দুঃখিনী শ্রীলঙ্কা

আনিসুর রহমান
Published : 26 April 2019, 03:06 PM
Updated : 26 April 2019, 03:06 PM

নিজের গল্প দিয়েই শুরু করি। স্কুলে পড়ার সময়ে যখন বুঝে উঠিনি আসলে দেশ কী বা ভূগোল রাষ্ট্রের তাৎপর্য কী; বয়সটা অনেকটা মুখস্থটুকুই সার; তখন শৈশবে সমাজবিজ্ঞান এবং ভূগোল পাঠের অংশে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে পরিচয়। মনে আছে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার মানচিত্রকে আমরা ছোট সহপাঠিরা লাউয়ের সঙ্গে তুলনা করতাম। লাউ কল্পনা করে আমরা শ্রীলঙ্কার মানচিত্র আঁকার অনুশীলন করতাম।

দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (South Asian Association for Regional Cooperation) বা সংক্ষেপে সার্ক (SAARC) বিষয়ে পড়তে গিয়ে জানলাম দেশটা বাংলাদেশের চেয়েও ছোট। যে কোনও দেশ সম্পর্কে পড়তে গেলে নিজের অজান্তেই একটা বিষয় চলে আসে নিজ জন্মভূমি বাংলাদেশের তুলনায় দেশটা কেমন ছোট না বড়? উন্নত না অনুন্নত?

তথ্য উপাত্ত যতটুকু জেনেছিলাম দেশটাতে বাংলাদেশের মতো হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ আর মুসলমানসহ বহু মত ও পথের মানুষের বসবাস। বাংলাদেশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠে আর শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। বর্তমানে দেশটার জনসংখ্যার উপাত্তে দেখা যায় মোটামুটি ৭০ শতাংশ বৌদ্ধ, ১২ শতাংশ হিন্দু, ৭ শতাংশ খ্রিস্টান, ১০ শতাংশ মুসলমান আর ১ শতাংশ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। লোকসংখ্যা দুই কোটি ১২ লাখ। আয়তন ২৫ হাজার বর্গমাইল। এই হল আমার শৈশবের শ্রীলঙ্কার খানিকটা চিত্র।

আরও একটু বড় হয়ে জানলাম দেশটা আমাদের দেশের মতই দীর্ঘদিন ইউরোপীয় লুটেরা গোষ্ঠীর অধীনে উপনিবেশ ছিল। বিশেষ করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক জাঁতাকলে নাস্তানাবুদ হয়েছিল। সেই জাঁতাকল থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে। তারপর দেশটা স্বস্তি নিয়ে খুব একটা স্থিত হতে পারেনি। গৃহযুদ্ধ, তামিলদের সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধ। সে যুদ্ধের মাত্রা বেড়ে আর কমে চলে দীর্ঘ ২৬ বছর। এর মাঝে ভারতের হস্তক্ষেপ। তারপর আবার ভারতীয় সৈন্যদের শ্রীলঙ্কার মাটি থেকে সরাতে তামিল আর শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী একযোগে দ্বীপরাষ্ট্রটির ভূখণ্ড থেকে ভারতীয় সেনাদের বিতাড়িত করার এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। শ্রীলঙ্কার জমিনে রক্ত আর জল মিশেছে বারবার।

শ্রীলঙ্কা ঘিরে রাবণ কাহিনী আমরা অনেকে জানি। রাবণ ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণের অন্যতম প্রধান চরিত্র ও প্রধান খলনায়ক। তিনি মহাকাব্য ও পুরাণে বর্ণিত লঙ্কা (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা) দ্বীপের রাজা। রামচন্দ্রের পত্নী সীতাকে হরণ করে তিনি লঙ্কায় নিয়ে যান। সীতার উদ্ধার কল্পে কিঙ্কিন্ধ্যার বানরসেনার সাহায্যে রামচন্দ্র লঙ্কা আক্রমণ করলে রাবণের সঙ্গে তার যুদ্ধ হয়। এই ঘটনা রামায়ণ মহাকাব্যের মূল উপজীব্য। ওইটাকে শুরু ধরলে আজ পর্যন্ত লঙ্কার রক্তপাতের যেন শেষ নাই।

শ্রীলঙ্কার মাটিতেই প্রথম মানব আদমের আবির্ভাব। সেই আদম চূড়া ও আদম পিক এখন পর্যটকদের বড় আকর্ষণ। আদমের এই পদচিহ্নকে বৌদ্ধরা বলে 'শ্রীপদ' যা বুদ্ধের পবিত্র পদচিহ্ন, হিন্দুরা মনে করে শিবের পদচিহ্ন; খ্রিস্টান আর মুসলমানরা মনে করে তা আদমের পদচিহ্ন।

