নিউ জিল্যান্ড থেকে শ্রীলঙ্কা: উগ্রবাদের খুঁটিনাটি

হেলাল হোসেন ঢালী
Published : 25 April 2019, 11:59 AM
Updated : 25 April 2019, 11:59 AM

নিউ জিল্যান্ডের মসজিদে বন্দুকধারীর সন্ত্রাসী হামলায় অর্ধশতাধিক নিহত হওয়ার পয়ত্রিশ দিন পার হতে না হতেই শ্রীলঙ্কায় গির্জায় এবং আবাসিক হোটেলে ধারাবাহিক আত্মঘাতি বোমা হামলায় তিন শরও বেশি মানুষের প্রাণহানি বিশ্ববাসীকে ব্যাপক নাড়া দিয়েছে। এ ধরনের আদর্শভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী হামলার নজির ইতিপূর্বে আরও রয়েছে। গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্সের (জিটিআই) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ১০৬টি দেশ সন্ত্রাসবাদী হামলার শিকার হয়েছে। নিউ জিল্যান্ডে এবং শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলার পর গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্সের তালিকায় আরও দুটি দেশ যুক্ত হলো।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ইরাকের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল-আবাদি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, রাকা পতনের মধ্য দিয়ে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়ার (আইএসআইএস) পতন ঘটেছে। ওই  ঘোষণার বছর খানেক পর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও প্রায় একই ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন যে, যেহেতু আইএসআই এর পতন ঘটেছে, তাই সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। যারা আবাদি এবং ট্রাম্প এর ঘোষণা শুনে ধরে নিয়েছিলেন- বিশ্বে উগ্রবাদের দিন শেষ, তাদের কাছে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নিউজিল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কার  সহিংস উগ্রবাদে কিছুটা হলেও অপ্রত্যাশিত।

তবে বিশ্বজুড়ে উগ্রবাদের বর্তমান চিত্র, এর উত্থান এবং বিকাশের অগ্রপশ্চাৎ, এবং উগ্রবাদ দমন, নিয়ন্ত্রণ কিংবা প্রতিরোধের গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন তারা খুব ভালভাবেই জানেন যে, মানবজাতি সহসাই এর থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। মানবজাতি কেন এই উগ্রবাদের থাবা থেকে সহসা মুক্তি পাচ্ছেনা, উগ্রবাদের খুঁটিনাটি আলোচনার মাধ্যমে এ লেখার শেষ নাগাদ তা স্পষ্ট করার চেষ্টা করবো।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে উগ্রবাদের উত্থান, ধরন, আদর্শিক ভিত্তি, দমন ও নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া নিয়ে নানান বিতর্কের সারাংশ হচ্ছে –

অনেকেই ফরাসী বিপ্লবের সময়কাল থেকেই আধুনিক বিশ্বে উগ্রবাদের উত্থানকাল হিসেবে গণ্য করেন। উগ্রবাদী আন্দোলন পুরোপুরি বিকশিত হয় ঊনিবিংশ শতকের শুরুর দিকে ইউরোপে। এর মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শভিত্তিক উগ্রবাদ (যেমন: ইতালির বামপন্থি এবং ডানপন্থিদের উগ্রবাদী আচরণ), রাষ্ট্র পরিচালিত উগ্রবাদ (যেমন: জার্মানির হিটলারের একক আধিপত্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা ও দমন) সহ উগ্রবাদের নানা রূপ দেখা যায়।

ইসলাম ধর্মভিত্তিক ধর্মীয় উগ্রবাদের সূচনাও হয় গত শতকেই। ইসলামভিত্তিক উগ্রবাদের আনুষ্ঠানিক, সরব রূপ এবং ব্যাপকতা ফুটে ওঠে এই শতকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারে হামলার মধ্যদিয়ে। এরপর বিভিন্ন দেশে বিচ্ছিন্ন, সংগঠিত, আত্মঘাতি নানান রকম 'ইসলামভিত্তিক' সহিংস উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়ে। 'ইসলামভিত্তিক' উগ্রবাদী সন্ত্রাসী হামলার হাত থেকে সিনেমা হল, সাংস্কৃতিক মণ্ডল, ঈদগাহ, গণপরিবহন, ব্যক্তি কোনও কিছুই বাদ যায়নি।

