রেই আমাদের উদ্যোগ প্রধানত এই ধরনেরই। আমরা দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করি, আগে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রতিরোধের ব্যবস্থা করি না। খুলশি এলাকার পাহাড়ধস-জনিত প্রাণহানি এ রকম অনেক উদাহরণেরই একটিমাত্র। আমরা প্রতি বছর খুলশি ও তার আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় এ রকম দুর্ঘটনার খবর পাচ্ছি। কয়েক বছর আগে পাহাড়ধসের ফলে একরাতে এখানে শতাধিক মানুষের যে গণকবর রচিত হয়েছিল, তা আমাদের জাতীয় বিবেক থেকে বিশ্ববিবেক পর্যন্ত সর্বত্র ঝাঁকুনি দিয়েছিল। এরপর তো এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটার কোনো কারণ ছিল না। তাহলে কেন এমনটি হল?

এর উত্তর অনেককিছুই হতে পারে। তবে সম্ভাব্য সহজ উত্তরের মধ্যে দুটি হচ্ছে: ১. বেঁচে-যাওয়া ছিন্নমূল মানুষগুলো আবার এই ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি ঢালুতে ঝুপড়ি তুলে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিল; ২. এই ঝুঁকি-বসতি গড়ে উঠতে দেখেও তার উচ্ছেদের জন্য যথাসময়ে কর্তৃপক্ষের দিক থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

এই দুটি প্রত্যক্ষ বিষয়ের সঙ্গে আরো-কিছু পরোক্ষ বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেমন, ছিন্নমূল মানুষগুলো কেন চরম বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়েও বসতি গড়ল? স্পষ্ট কারণ, তাদের কোনো নিজস্ব ভিটেবাড়ি নেই, তাই তাদের কোনো উপায়ান্তর নেই। আবার এ-ও হতে পারে, এই সরকারি জমিগুলোর উপর নিজের অবৈধ দখল প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য কোনো কোনো প্রভাবশালী মহল তাদের এই জায়গায় ঘরবাড়ি করার উৎসাহ ও অভয় দিয়েছে। তাই তারা আবার ঝুঁকি-বসতি গড়েছে। কর্তৃপক্ষ কি এসব দেখেও দেখেনি? যদি দেখে থাকে তাহলে তাদের নিরব থাকার কারণ কী? একটি বোধগম্য কারণ এই যে, হয়তো প্রয়োজনীয় স্থান ও সম্পদের অভাবে বা অপ্রতুলতায় এদের অন্য কোনো নিরাপদ জায়গায় স্থায়ীভাবে পুনর্বাসিত করা সম্ভব হয়নি। কিংবা এ-ও হতে পারে, সংশ্লিষ্ট প্রতিপত্তিশালী মহলের প্রভাবে বা তাদের সঙ্গে যোগসাজশের কারণে তারা এ-ব্যাপারটি দেখেও না দেখার ভান করেছে। অর্থাৎ পুনরায় অবৈধ ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ এই খুপড়ি-বসতি গড়ে তোলার জন্য এই উন্মূল মানুষের চরম অসহায়তার পাশাপাশি আমাদের মতো নিরাপদ মানুষ, তথা শাসক, প্রশাসক ও দখলদাররাও বিশেষভাবে দায়ী।

সবচেয়ে বেশি দায়ী অবশ্যই আমাদের সম্মিলিত বিবেক। ছিন্নমূল মানুষের অসহায়তা আসলে কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ হতে পারে না। কেননা এক্ষেত্রে তারা প্রায় বিকল্পহীন। মূল দায়িত্ব প্রশাসনের এবং প্রশাসনকে প্রভাবিত করছেন এমন সব প্রতিপত্তিশালীদের। সেইসঙ্গে আমাদের মতো সুশীল সমাজেরও, যারা এই ব্যাপারে যথাযথ ও সময়োচিতভাবে সোচ্চার হতে শিখিনি।


