ভালোবেসে সাজায় যে মেয়েটি, তার জন্য আমরা কী করছি?

উপমা মাহবুবউপমা মাহবুব
Published : 27 April 2019, 01:37 PM
Updated : 27 April 2019, 01:37 PM

বিউটি পার্লার বিষয়ে বহুলপ্রচলিত ধারণা হলো সেখানে নারীরা যান শুধু সাজগোজ করতে। বয়স্করা সেখানে বয়স লুকোনোর জন্য নানাধরনের সার্ভিস নেন। তরুণীরা কড়া মেক আপ দিয়ে নিজেদের আসল চেহারাকে সাদা আবরণের আস্তরণে ঢেকে নেয়। বিষয়গুলো কোনও কোনও ক্ষেত্রে সঠিক হলেও সবারক্ষেত্রে তা মোটেই একই রকমভাবে প্রযোজ্য নয়। আমি পার্লারে যাই কেননা সেখানে কিছু তরুণী হাসিমুখে আমাকে স্বাগত জানায়। তারা যখন খুব যত্ন করে আমার চুলে প্যাক লাগায়, ম্যানিকিউর বা প্যাডিকিউর করে তখন মনে হয় আমার চুল-হাত-পা ধোঁয়া পানির সাথে অফিসের কাজের চাপ, ঘর-সংসারের টেনশন, অপর্যাপ্ত ঘুমের ক্লান্তি সব যেন ধুয়ে যাচ্ছে। পার্লার আমার জন্য তাই স্বস্তির একটা জায়গা।

শুধু আমি নই, বিউটিপার্লারের কর্মীদের যত্নমাখা হাতের জাদুতে কমে যায় ক্লান্ত নতুন মায়ের চোখের নিচের কালিমা। পার্লারের কর্মীরা তুলে দেন মাছ-মাংস-সবজি কাটতে কাটতে গৃহিনীর হাতের আঙ্গুলে বসে যাওয়া গাঢ় দাগ, সতেজ করে তোলেন কাপড় ধুতে ধুতে ক্ষয়ে যাওয়া নখ। পার্লারের নারী কর্মীদের মধুর ব্যবহারের কারণে অনেকে পান পারিবারিক অশান্তি বা নির্যাতন থেকে সাময়িক মুক্তি। পার্লারের মেঝেতে পরে থাকা চুলে, ফেসিয়ালে ব্যবহৃত প্যাকে, মেক আপ বক্সের তুলিতে তাই জমে থাকে অসংখ্য নারীর জীবনের গল্প। সেই গল্পগুলোকে আমাদের শরীর এবং মন থেকে মুছে দিয়ে সাময়িক সুখ দেয়, চেহারায় ঔজ্বল্য ফিরিয়ে এনে আত্মবিশ্বাস বাড়ায় পার্লারের নারী কর্মীরা।

অথচ পার্লারকর্মীদের সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? বাংলাদেশে নারীদের জন্য বিশেষ করে নিম্নবিত্ত নারীদের জন্য কাজের বড় একটা ক্ষেত্র বিউটি পার্লার। গারো সম্প্রদায়সহ অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের নারীদের জন্য সম্ভবত এটাই সবচেয়ে বড় কর্মক্ষেত্র। কিন্তু পার্লারের নারীকর্মীদের নিয়ে তেমন কোনও উন্নয়ন কাজ চোখে পরে না।। তাদের সমস্যা ও অধিকার নিয়ে কেউ লেখে না। পার্লারের নারী কর্মীদের নিয়ে তথ্য খোঁজার জন্য ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করার সময় বিষয়টা প্রকটভাবে চোখে পড়লো। তেমন কোনও তথ্যই সেখানে পেলাম না।

দু'একটা লেখা যা পেলাম তা থেকে জানতে পারলাম ১৯৬৫ সালে ঢাকায় বাংলাদেশের প্রথম পার্লার 'মে ফ্লাওয়ার' স্থাপন করেন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী একজন চাইনিজ নারী। পার্লারটিতে বাংলাদেশে বসবাসকারী কয়েকজন চাইনিজ নারী কাজ করতেন। কোন বাঙালি কর্মী ছিল না। 'মে ফ্লাওয়ার' পার্লার থেকে সেবা নিতেন বাংলাদেশে অবস্থানরত কিছু বিদেশীনি এবং কয়েকজন বাঙালি ফিল্মস্টার। সময় গড়ানোর সাথে সাথে বাঙালি নারীরা বিউটি পার্লার কনসেপ্টে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগলেন। 'মে ফ্লাওয়ার' এ একটু একটু করে বাঙালি মধ্যবিত্ত নারীদের আগমন শুরু হলো। চাহিদা তৈরি হওয়ায় চাইনিজ পার্লারকর্মীদের অনেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেরা পার্লার খুলে বসলেন। এ রকম একটা সময়ে ১৯৬৮ সালে মে ফ্লাওয়ারে কর্মী হিসেবে প্রথমবারের মতো একজন মান্দি বা গারো নারী যোগ দেন। তার নাম সারথী। তিনি ছিলেন মে ফ্লাওয়ার পার্লারের মালিকের চাইনিজ রেস্টুরেন্ট সাংহাই-এর বাঙালি রাঁধুনীর স্ত্রী। পরবর্তীতে সারথীর হাত ধরে প্রথমে তার আত্মীয়রা এবং পরে অন্য গারো নারীরা মে ফ্লাওয়ার পার্লারে যোগ দেন। আর এভাবেই আস্তে আস্তে বাংলাদেশের পার্লারগুলোতে আদিবাসী নারীদের কাজের বিরাট একটা ক্ষেত্র তৈরি হয় যা এখনো বজায় আছে।