কিন্তু টুইন টাওয়ারে হামলা, বিভিন্ন দেশে ইসলাম ভিত্তিক বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ও কর্মকাণ্ড, এবং পরবর্তিতে আই এস আই এস এর উত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বনেতারা এবং বিভিন্ন দেশে যে প্রতিক্রিয়া দেখান এবং যে ধরনের পদক্ষেপ নিতে থাকেন সবকিছু মিলে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদ আর ইসলাম একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। এর ফলস্বরূপ বিশ্বজুড়ে সাধারণ মুসলমানদের যে ক্ষতি হয় তা হলো – পশ্চিমা দেশগুলোতে ব্যাপকহারে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা কিংবা 'ইসলাম ভীতি' (ইসলামোফোবিয়া) সৃষ্টি হতে থাকে।

গত দুই দশকে কেবলই 'ইসলামভিত্তিক সন্ত্রাসবাদে'র প্রতি নজর দিতে গিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো শুধু সাধারণ মুসলমানদের জন্যই একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেনি, এর আড়ালে নিজেদের দেশেই বর্ণভিত্তিক উগ্রবাদের দানব সৃষ্টি করেছে। অ্যান্টি ডি-ফ্যামেনেশন লীগ (এডিএল) এর একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে- যুক্তরাষ্ট্রে গত এক দশকে ধর্মভিত্তিক সহিংস উগ্রবাদী হামলায় নিহতের সংখ্যার চেয়ে বর্ণভিত্তিক সহিংস উগ্রবাদী হামলায় নিহতের সংখ্যা তিনগুণ বেশি। বর্ণভিত্তিক উগ্রবাদ ছাড়াও জেন্ডার ভিত্তিক উগ্রবাদও বাসা বেঁধেছে অনেক দেশেই। গতবছর মে মাসেও কানাডার টরন্টোতে জেন্ডারভিত্তিক একটি উগ্রবাদী সংগঠন 'ইনসেল' বা (ইনভলান্টারি সেলিবেসি) এর আক্রমণে অন্তত দশ জন নিহত হয়েছে। সংগঠিত উগ্রবাদের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়েও সহিংস উগ্রবাদের বিকাশ ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে ব্যক্তি কোনও দল বা সংগঠনের সাথে যুক্ত না হয়েও নিজে নিজেই কোন আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিংবা নানামুখী বঞ্চনার শিকার হয়ে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষায় এদেরকে বলা হচ্ছে 'লোন উল্ভস'। এই 'লোন উল্ভসরা' কোনও ধরনের পূর্বাপর যোগাযোগ ছাড়াই কোনও নির্দিষ্ট ঘটনার আলোকে এক হয়ে সহিংস ঘটনা ঘটিয়ে থাকে।

শাসকগোষ্ঠী সমর্থিত বা রাষ্ট্র পরিচালিত উগ্রবাদের নজিরও কম নয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র পরিচালিত উগ্রবাদ যে কারণে চিহ্নিত করা যায় না তা হলো –  রাষ্ট্র যে সকল  উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তা আইনি বৈধতার আলোকেই করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, চীনের উইঘুরের মুসলমানদের ওপর চীন সরকারের শিক্ষা ও সচেতনতা ক্যাম্পের নামে নানামুখী অত্যাচার এবং নির্যাতন।