দেশটি সম্পর্কে এই আমার মোটাদাগের ধারণা। এর বাইরে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশটির বাতিকোলা শহরে অবস্থিত ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে এক সপ্তাহের জন্যে শ্রীলঙ্কা যাবার সুযোগ হয়েছিল। একই সঙ্গে জাফনা শহরে অবস্থিত জাফনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শন, বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী, শিক্ষক আর গবেষকদের সঙ্গেও মতবিনিময় করার সুযোগ হয়েছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ইতিহাস আর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বয়োজেষ্ঠ অধ্যাপক এস জি কৃষ্ণরাজন। তামিল ভাষা সাহিত্যের ডক্টরেট কবি এ আর তুরাজ, গবেষক জয়কান্থন ক্রিস্টি, অধ্যাপক জয়সঙ্কর সিভাগনানাম। এদের কথা উল্লেখ করছি কারণ এরা শ্রীলঙ্কার দীর্ঘমেয়াদী শান্তি আর তামিল জনগোষ্ঠীর স্বাধীকার ও আত্মপরিচয় রক্ষার স্বার্থে কিভাবে সংঘাতহীন সহমর্মিতার পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রেখে নিজেদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে সে বিষয়ে আমার সঙ্গে তারা আলাপ করছিলেন। তারা আমাদের ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এর প্রসঙ্গ টানছিলেন বারবার। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট।

আমিও আমাদের ইতিহাসের ঘটনা ও সূত্র উল্লেখ করে যতদূর পারি প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়ে গেলাম।
তার আগে কলম্বোর বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সড়ক পথে তামিল অধ্যুষিত জাফনা যেতে যেতে দুপাশের জনপদ মাঠ প্রান্তর আর মফস্বলীয় জীবন দেখে আমার কেবল মনে হচ্ছিল এ যে আমারই জন্মভূমি বাংলাদেশের মতন। জাফনা শহরের হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম আর খ্রিস্টানপ্রধান সকল এলাকা ঘুরে বাজার, অলিগলি, মহল্লা সব দেখে আমার মনে হচ্ছিল এ যে এক শান্তির জনপদ। অথচ এই জাফনাই গৃহযুদ্ধকালীন বারবার সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে।

জাফনা শহরের সমুদ্র উপকূলে ১৬১৮ সালে পর্তুগীজ সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দুর্গ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। আর এর ইতিহাস অধ্যাপক জয়সঙ্কর সিভাগনানাম এবং গবেষক ক্রিস্টির কাছে শুনে মনে পড়ছিল আমাদের ঔপনিবেশিক বিপদের কথা। তবে মন খারাপ হয়েছিল জাফনা গণগ্রন্থাগার পোড়ানোর গল্প শুনে। ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারটি ১৯৮১ সালে সংগঠিত সিনহালি জনতা আগুন, বুলেট, বোমায় সম্পূর্ণ গ্রন্থাগার পুড়িয়ে ফেলে। ওই সময় এই গ্রন্ধগারে বই আর পাণ্ডুলিপির সংখ্যা ছিল ৯৭ হাজার। ১৯৮২ সাল থেকে স্থানীয় জনগোষ্ঠী বিশেষ করে তামিলভাষীরা নিজস্ব উদ্যোগ ও জনগণের সহায়তায় গ্রন্থাগারটির পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া স্থানীয়রা অর্থ ও বই সংগ্রহ করে গ্রন্থাগারটি পুনরায় চালু করার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে। এ দুঃখের কাহিনী আর বাংলার দুঃখের গল্পে তফাৎ কিছু নাই। ধরায় বাংলাদেশের মতো শ্রীলঙ্কার বুকেও কত দুঃখ লয়।

জাফনা গ্রন্থাগারের ইতিহাস জেনে মনে পড়ে গেল বেলগ্রেড গ্রন্থাগারের ধ্বংসের কথা। ১৯৪১ সালে জার্মান বাহিনী এই শয়তানি কাণ্ডটি করে। বোমা ফেলে বেলগ্রেড গ্রন্থাগার ধ্বংস করে। জাফনা শহর থেকে তামিল অধ্যুষিত সড়ক পথে যাত্রায় প্রধান প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর পাশ দিয়ে বা ভেতর দিয়ে সড়কপথে তামিল অধ্যুষিত আরেক শহর বাতিকোলায় যাবার সুযোগ ঘটে গেল। যাবার পথে চেকপোস্ট তল্লাশি মোকাবিলা, মাঝে মাঝে গাড়ি থেকে নেমে যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ দেখা, সেসবের গল্প শোনা বা ছবি নেওয়া।