আমরা সবাই জানি, প্রতিবছর এই ধরনের বিপর্যয়-রোধের একমাত্র সমাধান খুলশি-সহ চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম আর কক্সবাজারের সব পাহাড়ের ঢাল, পাদদেশ ও মৃত্যুউপত্যকা থেকে সব ধরনের মানববসতি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া। কিন্তু কে করবে এই কাজ? সহজ উত্তর, অবশ্যই সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। প্রাথমিক দায়িত্ব তাদেরই। অস্বীকার করার উপায় নেই, ছিন্নমূল মানুষদের নিরাপদ সরকারি জায়গায় অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত করা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাজ। আর এই কাজে প্রশাসনকে পূর্ণ সহায়তা, অনুমোদন ও তহবিল যোগাতে হবে সরকারকেই। অন্য কোনো মহানুভব ব্যক্তি, দাতা, সংস্থা বা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবে, এটিও বিশেষভাবে কাম্য। তবে তাদের অপেক্ষায় সরকার ও প্রশাসন প্রহর গুণতে পারে না। যারা এগিয়ে আসবে, তাদের দান-সহায়তা সরকার যথাযথ পদ্ধতিতে ব্যবহার করবে অবশ্যই। বেসরকারি সংস্থাগুলোর মূল ব্যর্থতা এই যে, তারাও প্রথম থেকে এ পর্যন্ত নিরাময়মূলক অস্থায়ী-সমাধানে এগিয়ে এসেছে, স্থায়ী আরোগ্যমূলক সমাধানে উদ্যোগী হয়নি। কাজেই তাদের অপেক্ষায় দিনগোণার সময় সরকারের নেই। আজ এই মুহূর্ত থেকে যদি সরকার ও প্রশাসন খুলশি-সহ দেশের সব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি-বসতির ছিন্নমূল মানুষের নিরাপদ বসবাসের ব্যবস্থা না করে, আর এ-কারণে নতুন কোনো মানুষের কাদা-সমাধি বা সলিল-সমাধি হয়, তাহলে তার জন্য সরকার ও প্রশাসনসহ দায়ী থাকব আমরা সবাই। দায়ী থাকবে আমাদের বিবেক ও মানবতাবোধ। যদি বিবেক ও মানবতাবোধ নামে আদপেই কিছু থাকে!


চট্টগ্রামের খুলশির ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামর আরও তিনটি জেলা কিংবা কক্সবাজারেও অতীতে এমন ঘটনা ঘটেছে। এমনকি, বছর কয়েক আগে পাহাড়ধসজনিত মাটিচাপার কারণে কক্সবাজার সৈকতের পাশে অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত সেনাছাউনিতে সেনাবহিনীর কয়েকজন সদস্যও প্রাণ হারিয়েছেন। অর্থাৎ এটি একটি প্রায়-নিয়মিত দুর্ঘটনা, যা প্রতিরোধযোগ্য হওয়া সত্বেও আমাদের চরম নির্বুদ্ধিতা, দায়িত্বহীনতা ও বিবেকহীনতার কারণে আমরা এই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছি। আর নিজেরাই নিজেদের দোষী সাব্যস্ত করতে বাধ্য হচ্ছি।

সত্য এ-কথাও যে, প্রতিটি অঞ্চলের দুর্ঘটনার কার্যকারণ কিছুটা আলাদা। যেমন, কক্সবাজার সৈকতে পাহাড়ের পাদদেশে সেনা সদস্যরা ছাউনি নির্মাণ করেছেন ছিন্নমূল মানুষ বা বিকল্পহীন হয়ে নয়। তারা করেছেন দেশ ও জাতির প্রয়োজনে। তবে এই কাঠামো তৈরি করার আগে তারা সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে চিন্তা করেছেন কিনা, অথবা পরিবেশ আইনের কথা বিবেচনায় নিয়েছেন কিনা, অথবা আবাসন গড়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আবাসন নীতি মেনেছেন কিনা, কিংবা সরকারের যথাযথ সংস্থার অনুমোদন বা অনাপত্তি নিয়েছেন কিনা, সে-সব কিছুও দেখার রয়েছে। নিয়ম জেনেও যারা নিয়ম ভাঙে সেই শক্তিমানের অপরাধ অক্ষমের অপরাধের চেয়ে বেশি বৈ কম হতে পারে না। বিষয়টি আমাদের সবার বোধগম্য হলেই মঙ্গল।

লক্ষ্যণীয়, কক্সবাজার এলাকায় পাহাড়ে-সমতলে-সৈকতে-সমুদ্রে অবৈধ দখল একটি নিয়মিত কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে।

