শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলাঃ “ইসলামপন্থার” রাজনীতির সঙ্কট

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 29 April 2019, 02:25 PM
Updated : 29 April 2019, 02:25 PM

ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কায় গির্জা এবং হোটেলে এক যোগে আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন ২৫৩ জন এবং আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক। নিহতদের মধ্যে একজন বাংলাদেশী শিশুসহ রয়েছে ৪০ জন শিশু।

শ্রীলঙ্কায় আত্মঘাতী হামলা নতুন নয়। ১৯৮৩ থেকে ২০০৯ কালপর্বে ভিলুপিল্লাই প্রভাকরণের লিবারেশন টাইগারস অফ তামিল এলামের (এলটিটিই) নেতৃত্বে আর্থ, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে বঞ্চিত শ্রীলঙ্কার তামিলদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেখানে এ সংগঠনটি আত্মঘাতী হামলাসহ ব্যাপক সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমে লিপ্ত হয়েছিল। আধুনিক বিশ্বে এ এলটিটিই  আত্মঘাতী হামলার ধারণাকে সামনে নিয়ে আসে, যা এক সময় অনেককেই বিস্মিত করেছিল।

আশির দশকে "ইসলামপন্থার" রাজনীতি যারা করতেন তাঁরা এ ধরনের আত্মঘাতী হবার ধারণাকে প্রত্যাখান করেছিলেন, কেননা ইসলাম কোন অবস্থাতেই আত্মহত্যাকে সমর্থন করে না। তবে "ইসলামপন্থার" রাজনীতিতে শুরু থেকেই যেটা ছিল, সেটা হল মিলিট্যান্সির প্রভাব।

বাংলাদশ, পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের যেখানেই "ইসলামপন্থার" রাজনীতি কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছে, সেখানেই দেখা গেছে তারা প্রতিপক্ষের উপর ব্যাপক হামলা, নির্যাতন, সন্ত্রাস, ইত্যাদি করেছে তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর উপর নির্ভর করে। মিলিট্যান্ট রাজনীতিতে তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোই মূলতঃ ভ্যানগার্ড হিসাবে কাজ করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইসলামী ছাত্র শিবির হচ্ছে এর বড় উদাহারণ। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সে একই ভূমিকা পালন করে আসছে সেখানকার জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামি জমিয়ত-ই-তালাবা। উল্লেখ্য, এটি পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় এবং সুসংগঠিত ছাত্র সংগঠন।

আধুনিক বিশ্বে "ইসলামপন্থার" রাজনীতির যারা সূত্রপাত করেছিলেন তাঁরা তখন কল্পনাও করতে পারেননি যে এক সময় এ রাজনীতি বামঘেঁষা, সেকুলার তামিল জাতীয়তাবাদী সংগঠনের আত্মঘাতী হামলার ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হবে। উল্লেখ্য যে, একসময় "ইসলামপন্থার" আন্দোলন কমিউনিস্টদের তাদের প্রধান রাজনৈতিক শত্রু মনে করলেও তাদের আন্দোলন এবং সংগঠন গড়ে তোলবার পদ্ধতি "ইসলামপন্থী" দলগুলো ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে।

৯/১১ এর পর এক দশকের অধিক সময় ওহাবী/সালাফি ব্যাখ্যা নির্ভর "ইসলামপন্থার" আন্দোলনের একটা স্বর্ণযুগ অতিবাহিত হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। ওই সময়টাতে পশ্চিমা বিশ্বের সেকুলার গণতন্ত্র বনাম ইসলামপন্থার রাজনীতি বিশ্ব রাজনীতির মূল নিয়ামক বলে অনেকেই মনে করতে শুরু করেন। ওই সময়কালে মুসলিম প্রধান দেশগুলিতে "ইসলামপন্থার" রাজনীতির ব্যাপক বিকাশ ঘটে। আবার যোগাযোগ প্রযুক্তিরও বিস্তার ঘটে সেসময়টাতেই।