দেখলাম গাছে বুলেট ঢুকে আছে, দেয়ালে বুলেটের দাগ। জমিনে যুদ্ধের চিহ্ন। সেই সঙ্গে তামিল যোদ্ধাদের ফেলে যাওয়া ছাউনি, ঘর, ঝুপড়ি, আস্তানা। জিজ্ঞেস করলাম- তামিল যোদ্ধা যারা বেঁচে আছেন, আহত হয়ে আছে তাদের কী অবস্থা। তাদের কোন পুনর্বাসন বা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কি? উত্তর পেলাম, না তেমন কিছু হয়নি। দুই একটি বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে একটু আধটু সাহায্য করা হয়েছে, অনেক তামিল যোদ্ধা পঙ্গু বিকলাঙ্গ পীড়িত জীবনযাপন করছে। সেই সঙ্গে জানলাম সাধারণ তামিলদের মাঝেও বঞ্চনার ইতিহাস মনে দাগ কেটে আছে, হতাশা আছে। তবে সিনহালি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একসঙ্গে চলায় তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু সিনহালিদের দিক থেকে জনসংস্কৃতি জীবনে ও কর্মকাণ্ডে তেমন সারা নেই।

এরপর বাতিকোলা শহরে ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিক্ষক গবেষকদের পাশাপাশি নানা নৃগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে আলাপ আর মতবিনিময়ের সুযোগ হলো। বিশ্ববিদ্যালয়টি যদিও মূলত তামিল প্রধান, বেশিরভাগ তামিলভাষী ছাত্রশিক্ষক। তবে সিনহালি ভাষাভাষী ছাত্র ও শিক্ষক রয়েছে। সবচেয়ে চমৎকার লাগল ২১ ফ্রেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদযাপন। ওরা জাতীয় সঙ্গীত থেকে শুরু করে সকলে বক্তব্য তামিলে হলে সিনহালি ভাষায় তাৎক্ষণিক রূপান্তর করার ব্যবস্থা আর সিনহালি হলে তা তামিল ভাষায় রূপান্তরের সুযোগ রেখেছে।

এবার শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের একটু পেছন দিকে যাই। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়া গোষ্ঠীকে খেদিয়ে স্বাধীনতা লাভের পরে ১৯৭০ দশকে দেশটি সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করে। তা তিন দশকের গৃহযুদ্ধ আর রাজনৈতিক চড়াই উৎরাইয়ের পরও তা অনেক ক্ষেত্রে দারুণভাবে কার্যকর। বাতিকোলায় ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা, সেমিনার, আর ক্লাসের ফাঁকে চা কফি আর খাবারের সময় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম গোটা শ্রীলঙ্কার স্নাতক আর স্নাতকোত্তর পর্যন্ত প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রত্যেকেই প্রতিমাসে পাঁচ হাজার রুপি বৃত্তি পেয়ে থাকে। এরকম চমৎকার ব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোনও দেশে আছে কি না আমার জানা নাই।

সপ্তাহখানেক শ্রীলঙ্কায় থাকার সময় কলম্বো, জাকনা আর বাতিকোলার মানুষের সঙ্গে কথা বলে একটা জিনিস উপলদ্ধি করলাম কী তামিল, কী সিনহালি- কী হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান সকলেই দেশটিতে বিরাজমান স্থিতাবস্থায় খুশি। তারা আর পেছনের রক্তমাখা অতীতে ফিরে যেতে চায় না। যদিও রাজনৈতিক নেতাদের অদূরদর্শীতা ও স্বার্থসিদ্ধি, দেশি-বিদেশি নানা ফন্দিবাজদের বেসরকারিকরণ ব্যাবস্থার তোড়জোরে তারা অসন্তুষ্ট। বিশেষ করে চীনের দানবীয় বাণিজ্য গ্রাস, তাদের মাঝে কিছুটা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কারণ। শেষতক বাতিকোলা থেকে সড়ক পথে কলম্বো যাত্রাকালে ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাফাজ নামের তরুণ এক শিক্ষককে আমার সঙ্গে দিয়েছিলেন।

তিনি একজন সিনহালি ভাষাভাষী মুসলিম। আন্তর্জাতিক অনুবাদ বিভাগের ইংরেজি ও সিনহালি অনুবাদের বিষয়ে প্রভাষক। তিনি একই সঙ্গে একটা সিনহালি পত্রিকার খণ্ডকালীন সাংবাদিক। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শ্রীলঙ্কার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আদ্যেপ্রান্ত বলে চললেন। তার সব কথা শুনে মনে হয়েছিল অতীতের শত দুঃখের দুঃখী শ্রীলঙ্কার দুঃখ বুঝি শেষ। কিন্তু না! এ কী শোনা গেল! এ কী দেখা গেল? একদিনের সন্তাসী বোমা হামলায় গোটা দেশ পর্যুদস্ত। রাজধানী নাস্তানাবুদ। জনজীবন থমকে গেল। প্রাণ দিল পাঁচতারা হোটেল, আর গির্জায় প্রায় চার শত নিরাপরাধ নিরীহ মানুষ। ও যিশু তোমার পুনর্বার আবির্ভাবের দিনে এ কী হলো? ও গৌতম বুদ্ধ-এ কী হল? দুঃখিনী শ্রীলঙ্কার কী দুঃখের শেষ নাই?