পেশাদারিত্বের হালচাল ও একজন মাশরাফি

Published : 1 May 2019, 02:27 PM
Updated : 1 May 2019, 02:27 PM

দিন কয়েক আগে নড়াইল জেনারেল হাসপাতালে ঢুকে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখে পড়েন জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক এবং জাতীয় সংসদের এমপি মাশরাফি বিন মুর্তজা। সেখানে কর্মরত ডাক্তার বা সার্জনকে না পেয়ে তিনি হতাশ হন এবং সেই হতাশা সঙ্গে থাকা কারও ক্যামেরায় ধরা পড়ে এবং যেভাবেই হোক তা গণমাধ্যম, বিশেষকরে সোসাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

এই ঘটনা নিয়ে ডাক্তারি বিদ্যায় পাশ করা একজন মিডিয়া কর্মীর অধিকতর হতাশাজনক মন্তব্য প্রকাশিত হলে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তবোধ করে, ফলে সাধারণ মানুষের মতামত ও কিছু কিছু ডাক্তারদের মতামত দুটো ভিন্ন ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। ডাক্তাররা তাদের পেশার দায় ও নৈতিকতা উপেক্ষা করছে কি-না এমন প্রশ্নও ওঠে কোনও কোনও মহলের পক্ষ থেকে। এতো গেল ডাক্তারি পেশার সংকট। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে প্রতিটি পেশা কোনো-না-কোনওভাবে একইধরনের সংকটে নিমজ্জিত। পেশাদারিত্ব ও পেশাজীবী বিষয়টি নিয়েই আজকের আলোচনা।

যে কাজ করতে বিশেষায়িত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়, সেই কাজ নিশ্চয়ই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাবিহীন কাউকে দিয়ে কেউ করাতে চাইবে না। যেমন, একজন ডাক্তারের কাজ হচ্ছে রোগের লক্ষণ নির্ণয় করে চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র দেওয়া; সেই কাজ নিশ্চয়ই ল্যাব-টেকনিশিয়ান বা ওষুধের দোকানের ফার্মাসিস্ট করলে হবে না। এটাই পেশাদারিত্ব। তবে, এখানেই কথা শেষ হয় না। পেশাদারিত্বকে আইনের সুরক্ষাও দিতে হয়, অর্থাৎ ভিটামিন বা সর্দি-কাশি-ব্যথা-বেদনার মতো কিছু ক্ষেত্র বাদে জীবনসংহারী  সকল ওষুধের ব্যবস্থাপনা ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ করলে তাকে শাস্তির মুখোমুখি করতে হয়, সেজন্য প্র্যাকটিশনার আইন লাগে।