মুসলমানদের ওপর তাদের এই অত্যাচার বা নির্যাতন তারা বৈধ করে নিয়েছে এই বলে যে, সেখানকার মুসলমানরা যাতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়ে তার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে তারা এই শিক্ষা ও সচেতনতা ক্যাম্প পরিচালনা করছে । ফ্রান্স ও ইতোমধ্যে রাষ্ট্র পরিচালিত উগ্রবাদের পরিচয় দিয়েছে হিজাব বিরোধী আইন করে। কানাডার কুইবেকও 'সেক্যুলারিজম' এর নামে এমন একটি আইন করতে যাচ্ছে। সে আইনের সার কথা হচ্ছে – ধর্মীয় চিহ্ন আছে এমন কিছু পরিধান করলে শিক্ষকতা, আইন সহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু সরকারী চাকরি করা যাবে না। এই বিলের মাধ্যমে মূলত মুসলমান নারীদের হিজাব, শিখদের পাগড়ি এবং ইহুদীদের বিশেষ টুপি পরিধান না করার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রাষ্ট্রীয় উগ্রবাদের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে 'জাতীয়তাবাদ' কিংবা 'সেকুলারিজম'-কে সামনে রাখা হয়েছে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে – উগ্রবাদের ভিত্তি কেবল ধর্মীয় আদর্শই নয়; উগ্রবাদের আদর্শিক ভিত্তি ধর্ম ছাড়াও বর্ণ, জেন্ডার, জাতীয়তাবাদী চেতনা, রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক মতাদর্শও। আদর্শভিত্তিক এই বিভিন্ন উগ্রবাদের মদদদাতা কারা, কিংবা কেনইবা আদর্শভিত্তিক এই বিভাজন প্রকট হয়ে পড়ছে সেটা তাত্ত্বিক প্রশ্ন। এছাড়া, কাদের কাছে কারা উগ্র, কোন্‌ উগ্রবাদ ইতিবাচক, কোনটা নেতিবাচক ইত্যাদি নিয়েও রয়েছে নানান তাত্ত্বিক আলোচনা। বিশেষ করে ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে গান্ধী এবং সূর্যসেনের ভূমিকা, পশ্চিমে মার্টিন লুথার কিং এর অবস্থান ইত্যাদি উগ্রবাদ কিনা, উগ্রবাদ হলে তা ইতিবাচক না নেতিবাচক সে নিয়ে রয়েছে বিবিধ আলোচনা। সেই আলোচনা এই মতামত পাতার সংক্ষিপ্ত লেখায় তুলে ধরা কষ্টসাধ্য। সে চেষ্টা আরেকদিন করবো।

আপাতত প্রশ্ন হলো – উগ্রবাদ কী শুধু সহিংস প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ?

এ প্রশ্নের কারণ দুটি। এক. বেশিরভাগ দেশের উগ্রবাদ দমনের নীতি ও আইন উগ্রবাদের সহিংস প্রকাশকেন্দ্রীক (টেররিজম)। দুই. সোশ্যাল মিডিয়া সহ গণমাধ্যম সাধারণত সহিংস উগ্রবাদের (টেররিস্ট) কোনও ঘটনা ঘটার পরই সরব হয়ে ওঠে।

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কিছু দেশ সম্ভাব্য উগ্রবাদী সন্ত্রাসীর কিছু অসহিংস নির্দেশক চিহ্নিত করেছে। চিহ্নিত এই নির্দেশক সমূহ নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি একা থাকে, প্রেমে ব্যর্থ হয়, কোনও মুসলমান অধ্যুষিত দেশ ভ্রমণ করে, কিংবা হঠাৎ করে কেউ যদি দাড়ি রাখে, তাহলে উক্ত নির্দেশক অনুযায়ী সে সন্ত্রাসবাদের সম্ভাব্য ঝুঁকি তালিকায় পড়ে। এসবই সহিংস উগ্রবাদে যুক্ত হওয়ার সম্ভাব্য অসহিংস চিহ্ন। এই সম্ভাব্য অসহিংস চিহ্নের এই তালিকার কারণে অনেক সাধারণ মানুষ হয়রানির আশঙ্কা থেকে যায়। অথচ, যে অসহিংস উগ্রবাদের দিকে সবার নজর দেয়া জরুরি সেই অসহিংস উগ্রবাদ নিয়ে মাথাব্যাথা কমদেশেরই রয়েছে।