সেসময়েই প্রাচ্য পাশ্চাত্য সব জায়গাতেই— হোক তাঁরা সেখানে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু— মুসলিম মধ্য এবং উচ্চবিত্ত তরুণ সমাজের মাঝে ব্যাপক অস্থিরতা জন্ম লাভ করে। বিশ্বের দ্রুত পরিবর্তনের সাথে তাঁরা যেন কিছুতেই তাল মিলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। তাঁদেরকে যে বিষয়টা সবচেয়ে ভীত করে তুলে সেটা হল তাঁদের নারী সমাজ পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে তাঁদের পোশাক এবং জীবনাচরণের না পরিবর্তন ঘটায়। তাঁরা আরো উদ্বিগ্ন ছিলেন এই ভেবে যে, নারীরা রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারসহ সব জায়গাতেই সমনাধিকার না দাবী করে বসে।

নারীর প্রশ্নটি হচ্ছে সমস্ত বিশ্বে "ইসলামপন্থার" রাজনীতির কেন্দ্রীয় ইস্যু। কমিউনিস্ট রাজনীতির মূল ফোকাস যেমন বুর্জোয়া বা পুঁজিপতিদের ইস্যু। কমিউনিস্টদের আশু লক্ষ্য হচ্ছে বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামোতে পুঁজিপতিদে আধিপত্যের অবসান ঘটান। তেমনি "ইসলামপন্থার" রাজনীতির মূল বিষয়টা হচ্ছে রাষ্ট্র, সমাজ এবং পরিবারের কোথাও যাতে পাশ্চাত্যের ধারণার আলোকে নারীপুরুষের সমনাধিকার প্রতিষ্ঠা না হয় সে লক্ষ্যে সব সময় সক্রিয় থাকা। ফলে, এখন পর্যন্ত প্রকাশ্য বা গোপন কোনো "ইসলামপন্থী" দল বা সংগঠনে নারীদের কেন্দ্রীয় বা মূল ভূমিকায় দেখা যায়নি।

এর বাইরে তারা তাদের রাজনীতি অগ্রসর করে নিয়ে যাবার প্রধান প্রতিবন্ধক হিসাবে চিহ্নিত করে লোকজ সংস্কৃতি এবং দেশভেদে কমিউনিস্ট, সেকুলার, উদারপন্থী দলসমূহ ও বিভিন্ন অমুসলিম সম্প্রদায়কে।নারীদের অবদমন করে রাখবার বিষয়টা মুসলিম তরুণ সমাজের একটা বড় অংশের "ইসলামপন্থী" দল বা সংগঠনের সাথে নিজেদের মানসিক সংসক্তির মূল কারণ।

কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এ তরুণদের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান থাকে খুব প্রাথমিক পর্যায়ে। মুসলিম সমাজের একটি বড় অংশের মাঝে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির জটিল প্রশ্নসমূহের উত্তর ধর্মীয় পরিকাঠামর বাইরে যেয়ে বিভিন্ন চিন্তা, তত্ত্ব, দর্শন বা মতবাদের আলোকে বোঝার চেষ্টা করবার প্রবণতা বা আকাঙ্ক্ষার একটা প্রবল অনুপস্থিতি বিদ্যমান। এ তরুণ সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসলামের আলোকে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যেয়ে তাঁরা সাহায্য নেয় সামাজিক যোগযোগের মাধ্যমগুলোর।

এ সমস্ত মাধ্যমসহ ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে ওহাবী/সালফি চিন্তাধারার আলোকে ইসলামকে ব্যাখ্যার একটা প্রবল উপস্থিতি গত দুই দশক ধরে বিরাজমান। ফলে, তরুণ সমাজ সহজেই সে ব্যাখ্যার সাথে পরিচিত হচ্ছে। এটা অনেক ক্ষেত্রেই শুধু ধর্মীয় ব্যাখ্যাতে সীমাবদ্ধ না থেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের মাধ্যম হিসাবেও ব্যবহার করা হচ্ছে।