অপরদিকে, ভুল ব্যবস্থাপত্রের কারণে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দায়-দায়িত্বও সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের উপরে বর্তায়। আবার নিয়োগদাতার শর্ত উপেক্ষা করে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে সেবাপ্রত্যাশী রোগী যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার দায়ও সংশ্লিষ্ট ডাক্তার এড়াতে পারেন না। অধিকন্তু, রোগীর প্যাথলজি বা যেকোনও ধরনের টেস্ট করার বিনিময়ে ল্যাবগুলো থেকে যদি কোনও ডাক্তার কমিশন নেন, বা ব্যবস্থাপত্রে কোনও নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধের নাম উল্লেখ করার বিনিময়ে কমিশন নেন, বা রোগীকে কোনও ক্লিনিকে পাঠিয়ে নিজেই তার চিকিৎসা করেন, তবে সেই ডাক্তার অনৈতিকার দায়ে অভিযুক্ত হতে বাধ্য এবং বিশ্বের অনেক দেশের আইনেই এসব অনৈতিক কাজ দণ্ডিত অপরাধ। অপরদিকে, ডাক্তাররা যেন তাদের ভুলের কারণে কোনও শাস্তির মুখোমুখি হতে না হয়, তার বিধানও থাকতে হয়, তা না হলে ব্যবস্থাপত্র লিখতে বা অপারেশন করতে একজন ডাক্তার কুণ্ঠিত হতে পারেন, যা কাম্য নয়। সেজন্য বিশ্বের দেশেদেশে বহুযুগ ধরে একদিকে যেমন পেশাজীবী সমাজ গড়ে উঠেছে, তেমনি করে অনেক পেশাকে আইনের আওতায় এনে তার ব্যবহার, উদ্দেশ্য এবং কার্যক্রম ঠিক করাসহ অবহেলা বা অপব্যবহারের কারণে জনগণ বা ব্যবহারকারী ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীকে শাস্তির মুখোমুখি করার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আবার অনিচ্ছাকৃত ভুলের মাশুল যেন সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীর ব্যক্তিগত আয় ও সম্পদের উপর না বর্তায়, সেজন্য পেশার ঝুঁকির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বীমার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ভুলটা যে অনিচ্ছাকৃত সেটা সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানির কাছে প্রমাণ করতে হয় এবং তা প্রমাণে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীর বীমার প্রিমিয়াম বেড়ে যাওয়াসহ বীমা না পাওয়ার মতো শাস্তির মুখোমুখিও হতে হয়। এভাবে কেবল আইন বা সুরক্ষা-বীমাই না, একইসাথে প্রতিটি পেশার নৈতিক মানদণ্ডও নির্দ্ধারণ করা হয়, যাতে করে আইনগত সীমার ভেতরে সমাধান না পেলে বৃহত্তর সামাজিক বা পরিবেশগত কাঠামোর মধ্যে একজন পেশাজীবী তার সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে পারে। শুধু তাই না, বিশ্বের বহুদেশে বেশিরভাগ পেশা স্ব-নিয়ন্ত্রিত; অর্থাৎ জনগণের বা ব্যবহারকারীর সাধারণ বা আর্থিক ক্ষতির প্রতিকারের জন্য সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান নিজেই এগিয়ে আসে। এছাড়া সদস্যদের পেশাকে যুগোপযোগী রাখা তথা পেশার মানবৃদ্ধির স্বার্থে নিরন্তর পেশা-উন্নয়ন কার্যক্রমও চালিয়ে যায়।

বাংলাদেশে আইনদ্বারা স্বীকৃত পেশাসমূহ:

১.          উকিল (বাংলাদেশ লিগ্যাল প্রাকটিশনার অ্যান্ড বার কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯৭২)

২.         ডাক্তার এবং ডেন্টিস্ট (মেডিক্যাল ডিগ্রি অ্যাক্ট ১৯১৬ এবং মেডিক্যাল কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯৭৩)

৩.         ইউনানি ও আয়ুর্বেদ ডাক্তার (ইউন্যানি অ্যাণ্ড আয়ুর্বেদিক অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩)

৪.         হোমিওপ্যাথি ডাক্তার (হোমিওপ্যাথিক প্রাকটিশনার অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩)

৫.         নার্সিং (নাসিং কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩)

৬.         চার্টার্ড অ্যাকাউন্টাণ্ট (চার্টার্ড অ্যাকাউন্টান্ট অর্ডার ১৯৭৩)

৭.         কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টান্ট (কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অর্ডিন্যান্স ১৯৭৭)

উল্লিখিত পেশাগুলো আইনদ্বারা স্বীকৃত হলেও বাংলাদেশের কোনও পেশাজীবী সংগঠনের গঠনতন্ত্রে, বিশেষকরে পরিচালনা পর্ষদে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংযুক্ত করার কোনও দৃষ্টান্ত দেখা যায় না। অথচ, উন্নত গণতন্ত্রের দেশে এটা খুবই সাধারণ সংযুক্তি। ফলে মাশরাফির মতো যেকোনও জনপ্রতিনিধি স্বেচ্ছায় কোনও পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার সাথে যুক্ত হতে পারেন এবং এভাবে পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতাকে গণমুখী করতে পারে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো আইনদ্বারা প্রতিষ্ঠিত পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানেরও জনগণের কাছে জবাবদিহিতার কোনও বালাই নাই। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালনা পর্ষদে দুই কি তিনজন এমপি থাকলে নড়াইল হাসপাতালে গিয়ে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে হয়তো এতটা হতাশ হতে হতো না। একই কথা বার কাউন্সিলসহ অন্যান্য সকল পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের বেলায় প্রযোজ্য। কোটি কোটি টাকার বকেয়া বিল নিয়ে বার কাউন্সিলকে জনগণের মুখোমুখি হতে হয় না, এটা কীভাবে সম্ভব!

