সন্ত্রাসবাদের ছোবল, রক্তাক্ত শ্রীলঙ্কা

মীর মোশাররফ হোসেনমীর মোশাররফ হোসেন
Published : 19 Dec 2011, 08:41 AM
Updated : 24 April 2019, 01:04 PM

প্রায় একইসময়ে ছয়টি বিস্ফোরণ। কয়েক ঘণ্টা পর আরও দুটি। বিভিন্ন স্থানে কেজি কেজি বিস্ফোরক পদার্থ মজুদ রাখা। নিরাপত্তারক্ষীদের ছুটতে হচ্ছে সেগুলো নিস্ক্রিয় করতে। এরই মধ্যে খবর আসছে হু হু করে বাড়তে থাকা লাশের সংখ্যার, আহত পাঁচ শরও বেশি।

শ্রীলঙ্কায় এ বছরের ইস্টার সানডে হাজির হয়েছে এমনই রক্তাক্ত রূপ নিয়ে।

কো-অর্ডিনেটেড বা সমন্বিত সন্ত্রাসবাদী হামলার চিত্র, তাও এত বড় স্কেলে- দক্ষিণ এশিয়ায় খুব একটা দেখা যায়নি আগে। নিকট অতীতে মুম্বাইয়ে হামলার কথা মনে করতে পারছি; বাংলাদেশেও হয়েছিল- ২০০৫ সালের অগাস্টে, দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা ফাটিয়েছিল জেএমবি।

উগ্রবাদী সংগঠনগুলো সাধারণত তাদের শক্তির জানান দিতেই এ ধরনের সমন্বিত হামলা চালায়। একসঙ্গে কয়েক জায়গায় হামলা করার মতো শক্তিশালী সংগঠন আছে- এটা বোঝানোর পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা এবং নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত সরকার ও অন্যান্য সংস্থার দক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এই কৌশল খুবই কার্যকর।

শ্রীলঙ্কায় হামলার লক্ষ্য হিসেবে ছিল এমন সব হোটেল, গির্জা ও জনসমাগমস্থল, ইস্টারের পরবে যেখানে দেশি-বিদেশিদের বড় ধরনের জমায়েত হওয়ার কথা। হয়েছিলও তাই।

উপাসনালয়ে হামলা, নিহতদের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ প্রায় ৩০টি দেশের নাগরিকের অবস্থান, পুরো শ্রীলঙ্কাকে আতঙ্কে রাখা- সব কিছুর মধ্যেই গত দুই দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে হওয়া 'সন্ত্রাসী হামলার' চিহ্নগুলোই ফুটে উঠেছিল।

প্রাথমিকভাবে 'ন্যাশনাল তওহিদ জামাত' নামে শ্রীলঙ্কান একটি সংগঠনের দিকে চোখ থাকলেও পরে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটই (আইএস) হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়। সংগঠন দুটির মধ্যে যোগাযোগ ছিল, এবং তারা একসঙ্গে 'নিউ জিল্যান্ডে দুটি মসজিদে বন্দুকধারীর নির্বিচারে গুলিবর্ষণে অর্ধশত মুসলিম হত্যার' বদলা নিতেই এ কাণ্ড ঘটিয়েছে বলে ধারণা করছে লঙ্কান সরকার।

৯/১১-র হামলার পর থেকে সমগ্র বিশ্বেই সন্ত্রাসবাদ এক নতুন প্রপঞ্চ নিয়ে হাজির হয়েছে। ওই হামলার সূত্র ধরেই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে নতুন রণকৌশল ও সমরসজ্জা নিয়ে হাজির হতে দেখেছি আমরা। এবং এসবের ধারাবাহিকতাতে বদলে যেতে দেখছি বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনৈতিক সম্পর্ক।

আফগানিস্তান, ইরাক-লিবিয়া-সিরিয়ায় সন্ত্রাসবাদ ‍রুখতে পেন্টাগন বছরের পর বছর যুদ্ধে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। তাদের এ কৌশল যে ব্যর্থ হয়েছে- সম্ভবত তা এখন বলাই যায়। ২০০১ সাল থেকে ওয়াশিংটন তাদের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী 'তালেবানদের' বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল; দেড় যুগ পরে এসে এখন সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা করছে, এত বছরেও তালেবানদের পরাজিত করতে পারেনি তাদের নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক সামরিক জোট।