অন্য কোন ব্যাখ্যা, চিন্তা বা মতবাদের সাথে পরিচয়ের অবকাশ না থাকবার ফলে তরুণ সমাজের কাছে ওহাবী/সালফি চিন্তাধারাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যবহারের ধারণাকে সঠিক মনে হয় এবং এর প্রতি তাঁরা আকৃস্টও হয়। কিন্তু, এ আকর্ষণ আবার একই সাথে এক ধরণের মানসিক যন্ত্রণারও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ওহাবী/সালফি চিন্তাধারার সাথে পরিচিত হয়ে তাঁরা দেখতে পায়, এ ধরণের চিন্তাধারা আধুনিক বিশ্বের জাগতিক নানা বিষয় আশয়— যেমন পর্নোগ্রাফি, চলচ্চিত্র, নাটক, সঙ্গীত, নৃত্য, ভাস্কর্য, চিত্রাঙ্কন,মডেলিং,সোশ্যাল মিডিয়াতে নারীদের সাথে যোগাযোগ, চ্যাটিং, খেলাধুলা, প্রেম, বিবাহ বহির্ভুত যৌনতা ইত্যাদি— সবকিছুকেই মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ বলে।ফলে, ব্যক্তি জীবনে একদিকে ভালো মুসলিম হবার আকাঙ্খা, অপরদিকে উপরোক্ত বিষয়গুলির সাথে নিজেদের সংসক্তি বা দূরে থাকতে পারবার ব্যর্থতা তরুণ সমাজের মাঝে মনোজাগতিক সঙ্কট তৈরি করে।

উপরন্তু, সোশ্যাল মিডিয়াতে তাঁরা ক্রমাগত নারীদের বোরখা পরিধান বা পর্দা করবার কথা বলে গেলেও একই সাথে তাঁরা যখন দেখতে পায় তাঁদের নিজেদের আগ্রহ বিভিন্ন নায়িকা, গায়িকা, মডেল বা পর্ণস্টার, এদের প্রতি— তখন মনোজাগতের এ বৈপরীত্য তাঁদেরকে নৈরাজ্যবাদিতার দিকে ঠেলে দেয়। নিজেদের জীবনাচারণ, পছন্দ ইত্যাদির সাথে যখন বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয় তখন এর ব্যাখ্যা খুঁজে না পেয়ে তাঁদের মাঝে নৈরাজ্যবাদী মনস্তত্ত্ব জন্ম লাভ করে। আর এ নৈরাজ্যবাদী মনস্তত্ত্বের তরুণরাই হচ্ছে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের মত "ইসলাম ধর্মভিত্তিক" সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সদস্য সংগ্রহ করবার মূল টার্গেট।

৯/১১ পরবর্তী সময়ে আল কায়েদার চেয়েও শক্তিশালী আইএস যখন গড়ে উঠে এবং ইরাক ও সিরিয়ার অনেক জায়গা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় তখন সারা বিশ্বের মুসলিম তরুণদের একটা বড় অংশ তাদের সাথে নিজেদের মানসিক সাযুজ্য খুঁজে পায়। দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে মুসলিম তরুণরা এবং কিছু তরুণী এতে যোগদান করে।

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে এর সহযোগী, অঙ্গ বা ভাতৃপ্রতীম সংগঠন গড়ে তোলা হয়। যারা সরাসরি যোগদানের সাহস করতে পারেননি তাঁদের অনেকেই মনে মনে একে সমর্থন করতে থাকে। আইএসের নির্মমতা, নৈরাজ্যবাদীতা, ধ্বংসাত্মক প্রবণতা, অমুসলিমদের সাথে নির্মম আচরণ, এবং নারীদেরকে চরমভাবে অবদমন করে রাখাকেই এ তরুণ সমাজ সঠিক ইসলাম বলে মনে করতে থাকে। শুধুমাত্র ইসলাম শব্দটি ব্যবহার করেই আইএস তাদের সমস্ত অমানবিক এবং দানবীয় নির্মমতা এ তরুণদের সামনে জায়েজ করে ফেলে।