আইনদ্বারা স্বীকৃত পেশার যে হাল সেখানে আইনদ্বারা স্বীকৃত নয় এমন পেশার যে কী অব্স্থা তা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশে আইনদ্বারা স্বীকৃত নয় এমন পেশার তালিকা অনেক লম্বা। উল্লেখযোগ্য পেশাগুলো হচ্ছে: প্রকৌশল, স্থাপত্য, ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, ওয়েল্ডার, ফিটার, অপারেটর, সার্ভেয়র, ইন্টেরিওর ডিজাইনার, মিলরাইট, মেকানিক, পেইন্টার,  থেরাপিস্ট, রেডিও-এ·রে থেকে শুরু করে সকল ধরনের ল্যাব টেকনিশিয়ান, গাড়ি বা যেকোনও ধরনের যন্ত্রের টেকনিশিয়ান, ইত্যাদি। এই পেশাগুলোর মধ্যে কোনও কোনওটির সমিতি আছে, তাদের অনেকে ব্রিটিশ যুগের সমিতি নিবন্ধন আইনের আওতায় দলভুক্ত। এর বাইরে সদস্যদের কার্যকলাপকে বিধিবদ্ধ করাসহ তাদেরকে জবাবদিহি করার কোনো সুযোগ বিদ্যমান আইনি-কাঠামোতে নাই।

অবাক হলেও সত্য যে, প্রকৌশলী ও স্থপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পেশাদুটো বাংলাদেশে আইনদ্বারা স্বীকৃত নয়। প্রকৌশলীদের প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউব অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইইবি) এবং স্থপতিদের প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউব অব আর্কিটেক্ট বাংলাদেশ (আইএবি), উভয়ে ১৮৬০ সালের ব্রিটিশ প্রণীত সংঘ বা সমিতি নিবন্ধন অ্যাক্টের আওতায় প্রতিষ্ঠিত। ওই আইনের অধীনে কয়েকজন ব্যক্তি মিলে যেকোনও ধরনের সমিতি বা সংঘ তৈরি করতে পারে, তার সাথে পেশার কোনও সম্পর্ক নাই।

ধরা যাক, নওগাঁ উকিলপাড়ার কয়েকজন ব্যক্তি মিলে ঠিক করল যে তারা প্রতিদিন সকালে সূর্যোদয় দেখবে এবং সেকারণে 'উকিলপাড়া সূর্যোদয় দর্শন সমিতি' নামে একটি সংঘ নিবন্ধিকরণ করতে চায়, তো ওই আইনের আওতায় সেটা তারা করতে পারবে এবং সমিতির সদস্যদের একটা পরিচয়ও ঠিক করে নিতে পারবে। আইবি বা আইএবি সেই কাজটিই করেছে। কেবল তাই না, আইইবি ও আইএবি তাদের সদস্যদের পরিচয় ইঞ্জিনিয়ার বা স্থপতি ঠিক করে নিয়েছে। এই ঠিক করে নেয়াটাকে কেউ আদালতে চ্যালেঞ্জ করেনি, করলে কী হতো বলা মুশকিল।

উন্নত দেশের সাথে প্রধান পার্থক্য হলো সেসব দেশে ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্ট একটা পেশা, আর বাংলাদেশে এটা একটা পরিচয় মাত্র। পরিচয় তখনই পেশা হয়ে উঠতে পারে, যখন তার সপক্ষে আইন থাকে। বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্ট পেশার সপক্ষে কোনও আইন নাই। ফলে, বাংলাদেশে যে কোনও ব্যক্তি যদি তার নামের সাথে ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্ট লেখে, শুধুই লেখে না, যেকোনও ধরনের প্রকৌশল কাজের ড্রয়িং স্বাক্ষর করে, তবে আইন দ্বারা তাকে দণ্ড দেওয়া তো দূরের কথা নিবৃত করাও যাবে না। আবার সমিতির সদস্য হওয়ার কারণে আইইবি বা আইএবির কোনও সদস্য যদি তার অধীত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে কোনো ধরণের নকশা স্বাক্ষর করে এবং সঙ্গতকারণে জনগণ ক্ষতিগ্রস্থ  হয়, তবে তাকে শাস্তির মুখোমুখি করা সম্ভব হবে না। অপরদিকে, আইনদ্বারা স্বীকৃত না হওয়ার কারণে প্রকৌশল বা স্থাপত্য কাজে নিয়োজিত কোনও ব্যক্তির পক্ষে ভুলজনিত কারণে বীমার সুরক্ষা-সুবিধা দেয়াও সম্ভব হবে না।