অতীতে বেশ-কিছু প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর যে সব ছিন্নমূল মানুষকে কক্সবাজার বিমান-বন্দর সংলগ্ন সৈকতে (কুতুবদিয়া পাড়া, সমিতি পাড়া ইত্যাদি), আশপাশের টিলা কিংবা দ্বীপে (সোনাদিয়া, মহেশখালী ইত্যাদি) সাময়িকভাবে পুনর্বাসন করা হয়েছিল, তাদের প্রায় সবাই এখনও সেখানেই আছে। কেউ কেউ তাদের অস্থায়ী ভিটেবাড়ির দখলস্বত্ত্ব এই এলাকার বা বহিরাগত ভদ্রলোকদের কাছে মোটা অঙ্কে অবৈধভাবে হাতবদল করে অন্যত্র সরে পড়েছে। সৌভাগ্যবশত, এ-পর্যন্ত নতুন কোনো দুর্যোগের মুখোমুখি হয়নি এই সৈকতবাসীরা, ফলে কোনো প্রাণহানিও ঘটেনি। কিন্তু এমন দুর্যোগ ঘটতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। তখন আগের মতো অভাবনীয প্রাণহানি ঘটতে পারে। আর এর জন্য সমবেতভাবে দায়ী থাকব শাসক, প্রশাসক, রাজনীতিবিদ, পরিবেশবিদ, সুশীল সমাজসহ আমরা সবাই।


এবারে যে প্রাণহানি ঘটেছে তা মূলত অতিবর্ষণজনিত পাহাড়ি ঢল ও পাহাড়ধসের কারণে। কক্সবাজার জেলায় মৃত্যুর মূল কারণ পাহাড়ি ঢল। আর সেই ঢলের প্রধান কারণ নদীদখল ও নদীর নাব্যতাহীনতা। যথাযথ ড্রেজিং-এর অভাবে বাঁকখালী, ঈদগাঁও ছড়া, খুটাখালী ছড়া, মাতামুহুরীসহ ছোটবড় সব নদী সামান্য বর্ষণেই প্লাবিত হচ্ছে। আর এ-সব নদীর পাড় ও মোহনা অবৈধ-দখলকারীরা ব্যবসায়িক কাজে তথা মৎস্যচাষ ও মৎস্যশিকার ইত্যাদির নামে দখল করে রেখেছে। ফলে ঢল প্রতিবছর প্রবলতর ও প্রলয়ঙ্করী হয়ে উঠছে। যথাযথ সরকারি পদক্ষেপ ছাড়া এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। বান্দরবন বা বৃহত্তর চট্টগ্রামের অন্যত্রও মূলত অনুরূপ কারণ বিরাজমান। নদীর ক্ষেত্রে নাব্যতাহীনতাসহ পাড়-মোহনার দখল আর পাহাড়ের ক্ষেত্রে ঢালু-পাদদেশ-চূড়া ইত্যাদিতে অবৈধ বসতি নির্মাণ। সারা বাংলাদেশে প্লাবনের মূল কারণ নদীর নাব্যতাহীনতা ও আমাদের সীমানার বাইরে নদীর গতিপথ রোধকারী বাঁধ। এ দুটির সমাধান যথাযথ সরকারি পদক্ষেপ ছাড়া অসম্ভব।

গত ১লা জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে পাহাড়ধস ও পাহাড়ি ঢলে প্রাণহানির সংখ্যা ১১৫ (কক্সবাজার ৪১, বান্দরবন ৩৬, চট্টগ্রাম ৩১, সিলেট ২) হলেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা কয়েক কোটি। পুরো বর্ষাকাল জুড়ে এই ধরনের ভয়াবহ বন্যা চলতে থাকলে এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। কাজেই এই মুহূর্তের প্রথম করণীয় হচ্ছে, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার সব মানুষকে নিরাপদ স্থানে পুনর্বাসিত করা। আর সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে প্রয়োজন সাময়িকভাবে পুনর্বাসিত এলাকা থেকে তাদের স্থায়ীভাবে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া এবং তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। আরও একটি বিষয় নিশ্চিত করা খুবই জরুরি : পাহাড়ে, নদীপাড়ে বা সৈকতের নতুন কোনো জায়গায় যেন নতুন কোনো ঝুঁকিপূর্ণ অস্থায়ী বসতি গড়ে উঠতে না পারে। বিষয়টি নিয়মিত তদারকির মধ্যে রাখা দরকার। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, পাহাড়ি এলাকায় যারা যুগ যুগ ধরে নিজস্ব বসতভিটেয় নিরাপদ জীবনযাপন করে আসছেন, তাদের ক্ষেত্রে এই নীতি প্রয়োগের প্রয়োজন নেই।