কয়েকজন পার্লার কর্মীর সঙ্গে কথা বলে আমি জানতে পেরেছি পার্লারের কাজ শেখার দুটি উপায় আছে। প্রথমত, কোনও প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে বিউটিশিয়ানের প্রশিক্ষণ নেওয়া। দ্বিতীয়ত, কোনও পার্লারে শিক্ষানবিশ হিসেবে নামমাত্র বেতনে যোগ দেওয়া, তারপর পার্লারকর্মীদের সহকর্মী হিসেবে কাজ করতে করতে বিউটিশিয়ানের কাজ শিখে নেওয়া এবং এক সময় নিজেই পার্লারকর্মী হিসেবে নিয়মিত বেতনে কাজ শুরু করা। পার্লারকর্মীরা অধিকাংশক্ষেত্রে অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসে বিধায় তাদের মধ্যে দ্বিতীয় উপায়টিই বেশি জনপ্রিয়। এ কারণে ঢাকা শহরের যে কোনও পার্লারে গেলেই দেখা যাবে সেখানে কিশোরী বয়সী মেয়েরা ছোটখাটো কাজ করছে। এই কাজগুলো তাদের প্রশিক্ষণের একটি অংশ।

শুধু শহরাঞ্চল নয় বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এখন পার্লার রয়েছে। এই পার্লারগুলোর কর্মীদের জন্য শ্রম আইন কতটুকু প্রযোজ্য জানি না। তবে বিভিন্ন পার্লারে সেবা নিতে গিয়ে দেখেছি সেখানকার নারীকর্মীরা সকালে কাজে আসে রাতে বাড়ি ফেরে। বিভিন্ন উৎসবে আমাদের সাজাতে এই কর্মীরা হাসিমুখে অক্লান্ত পরিশ্রম করে। আমার পরিচিত অধিকাংশ পার্লারকর্মী এসেছে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। তাদের বয়স খুব কম। আর আদিবাসী হওয়ার কারণে যথেষ্ট সুন্দরীও বটে। অনিরাপদ শহরে এই মেয়েগুলো মেস করে থাকে। ঈদের ছুটিতে সবার শেষে বাড়ি যায়। পরিস্থিতিগত কারণে হয়ত তারা নানা ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তারপরও হাসিমুখে সেবা দিয়ে যায়। অন্যদিকে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে পার্লারকর্মীদের যে মধুর সম্পর্ক সেটা সম্ভবত আর কোন সার্ভিসেই দেখা যায় না। আমি অনেক নারীকে দেখেছি পার্লারে তিনি যে মেয়েটির কাছ থেকে নিয়মিত সার্ভিস নেন তার জন্য বিদেশ থেকে উপহার নিয়ে আসেন। অনেক ক্লায়েন্ট পার্লারের নারীকর্মীদের জীবনের ইতিবৃত্তান্ত সব জানেন, তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো গল্প করেন।

একবার একজন পার্লারকর্মীর কাছে রাত আটটায় পার্লার বন্ধ হয়ে যায় বলে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলাম, কেননা তখন ছিল রোজার মাস। তাকে বলেছিলাম ইফতারের পর পার্লারে যেতে পারলে আমার সুবিধা হয়। মেয়েটি করুণ গলায় বলেছিল – সারাদিন রোজা রেখে পরিশ্রম করার পর আপনারা কি আমাদের একটু বিশ্রামও নিতে দিবেন না? উত্তরটি শুনে খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। পার্লারকর্মীরা আমাকে যে ভালোবাসা এবং যত্নে মেশানো সার্ভিস দেয় তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ বোধ করি। তাদের সেবা আমার মনের ক্লান্তি দূর করে, আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সহায়তা করে। আমি চাই যে পার্লারকর্মীদের জীবনও তাদের ভালো, মমতাময় ব্যবহারের মতোই সুন্দর এবং নিরাপদ হোক। তারা তাদের প্রাপ্য মজুরি এবং সুযোগ-সুবিধা পাক। এ জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সকল পার্লারকর্মীর জন্য শুভ কামনা।