'প্রকৌশল কার্যক্রমের প্রভাব থেকে মানুষ ও পরিবেশকে নিরাপদ রাখা' -এটাই প্রকৌশল ও স্থাপত্য পেশার দার্শনিক ভিত্তি এবং পুরো কার্যক্রমটি যদিও একাধিক প্রকৌশলী বা স্থপতির সম্মিলিত প্রয়াস, তথাপি নকশার দায়বদ্ধতা স্ব-স্ব ক্ষেত্রের প্রকৌশলী বা স্থপতির উপরে বর্তায়। অর্থাৎ, ওকালতি বা ডাক্তারি পেশার মতো এখানেও দায়বদ্ধতার রূপটি ব্যক্তিক। উন্নত দেশে এভাবেই ব্যক্তিকে দায়বদ্ধ করে প্রকৌশল বা স্থাপত্য কার্যক্রমের পক্ষে আইন প্রণয়ন করা হয় এবং কেবলমাত্র এই কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ব্যক্তিকে প্রকৌশলী বা স্থপতি হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি তাদের অনুকূলে লাইসেন্স দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, অ্যাক্ট প্রণয়নের উদ্দেশ্যে আইবি ও আইএবি উভয়ের পক্ষ থেকে একটা আন্দোলন অনেকদিন ধরেই চলছে; কিন্তু তা নিয়ে সমাজে কোনও আলোড়ন নেই। অথচ ভবন-ব্রিজ-কার্লভার্ট ধ্বসে পড়া, ভবনে আগুন লাগা থেকে শুরু করে বিদ্যুতের শর্ট-সার্কিট, কেমিক্যাল বিস্ফোরণ, নির্মাণ বা সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মরে যাওয়াটা নিত্য-নৈমির্ত্তিক ঘটনা। এগুলোর কোনও দুর্ঘটনা নয়, যদিও সেভাবেই বলা হয়ে আসছে। প্রতিটি ঘটনার পেছনে কারও না কারও অবহেলা আছে। কিন্তু, পেশা না হওয়া বা সেই পেশা রেগুলেটেড না হওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে দায়ী পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা যাচ্ছে না।

শর্ট-সার্কিটের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশে ভবনগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের প্রধানতম কারণ হচ্ছে বিদ্যুতের শর্ট-সার্কিট। মনে হবে, যেন ভৌতিক কোনও কিছু বিদ্যুতের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। সারাবিশ্বে বৈদ্যুতিক কোড এবং বিদ্যুত নিয়ে কাজ করে যে পেশাজীবীরা, তার নাম ইলেকট্রিশিয়ান। কিন্তু বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক কোড যেমন নেই, তেমনি ইলেকট্রিশিয়ানও আইনদ্বারা স্বীকৃত কোনও পেশা না। তবে, বাংলাদেশে ইলেকট্রিক্যাল সুপারভাইজরি লাইসেন্স প্রদানকারী নামে একটা কর্তৃপক্ষ আছে এবং তারা এ-বি-সি সুপারভাইজরি লাইসেন্স নামে একধরনের লাইসেন্স প্রদান ও নিয়ন্ত্রণ করে। এটি মূলত ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক বা ডিপ্লোপাধারীদের জন্য প্রযোজ্য এবং নাম থেকে ধারণা করা যায় যে, এরা হাতে-নাতে কাজ করে না।