অপরদিকে, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পর পশ্চিমা বিশ্ব তাদের প্রশ্রয় পাওয়া "ইসলামপন্থার" রাজনীতি দ্বারা গণতন্ত্র, সেকুলার মতাদর্শ এবং উদারনৈতিক মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ হতে দেখলেও এ রাজনীতিকে সমাজতন্ত্রের মত সমূলে উৎপাটন করতে চায়নি। তাদের কাছে সব সময় মনে হয়েছে, "ইসলামপন্থার"রাজনীতির জোরালো অবস্থান পাশ্চাত্যকে মুসলিম বিশ্বের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভূমিকা পালন করবার সুযোগ দিবে।

কিন্তু, অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটে আইএসের হাত থেকে পতন্মুখ সিরিয়ার বাসার আল আসাদ সরকারকে রক্ষা করবার জন্য রাশিয়ার হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। প্রথামিকভাবে নানা দোদুল্যমানতা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনেকটা একক ইচ্ছায় মার্কিন সেনাবাহিনী ইরাক থেকেও আইএস উৎখাতে সক্রিয় হয়। ফলে, ইরাক এবং সিরিয়া থেকে আইএস প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

এর ধাক্কা লাগে মূল ধারার "ইসলামপন্থী" রাজনীতিতেও। বাংলাদেশ, মিসর ইত্যাদিসহ নানা দেশে মূলধারার "ইসলামপন্থার" রাজনীতি চরম কোণঠাসা অবস্থানে চলে যায়। পাকিস্তানসহ বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচনী রাজনীতিতে ঘটে তাদের চরম ভরাডুবি ।

যে তরুণরা এক সময় আইএসকে সমর্থন করতেন সেই তারাই বলতে শুরু করেন আইএস কোন ইসলামিক সংগঠন নয়, বরং মোসাদ এবং সিআইএয়ের তৈরি করা সংগঠন। ইসলামকে খারাপভাবে উপস্থাপনা করবার জন্য তারা এ ধরণের সংগঠন গড়ে তুলেছে। কিন্তু,তাঁরা একবারও এ প্রশ্নটি করেন না লক্ষ লক্ষ মধ্য এবং উচ্চবিত্ত মুসলমান তরুণ আমেরিকা, ইসরাইলের কথা শুনে কেন এ ধরণের সংগঠন গড়ে তুলবে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যারা এ কথা বলতে চাচ্ছেন যে, অমুসলিম রাষ্ট্রগুলির গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মুসলমানদেরকে প্রভাবিত করে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন গড়ে তুলেছে— তাঁরা যেটা বুঝতে পারছেন না সেটা হল এ কথা বলে প্রকারন্তরে তাঁরা অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের তুলনায় মুসলমানদের বিবেচনা বোধকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছেন।

মুসলমানদের মধ্যে যারা ওহাবী/সালাফি চিন্তাধারা প্রভাবিত "ইসলামপন্থার" রাজনীতির সাথে যুক্ত তাঁদের অনেকেই ১৯৭৯ সালে ইরানের শিয়া "ইসলামী বিপ্লব" দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও একই সাথে শিয়াদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন। অনেকে আবার তাদেরকে মুসলমান হিসাবে স্বীকার করতে চান না।

১৯৭৯ সাল থেকে শিয়া "ইসলামপন্থীরা" একটানা নিরবিছিন্ন ভাবে ক্ষমতায় আছেন। অপরদিকে, ওহাবী/সালাফি "ইসলামপন্থীরা" কখনো কখনো কিছুটা সফলতা পেলেও কোথাও তাঁরা সফলতা ধরে রাখতে পারেননি। দুই/একটা দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হবার অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। ৯/১১ পরবর্তী সময়ে তাঁরা তাঁদের রাজনীতিকে এগিয়ে নেবার একটা সম্ভাবনা দেখলেও বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়ার পুনুরুত্থান সহ নানাবিধ ঘটনা তাদেরকে চরম হতাশায় নিমজ্জিত করেছে।