প্রশ্ন হলো – অসহিংস উগ্রবাদ কী? কেনই বা অসহিংস উগ্রবাদও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে জানা দরকার – উগ্রবাদ কী? উগ্রবাদের বিভিন্ন সংজ্ঞার সমন্বিত সারমর্ম হচ্ছে – উগ্রবাদ এমন একটি মানসিক অবস্থা যা নিজের আদর্শ ও বিশ্বাস (রাজনৈতিক, ধর্মীয়,বর্ণ কেন্দ্রিক, জেন্ডার ভিত্তিক) ছাড়া অন্য কোন আদর্শ ও বিশ্বাসের অস্তিত্ব ও সত্যতা অস্বীকার করে, ভিন্নমতাবলম্বীদের ঘৃণা করে, এবং নিজেদের আদর্শ ও বিশ্বাসের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অন্যান্য সকল আদর্শ ও বিশ্বাস ও তার অনুসারীদের নির্মূল করতে চায়।

উগ্রবাদের আদর্শিক ভিত্তি যেমন ভিন্ন হতে পারে, (যেমনটা একটু আগে ব্যাখ্যা করেছি) তেমনি এর প্রকাশও ভিন্ন হতে পারে। উগ্রবাদের প্রকাশ সবসময় সহিংস না হলেও চিন্তা-চেতনা এবং উদ্দেশ্য বিবেচনায় উগ্রবাদী হতে পারে। রোনাল্ড উইনট্রোব নামে একজন 'উগ্রবাদ' বিশেষজ্ঞের মতে, পদ্ধতিতে উগ্রবাদী না হলেও অনেকে উদ্দেশ্য বিবেচনায় উগ্রবাদী হতে পারে; অনেকে উদ্দেশ্যে বিবেচনায় উগ্রবাদী না হলেও পদ্ধতিতে উগ্রবাদী হতে পারে; কেউ কেউ পদ্ধতি এবং চিন্তায় দুদিকেই উগ্রবাদী হতে পারে।

বিশ্বব্যাপী নীতিনির্ধারকেরা এবং রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিরা সাধারণত পদ্ধতিগতভাবে যারা উগ্রবাদী তাদেরকে দমন করার ওপরই জোর দিচ্ছেন। এর ফলে, অনেকে ব্যক্তি পর্যায়ে এবং সাংগঠনিক পর্যায়ে উগ্রবাদী, আধিপত্যবাদী মনোভাব এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এদের কার্যক্রম সহিংস মনে না হলেও এরাই বিষবাষ্পের মতো সহিংসতার উপাদান যেখানে সেখানে ছড়িয়ে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের বেশকিছু ধর্মীয় বক্তা রয়েছে যারা প্রতিনিয়ত তাদের ওয়াজের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা, নারী বিদ্বেষ, এবং ঘৃণা ছড়িয়ে দিচ্ছে। সকল অনাচারকে শুধু পশ্চিমা আগ্রাসন হিসেবেই দেখছে এবং নিজেদের ভুল-ভ্রান্তিগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে। এসব ধর্মীয় বক্তা এবং এদের অনুসারীদের আপাতদৃষ্টিতে সহিংস মনে না হলেও এরা সহিংস উগ্রবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং অনেকেই তা গ্রহণ করছে। এতে করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি লঙ্ঘিত হচ্ছে, কর্মজীবী নারীর প্রতি বিদ্বেষ তৈরি হচ্ছে। এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি লঙ্ঘন এবং নারী বিদ্বেষী মনোভাবের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা যেমন বাড়ছে, বাড়ছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাও।

ইতোমধ্যে এর বেশকিছু প্রকাশ চোখে পড়েছে। অমুসলমান ও ভিন্ন মতাবলম্বী মুসলমানদের ওপর হামলা, নারী উন্নয়ণ নীতি বিরোধী আন্দোলন ঐধরণের উগ্র বক্তব্যের কারণে প্রভাবিত হয়েছে এতে কোনও সন্দেহ নেই। এছাড়া, বিভিন্ন জঙ্গি হামলায় আহত/নিহতের খবরের নিচে নানাবিধও ঘৃণাসূচক মন্তব্যসমূহও অসহিংস উগ্রবাদের প্রণিধানযোগ্য উদাহরণ।