অধিকন্তু, আইনের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় উক্ত লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের বাইরে যেকোনও মানুষ অয়্যারিং-এর কাজ করতে পারে এবং করে। ফলে কোথায় কে কীভাবে বিদ্যুত নিয়ে কাজ করছে কেউ বলতে পারবে না। দুটো তারের মধ্যে কীভাবে সংযোগ হবে, অথবা কীভাবে তাদেরকে দূরে রাখতে হবে, তারগুলো যে কন্ডুইটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেগুলো দাহ্য কি-না, অথবা কোথায় দাহ্য-কন্ডুইট ব্যবহার করা যাবে, কোথায় যাবে না, এই জ্ঞান একজন সাধারণ মানুষ পাবে কোথায়? প্রয়োজনীয় কোডের অভাবে বাংলাদেশের মানুষকে নির্ভর করতে হচ্ছে নানা ধরনের বই-পুস্তকের উপর।

অথচ বইপুস্তকে সকলকিছু থাকে না, সেটা বইয়ের উদ্দেশ্যও না। একই কথা প্রযোজ্য প্লাম্বার থেকে শুরু করে ওয়েল্ডার, এমনকি প্রকৌশলী ও স্থপতি সকলের বেলায়; তাদের জন্য কোনও বিল্ডিং, ফায়ার বা প্লাম্বিং কোড নেই এবং নেই কোনো রেগুলেটেড প্রতিষ্ঠান। ফলে জ্ঞানগুলো সমন্বিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না।

প্রকৌশল, চিকিৎসা বা স্থপতি পেশার সংকটকে এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ এটাই যে এই পেশাকে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতদের পেশা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তারা যে কেবল দেশের অগ্রসর মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আগত তা না, একই সাথে শিক্ষার মানবিচারে এই বিদ্যার ছাত্র-ছাত্রীদের মেধাবী বলেও গণ্য করা হয়। তো এই পেশার যখন এরকম করুণ অবস্থা, তখন ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, সয়েল টেস্টিং টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে সার্ভেয়ার, ল্যাব-টেশনিশিয়ান, এক্সরে টেকনিশিয়ান, ফিজিওথেরাপিস্ট, মেডিক্যাল সহকারি, এমনকি ওয়েল্ডার, পাইপ ফিটার, পেইন্টার, মেকানিক, ড্রাইভার ইত্যাদি পেশার কী হাল, সেটা বলাই-বাহুল্য। এখানে যে কয়েকটি পেশার নাম উল্লেখ করা হলো, তাদের প্রত্যেকে কোনো-না-কোনোভাবে মানুষের জীবনের নিরাপত্তার সাথে যুক্ত এবং সেই পেশার সাথে যুক্ত ব্যক্তির সামান্য অবহেলায় মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারে। কাজেই প্রকৌশল বা স্থপতি পেশা তো বটেই, মানুষের জীবনের নিরাপত্তার সাথে যুক্ত সকল পেশাকে রেগুলেটেড করার কোনো বিকল্প নাই। আবার ডাক্তারি পেশা রেগুলেটেড হলেও তাকে গণমূখী ও অধিকতর জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার। সরকারের কাজ হবে জীবনের নিরাপত্তার সাথে যুক্ত সকল পেশাকে চিহ্নিত করে তাদের জন্য স্বনিয়ন্ত্রিত কাঠামো তৈরির পক্ষে আইন প্রণয়ন করা; তখন কেবল লাইসেন্স প্রদান নয়, পেশাজীবীর ভুল বা অবহেলাজনিত কারণে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রতিকারের প্রাথমিক কাজটিও স্ব-স্ব সংস্থাই করতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি বীমা নামক একটি প্রতিষ্ঠানও নতুন দিগন্তে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে। এভাবে সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরি হবে এবং স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সামাজিক নেতৃত্ব গড়ে উঠবে।

একইসাথে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে জনপ্রতিনিধিদের সংযুক্তির বিধানও রাখতে হবে, যাতে করে ভবিষ্যতে কোনও মাশরাফিকে হাসপাতাল বা কোনও ভবন বা কোনও কারখানায় গিয়ে হতাশ হতে না হয়। ডাক্তারদের লাইসেন্স প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিএমএ যদি 'অপরাধী' ডাক্তারদের পক্ষে না দাঁড়িয়ে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের লাইসেন্স নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হতো, তাহলে কেবল কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করা না, কমিশন খাওয়া থেকে শুরু করে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে রোগির চিকিৎসার যে নানা অনৈতিক অভিযোগ আজকে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে, তারও একটা প্রতিবিধান হতো।