"ইসলামপন্থার" রাজনীতি পাশ্চাত্যের রাজনীতি, সংস্কৃতির ক্রমাগত বিরোধীতা করলেও তাঁরা সব সময় উদগ্রীব থাকে পাশ্চাত্যের স্বীকৃতির। যেকোন সন্ত্রাসী হামলা বা রাজনৈতিক সফলতার পর তাঁরা প্রথমেই লক্ষ্য করে পাশ্চাত্য এর কতটুকু স্বীকৃতি দিল বা সেখানকার মিডিয়া কতটা গুরুত্ব দিয়ে তাঁদের সংবাদ প্রচার করল।

রাশিয়া, চীন বিশ্ব রাজনীতিতে জোরালো ভূমিকা পালন করবার আগ পর্যন্ত পাশ্চাত্যের মিডিয়া সমূহ "ইসলামপন্থার" রাজনীতি এবং মুসলমানদের ভালো মন্দ নানা বিষয় বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করত। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়কালে বিশেষ করে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসবার পর থেকে মিডিয়ার মূল ফোকাস চলে গেছে রাশিয়ার দিকে। রাশিয়ার উত্থান, এবং রাশিয়া, চীনের মৈত্রীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব উদ্বিগ্ন।

ইরাক, সিরিয়া থেকে আইএস নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, মিসরে জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসির নেতৃত্বে মুসলিম ব্রাদারহুডের চরম কোণঠাসা অবস্থান, লিবিয়াতে "ইসলামপন্থার" চরম বিরোধী "রুশপন্থী" জেনারেল খলিফা হাফতারের উত্থান, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে অনেকটাই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া— এর সব কিছুর ফলে পশ্চিমা বিশ্ব "ইসলাম ভিত্তিক" সন্ত্রাসবাদ বা  "ইসলামপন্থার" রাজনীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়। তাদেরকে যা উদ্বিগ্ন করে তুলছে সেটা হল বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়ার ক্রমশই প্রভাবশালী হয়ে উঠা।

এমতাবস্থায় "ইসলামপন্থার" রাজনীতি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবার জন্য বিশেষতঃ পাশ্চাত্যের নজরে থাকবার জন্য মরিয়া। "ইসলামপন্থার" রাজনীতি জাত আইএসের মত সংগঠনগুলোর এখনকার লক্ষ্যও তাই।

বস্তুতঃ এ লক্ষ্যেরই অংশ হল স্থানীয় "ইসলাম ভিত্তিক" সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর মাধ্যমে শ্রীলংকায় হামলা। শ্রীলংকার জনগোষ্ঠীর ৯.৭ শতাংশ হল মুসলমান। এদের মধ্যে বড় অংশ তামিল হলেও সেখানকার মুসলমানদের অনেকেই জাতিগত পরিচয়ের চেয়ে ধর্মীয় পরিচয় অর্থাৎ, মুসলমান পরিচয় দিতেই বেশি স্বাছন্দ্য বোধ করেন। এ থেকে একটা বিষয় পরিস্কার যে মুসলিম জাতিয়াতাবাদী চেতনার একটা প্রভাব শ্রীলংকার মুসলমানদের উপর রয়েছে।

অন্যান্য দেশের মত মুসলিম জাতীয়াতাবাদী চেতনার হাত ধরে সেখানেও জন্ম হয়েছে "ইসলামপন্থার" রাজনীতির, যা কিনা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যের মতই ক্রমান্বয়ে রুপান্তরিত হয়েছে "ইসলাম-ধর্ম ভিত্তিক" সন্ত্রাসবাদের রাজনীতিতে।

দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলংকার মূল সমস্যা ছিল সংখ্যাগুরু সিংহলী এবং সংখ্যালঘু তামিলদের মধ্যে জাতিগত সমস্যা। মুসলিমরা এ সংঘাত থেকে নিজেদের এড়িয়ে বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছিল। ফলে, মুসলমানদের একটা ভালো ইমেজ শ্রীলংকান সমাজে ছিল।

মুসলমানদের মাঝে "ইসলামপন্থা" এবং মুসলিম জাতীয়াতাবাদের রাজনীতি দানা বাঁধতে শুরু করলে এ সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে গত কয়েক বছর ধরে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের পাশাপাশি সংখ্যালঘু হিন্দু এবং খৃস্টানদের সাথে মুসলমানদের বিভিন্ন সময়ে উত্তেজনা, টেনশন, ছোটখাট সন্ত্রাসী হামলা, দাঙ্গা ইত্যাদির ঘটনা ঘটে। কিন্তু, এর পূর্বে এলটিটিই-এর মত করে শ্রীলংকার কোন মুসলমান অন্য ধর্মালম্বীদের উপর এরকম আত্মঘাতী হামলা চালায়নি।

মুসলিম সংখ্যালঘু দেশে "ইসলামভিত্তিক" রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা যখন হামলা চালায় তখন সেদেশে বসবাসকারী মুসলমানদের পরিণতি পরবর্তীতে কি হতে পারে সেটা তারা কখনো ভেবে দেখে না। ৯/১১ এর হামলার পর আমেরিকাতে সবচেয়ে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল সেখানে বসবাসকারী এক শতাংশ মুসলমানদের জীবন, যার জের এখনো তাঁরা ভোগ করছেন। তেমনি, এ হামলার পর আজকে শ্রীলংকাতে বসবাসকারী ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলমানদের অবস্থা সেখানে সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে কি হতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়।

উল্লেখ্য যে, "ইসলাম ভিত্তিক" রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা মুসলিম সংখ্যালঘু দেশে হামলা পরবর্তী তাঁদের পরিণতি নিয়ে যেমন ভাবে না, তেমনি মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে তাদের হামলার মূল টার্গেট হন মূলতঃ মুসলমানরাই। অর্থাৎ, তাদের দ্বারা উভয় জায়গাতেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মুসলমানরাই।

আবার, এ রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা যখন হামলা চালায় তখন তাদের এ কৃতকর্মকে আড়াল করবার জন্য সবচেয়ে আগে এগিয়ে আসে "ইসলামপন্থার" রাজনীতি এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা। তাঁরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জোর গলায় এ কৃতকর্মের পিছনে বহিস্থঃ শক্তি বা অমুসলিম রাষ্ট্রের— আমেরিকা, ইসরাইল, ভারত— ভূমিকা রয়েছে বলে প্রচার চালাতে থাকে, যাতে আসল সন্ত্রাসীদের বিষয়ে জনমনে নেতিবাচক ধারণা না জন্মে। পাশাপাশি, হিটলার, মুসোলিনী, স্তালিন, মাও প্রমুখের গণহত্যার বিষয়গুলি সামনে নিয়ে আসে এই যক্তিতে যে অন্য ধর্মের লোকেরা মুসলমানদের চেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করেছে। কিন্তু, সুকৌশলে যেটা এড়িয়ে যায়  সেটা হল, তাঁরা কেউ কোন ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করেননি বা মানুষ হত্যা করে কোন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতেও চান নাই, এ বিষয়টি। স্তালিন, মাও বরং তাঁদের নিজ নিজ দেশে ধর্মকে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিতে চেয়েছিলেন।