অতিবর্ষণ, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি বাংলাদেশের সমতল-অসমতলের তাবৎ জনগণ, বিশেষত উপকূলীয় মানুষ বা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিত্যদিনের সঙ্গী। এগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করেই আমরা বেঁচে আছি, সামষ্টিকভাবে বেঁচে থাকব অনন্তকাল। বন্যা যে আমাদের জন্য উপকারী এ-কথাও এই কৃষিপ্রধান দেশের প্রায় প্রত্যেক বাস্তববাদী নাগরিক অবহিত আছেন। সম্প্রতি এই বিষয়টির প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বন্যা শুধু পাড় ভাঙে না, পাড় গড়েও। পলি এসে নতুন চর গড়ে, আভাসিত করে তোলে সমুদ্রগর্ভে অন্য এক উড়ির চর। বন্যার জল আমাদের ভূমির সীমানা বাড়ায়, উর্বরতা বাড়ায়, আমাদের ভুমিগর্ভে অত্যাবশ্যকীয় জলাধার তৈরি করে। আমি নিজের চোখে দেখেছি কীভাবে কয়েক বছরের উপর্যুপরি বন্যায় প্লাবিত হতে হতে আমাদের উপকূলীয় পৈত্রিক জমি নোনাভূমি থেকে ঊর্বর ধানি জমিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে আমরা নিরাপদে আমাদের বসতবাড়িও গড়তে পেরেছি। আমাদের বাড়ি থেকে মহেশখালী প্রণালী মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে। অথচ ১৯৬০ সালের পর আর কোনো প্লাবনে বা ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের ভিটেবাড়ি বিপন্ন হয়নি। আমার পিতার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফলেই এমনটি হয়েছে। তবে স্বীকার্য, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকার কর্তৃক নির্মিত উপকূলীয় বেড়িবাঁধ, সড়ক ও ভিটেবাড়ির চারপাশে রোপিত পর্যাপ্ত বৃক্ষ, আর প্রতি এলাকায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক আশ্রয়কেšদ্র স্থাপনের সুবিধাবলী। অর্থাৎ ভুক্তভোগী জনগণের সচেতনতা ও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সমন্বয়মূলক উদ্যোগই সমস্যা সমাধানের মূল চাবিকাঠি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, বন্যার ক্ষতিকর দিকগুলোকে সামাল দেওয়া গেলে এই বন্যা আমাদের জন্য বয়ে আনবে জাতীয় মঙ্গল। কিন্তু কে সামলাবে এই মত্ত জলহস্তীকে? এ ক্ষেত্রেও সরকারকেই নিতে হবে পরিকল্পিত উদ্যোগ ও কার্যক্রম, যার বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা ও দুর্নীতিহীনতার পাশাপাশি জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এই ধরনের দুর্যোগ-মোকাবেলার মতো মানবিক কর্মকাণ্ডে জাতীয় ঐক্য ও সম্মিলিত রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো বিকল্প নেই। কেবল দুর্যোগ-উত্তর ঝটিকা পরিদর্শন আর ত্রাণ বিতরণই এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়।

এবারের বর্ষণ ও বন্যা কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পত্রিকাগুলোতেও এ সম্পর্কিত খবরাখবর আর প্রতিবেদন কমে এসেছে। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি ক্রমেই আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে কি হ্রাস পাচ্ছে ছিন্নমূল, অসহায় ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের যথাযথ পুনর্বাসনের কার্যক্রম? যদি তাই হয়, তাহলে এর পরিণাম হবে মারাত্মক। সরকারি হোক কি বেসরকারি হোক, আমাদের এহেন দায়িত্বহীনতার ফলে যদি আর কোন মানুষ লাশ হয়ে যায়, তাহলে সেই লাশ হবে আমাদের সম্মিলিত বিবেকের লাশ। ব্যক্তি, গোষ্ঠি, দল, রাষ্ট্র ও জাতীয় পর্যায়ে এ হবে আমাদের জন্য পরম লজ্জার বিষয়। আসুন, আমরা আমাদের লজ্জা নিবারণ করি; আসুন, আমরা আমাদের বিবেককে জীবন্ত ও জাগ্রত রাখি।