অসহিংস উগ্রবাদের এই ধারা পশ্চিমা দেশগুলোতেও লক্ষ্য করা যায়। পশ্চিমা দেশগুলোর শিক্ষা কাঠামো, কৃষ্টি, এবং দৈনন্দিন চর্চায় অনেকক্ষেত্রেই বর্ণ বিদ্বেষী, মুসলিম বিদ্বেষী, শিখ ও ইহুদী বিদ্বেষী, অভিবাসী বিদ্বেষী এবং আধিপত্যবাদী জেন্ডারের সমর্থক। অনেক জায়গাতেই সাদা ছাড়া অন্য বর্ণের মানুষ, মুসলমান, শিখ, ইহুদী, অভিবাসীদের জন্য এবং আধিপত্যবাদী জেন্ডার ধারণার বাইরের লোকেদের জন্য একটা ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই ভিতিকর পরিবেশ সহিংস উগ্রবাদের কারণে সৃষ্টি হয়েছে, তা নয়। সাদা আধিপত্যবাদী  (হোয়াইট সুপ্রিমেসি) মনোভাব ধারণকারী অনেকে উপরে বর্ণিত বিভিন্ন অসহিংস পদ্ধতিতে এই ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সুতরাং উগ্রবাদ মোকাবেলায় সহিংস, অসহিংস, ধর্মীয়, বর্ণবাদী, জেন্ডার ভিত্তিক, ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক এবং রাষ্ট্র পরিচালিত সব ধারার এবং প্রকাশকেই গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কেননা, অনেকের মতেই এক ধারার উগ্রবাদ আরেকধারার উগ্রবাদের জন্ম দেয়।

উগ্রবাদের ভয়াল থাবা থেকে কেন আমাদের সহসা মুক্তি নেই সেই উত্তর পাওয়ার জন্য উগ্রবাদ মোকাবেলায় দেশ-বিদেশের গৃহীত কৌশলগুলো নিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা জরুরি। বেশিরভাগ দেশের উগ্রবাদ ব্যবস্থাপনা কৌশল হচ্ছে প্রতিক্রিয়াসুলভ (রিঅ্যাকটিভ) কৌশল। প্রতিরোধমূলক (প্রিভেন্টিভ) কৌশল খুবই সীমিত। অর্থাৎ কোনও সহিংস ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর কিংবা কোনও সহিংস ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা ধরা পড়লে কী ব্যবস্থা নেয়া যায়, বেশিরভাগ উগ্রবাদ ব্যবস্থাপনা কৌশলেই সেদিকটার ওপর আলোকপাত করা হয়।

উগ্রবাদ প্রতিরোধে (প্রিভেন্টিভ) অর্থাৎ উগ্রবাদ যাতে বেড়ে উঠতে না পারে, সে সংক্রান্ত পদক্ষেপ খুবই কম দেখা যায়।

দু-একটি ক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক (প্রিভেন্টিভ) ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে- যেসব সংগঠন বা আদর্শিক ভিত্তি দ্বারা উগ্রবাদে মানুষ প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেসব সংগঠন বা আদর্শের প্রচার বন্ধ করে দেওয়া। অর্থাৎ আকর্ষিক উপাদান (পুল ফ্যাক্টর), যেগুলো কাউকে উগ্রবাদের প্রতি আকর্ষণ করতে পারে, বন্ধ করার পদক্ষেপই নেয়া হয়। যেমন: সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া, তাদের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার বা ছোট-বড় সামরিক অভিযান ইত্যাদি।

ফলে অস্ত্রভিত্তিক এবং নিরাপত্তাকেন্দ্রিক আইনি এবং সামরিক পদক্ষেপের ওপর জোর দেওয়া হয়। এছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিতকরতে গিয়ে লোকবল নিয়োগ, নিরাপত্তা সরঞ্জমাদি কেনা (যেমন, মেটাল ডিটেক্টর, বডি স্ক্যানার, সিসি ক্যামেরা ইত্যাদি) বাবদ ব্যাপক অর্থও ব্যয় করা হয়।

এতেও খুব বেশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছেনা। বরং সরকারী দপ্তর, কূটনৈতিক পাড়া, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো নিরাপত্তা চাদরে ঢেকে ফেলার কারণে সহিংস উগ্রবাদীরা অনেক সাধারণ জায়গা- যেগুলো নিরাপত্তা বেষ্টনিতে ঘেরা থাকেনা যেমন, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, আবাসিক হোটেল ইত্যাদি জায়গায় হামলা করছে ।