অপরদিকে, যে বিষয়গুলো বলা হয় না সেটা হল এক ইয়াহিয়া খান শুধু পাকিস্তান রক্ষা নয় "ইসলাম রক্ষার" কথা বলেও তিরিশ লাখ মানুষ হত্যা করেছিলেন, যাদের একটা বড় অংশই ছিলেন মুসলমান। ধর্মের নামে না হলেও এক সাদ্দাম হোসেন হত্যা করেছেন ১০ লাখ ইরানী মুসলমান। নিজ দেশে তিনি হত্যা করেছেন কয়েক লাখ শিয়া এবং কুর্দি সুন্নী মুসলমান। উল্লেখ করা হয় না, বর্তমান সময়ে সৌদি বোমায় নিহত ১২ সহস্রাধিক ইয়েমেনী মুসলমানের কথা।

"ইসলামপন্থার" এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতির সমস্যা হল যে তাঁরা অমুসলিম কর্তৃক মুসলিম নিপীড়িত হবার ব্যাপারে সোচ্চার হতে পারলেও মুসলমান কর্তৃক মুসলমানদের উপর নিপীড়ণ ঘটলে তাঁরা কোন ভূমিকা পালন করতে পারেন না, নিশ্চুপ থাকেন।

তবে, সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল, শুধু "ইসলামপন্থী" এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীরাই নন, সমাজের সবচেয়ে প্রাগ্রসর দাবীদার ক্ষুদ্র একটি অংশও সন্ত্রাসবাদ এবং "ইসলামপন্থার" রাজনীতির পক্ষে তত্ত্বগত সমর্থন যুগিয়ে চলেন। সমালোচকরা ব্যাঙ্গ করে এদের "বামাতি" ডাকেন।

উত্তর আধুনিকতাবাদ, উত্তর ঔপনিবেশিকবাদ, প্রাকৃতজন অধ্যয়ন তত্ত্ব, মার্কিন ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কি, স্লোভেনিয়ার দার্শনিক স্লাভজ জিজেক প্রমুখকে উদ্ধৃত করে তারা যেটা বলতে চান, সেটা হল এ সমস্ত হামলার পিছনে বহিস্থঃ শক্তি মানে,"সামাজ্যবাদী' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নিদেন পক্ষে ইসরাইল বা ভারত দায়ী। অর্থাৎ,"ইসলামপন্থা" এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদের সমর্থকদের মত একই যুক্তি তাঁরা দেন; তবে তা সারাসরি না বলে তত্ত্বের মোড়কে উপস্থাপন করেন।

এদের কাছে সমস্ত ন্যারাটিভ বা ভাষ্যের একই মানে। সন্ত্রাসবাদের রাজনীতি যিনি সমর্থন করেন এবং সন্ত্রাসবাদের যিনি বিরোধীতা করেন, দুই পক্ষই সমান, কেননা দুটি ন্যারেটিভই চাচ্ছে সমাজে তাদের ধারণার আধিপত্য বিস্তার করতে এবং অন্য ধারণাটিকে সমাজ থেকে উচ্ছেদ করতে। এ যুক্তিতে তাদের কাছে নাৎসিবাদ এবং কমিউনিজম, সাম্প্রদায়িক এবং আসাম্প্রদায়িক, "ইসলামপন্থা" এবং সেকুলার মতবাদ, মুসলিম জাতীয়তাবাদে এবং উদারনৈতিক রাজনীতির একই মানে; কারণ, সব মতবাদের লক্ষ্যই হচ্ছে নিজেদের চিন্তাকে রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠা করে বিরোধী মতবাদকে নির্মূল করা।

এ যুক্তিতে তাঁদের কাছে  "ইসলামপন্থা" এবং সেকুলার রাজনীতির একই মানে দাঁড়াবার কথা থাকলেও সেকুলার চিন্তা পাশ্চাত্য জাত বলে সেটিকে তাঁরা প্রত্যাখান করেন, যদিও তাঁরা বলতে অক্ষম যে, মুসলিম সংখ্যালঘু রাষ্ট্রসমূহ সেকুলার মতবাদ অনুসরণ না করে খৃস্টীয় মৌলবাদ, হিন্দুত্ববাদ ইত্যাদি অনুসরণ করলে সে সমস্ত রাষ্ট্রে মুসলমানদের স্বার্থ সরক্ষিত হবে কি ভাবে।