তাই শুধু পুল ফ্যাক্টর, অস্ত্র  ও সরঞ্জাম নির্ভর পদক্ষেপ এবং নিরাপত্তার ওপর জোর না দিয়ে যে সকল আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি কাউকে উগ্রবাদের দিকে ঠেলে দিতে পারে (পুশ ফ্যাক্টর) যেমন, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কাঠামোগত বৈষম্য, আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনা ইত্যাদির দিকে নজর দেওয়া তা কমানোর মাধ্যমে সহিংস উগ্রবাদের ঝুঁকি কমিয়ে আনার দিকেও গুরুত্বারোপ করা জরুরি।

উগ্রবাদ বিষয়ক বহু গবেষকরা শুরু থেকেই দাবি করে আসছেন যে, উগ্রবাদ উত্থানের আর্থ-সামাজিক কারণ চিহ্নিত না করে, শুধু আকর্ষিক উপাদান (পুল ফ্যাক্টর) এবং সামরিক পদক্ষেপের ওপর গুরুত্বারোপ করে উগ্রবাদ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। 'শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে উগ্রবাদ প্রতিরোধ'  শীর্ষক কানাডার একটি গবেষকদলের সাথে বছর দুয়েক ধরে কাজ করার সুবাদে দেখছি – একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কিভাবে উগ্রবাদ বিকাশে এবং প্রতিরোধে অবদান রাখতে পারে।

একথা ঠিক জার্মানি, কানাডাসহ বেশ কিছু পশ্চিমা দেশ শিক্ষার মাধ্যমে কিভাবে উগ্রবাদ দূর করা যায় তার ওপর জোর দিচ্ছে। জার্মানির ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে তা হলো দেশটির পাঠ্যক্রম ও পাঠ্য বইয়ে উগ্রবাদ বিষয়টি আলোকপাত করেছে ঠিকই; কিন্তু তা অনেক ক্ষেত্রেই পক্ষপাতদুষ্ট এবং সেখানে উগ্রবাদের সাথে দু একটি নির্দিষ্ট আদর্শভিত্তিক এবং ধর্মভিত্তিক সংগঠনকে একাকার করে ফেলা হয়েছে। এছাড়াও বইগুলোতে প্রতিরোধমূলক (প্রিভেন্টিভ) ব্যবস্থাপনার চেয়ে প্রতিক্রিয়াসুলভ (রিএক্টিভ) আলোচনাই গুরুত্ব পেয়েছে।

তাই দেখা যাচ্ছে- একদিকে, শিক্ষার মাধ্যমে উগ্রবাদ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে দু-একটি দেশ উদ্যোগ নিলেও সেখানে উগ্রবাদের সামগ্রিক ধারণার অভাব রয়েছে; এছাড়াও উগ্রবাদের প্রেক্ষাপট কেন্দ্রিক সংজ্ঞায়নের ঘাটতিও রয়েছে।

পরিশেষে বলবো, উগ্রবাদ ব্যবস্থাপনায় শুধু নিরাপত্তাজনিত প্রতিক্রিয়াসুলভ সামরিক ব্যবস্থা এবং আকর্ষিক উপাদানের (পুল ফ্যাক্টর) ওপর জোর দিলেই হবে না। উগ্রবাদ যাতে বিকশিত না হতে পারে সেজন্য আগে ভাগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বিকশিত নিতে হবে। সেই ব্যবস্থা অস্ত্র নির্ভর ব্যবস্থা নয়, হতে হবে শিক্ষা ও সচেতনতামূলক ব্যবস্থা। এছাড়া উগ্রবাদের আর্থ-সামাজিক কারণ (পুশ ফ্যাক্টর), উগ্রবাদ বিকাশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, উগ্রবাদের সামগ্রিকতা এবং প্রেক্ষাপটের ওপরও জোর দেওয়া জরুরি। অন্যথায়, উগ্রবাদ থেকে মানব জাতি সহসা মুক্তি পাবে বলে মনে হয় না।