"বামাতিদের" মত বামপন্থীরাও এসব হামলার জন্য বহিস্থঃ শক্তিকে দায়ী করেন। তবে, তাঁদের আঙ্গুলি শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। মার্কসের "অর্থনৈতিক নির্ধারণ" তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত বামপন্থীরা সমাজ বিকাশে সংস্কৃতির সংঘাত বা আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব বুঝতে অক্ষম। দুটি ভিন্ন শ্রেণীর দ্বন্দ্বকে সব প্রেক্ষাপটেই সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির মূল নিয়ামিক মনে করায়, তাঁরা একদিকে যেমন "ইসলামপন্থার" রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বুঝত অক্ষম, তেমনি একই সাথে অনেক সময়ই তাঁরা এ রাজনীতির ক্ষেত্রও সচেতন বা অসচেতন ভাবে বিনির্মাণ করে চলেন।

এ সমস্ত ধারার বাইরে একটা বড় সংখ্যক মানুষ রয়েছেন যারা নিজেদেরকে "মডারেট,""উদারপন্থী, "খাঁটি" বা শুধু মুসলিম বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এরা মনে প্রাণেই সন্ত্রাসবাদের বিরোধীতা করেন,"ইসলামপন্থার" রাজনীতি মুসলমানদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রধান প্রতিবন্ধক মনে করেন। কিন্তু,ইসলামের নামে যখন সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়, তখন তাঁরা চুপ করে থাকেন।

মনোজাগতিকভাবে এরা ভীতু স্বভাবের। তাঁরা সব সময় এ  ভয়ে থাকেন যে তাঁরা যদি কোন মন্তব্য করেন বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভুমিকা পালন করেন তাহলে তাঁদের "ইসলামপন্থী" এবং মুসলিম জাতীয়াতাবাদীরা নাস্তিক, মুরতাদ, কাফের ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করবে। বস্তুত, এসবের ফলেই দেখা যাচ্ছে যে যখন কোন সন্ত্রাসবাদী হামলা হয় তখন প্রায় পুরো মুসলমান সম্প্রদায়ই চুপ থাকেন; যার ফলে অমুসলিমদের মাঝে এ ধারণা জন্ম লাভ করছে যে, এ সমস্ত হামলার পিছনে হয়ত কম বেশি সব মুসলমানেরই নীরব সমর্থন রয়েছে।

বিশ্ব রাজনীতিতে "ইসলামপন্থা" এবং তার উপজাত সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি এখন ক্রমশ প্রান্তের দিকে ধাবমান। শীতল যুদ্ধকালীন সময়ের মত পাশ্চাত্যের সাথে রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া তার পক্ষে আগামী দিনগুলোতে কার্যকর ভূমিকা পালন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ৯/১১ এবং এর পরবর্তী অভিজ্ঞতার পর পাশ্চাত্যের পক্ষেও রাশিয়া, চীনকে ঠেকাবার কথা বলে "ইসলামপন্থীদেরকে" রাশিয়া, চীনের বিরুদ্ধে আবার ব্যবহার করবার নীতি নেওয়াটাও অনেকটাই অসম্ভব।

এমতাবস্থায়,"ইসলামপন্থী"দলগুলোর অবস্থায়ও আজকের বাম দলগুলোর মত রাজনৈতিক ব্যবস্থার একেবারে প্রান্তে যেয়ে কোন রকমে টিকে থাকবার মত হবার সম্ভাবনাই বেশি। যার অনিবার্য প্রভাবে "ধর্ম-ভিত্তিক" সন্ত্রাসবাদীদের অবস্থাও এক সময়কার বাম সন্ত্রাসবাদীদের মত বিলীন হয়ে যাবে সেটা বলাই বাহুল্য। পাশ্চাত্য, মধ্যপ্রাচ্য, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এর আলামত ইতিমধ্যেই সুস্পষ্ট।