ইরাকে-লিবিয়ায় আল-কায়েদা সন্ত্রাসীদের পরাজিত করতে গিয়ে ঘটনাপ্রবাহ উল্টো জন্ম দেয় এর চেয়েও বড় দানব ইসলামিক স্টেটকে। সিরিয়া ও ইরাকের একাংশ দখলে নিয়ে ওই ইসলামিক স্টেট 'খিলাফত' প্রতিষ্ঠা করে কয়েক বছর ধরে যে বর্বর রাজ্য কায়েম করে রেখেছিল, তার কথাও এখনো মানুষ ভোলেনি।

অবশ্য ওই খিলাফত এখন আর নেই; একদিকে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনী, অন্যদিকে রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া যৌথ আক্রমণ করে সেখান থেকে আইএসকে তাড়িয়েছে। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ বন্ধ হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের একের পর এক বিমান হামলার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে একের পর এক হামলা চালায় জঙ্গিরা। সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকা মহাদেশে আল-শাবাবের মতো জঙ্গি দলগুলোর বিস্তৃতি নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে। আইএস-আলকায়েদার মতো সংগঠনগুলোর অস্তিত্ব দেখা গেছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও। জঙ্গিবাদের ঝুঁকি থেকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো যে মোটেই বাইরে নয়, তার প্রমাণও বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে।

সিরিয়া থেকে পাততাড়ি ঘোটালেও আইএস যে বিশ্বজুড়ে আরও অশান্তির জন্ম দিতে পারে তা নিয়ে অনেকদিন ধরেই বলছেন বিশ্লেষকরা। প্রশিক্ষিত এ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে দেশে দেশে আতঙ্কের পরিবেশ আর নতুন অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের।

শ্রীলঙ্কার হামলা কি সন্ত্রাসবাদের এই 'নিউ নরমালের' বহিঃপ্রকাশ?

সন্ত্রাসবাদের রাজনীতি কি কেবলই 'সভ্যতার সংঘাত'- এমন প্রশ্নও উঠছে। এটা কি কেবল মুসলিম জঙ্গি সংগঠন বনাম পশ্চিমা দেশগুলোর লড়াই? সাধারণ মানুষ কি শুধু এ দুইপক্ষের দ্বারাই আক্রান্ত হচ্ছে? চিত্রটি আরও ব্যাপক-বিস্তৃত। এই রাজনীতি দেশে দেশে উগ্রপন্থার বিকাশে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। ইসলামোফোবিয়া, অভিবাসনবিরোধিতা বাড়ছে হু হু করে- যা পাশ্চাত্যের রাজনীতি ও তুলনামূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকেও নতুন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। বাড়ছে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ, কট্টর ডানপন্থা। নিরাপত্তার নামে রাষ্ট্রগুলো হয়ে উঠছে আরও নিপীড়ক; বাজার বাড়ছে নিত্যনতুন অস্ত্রের।

শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডেতে হওয়া হামলা নিয়েও নানামাত্রিক প্রশ্ন উঠে এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ার যে দেশে, মাত্র দশককাল আগেও তামিল বিদ্রোহীদের মোকাবেলায় সার্বক্ষণিক সেনা প্রস্তুতি ছিল, সে দেশ কীভাবে এত দ্রুত নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয় থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিল? হামলাকারীদের যে বিপুল প্রস্তুতি ছিল, তাতো দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। রাজধানী এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে কেজি কেজি বিস্ফোরক নিয়ে হামলা হলো এত এত গোয়েন্দা-নিরাপত্তারক্ষীদের চোখে ধুলা দিয়ে?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলমান আর বৌদ্ধদের কয়েক দফা দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া কি এ হামলার পেছনে শক্তি যুগিয়েছে? দাঙ্গার কারণে সৃষ্ট ক্ষত মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপগুলো কি কার্যকর ছিল? দেশটিতে গত কিছুদিন ধরে চলা ক্ষমতাকেন্দ্রিক রেষারেষি, নয়াদিল্লি-বেইজিংয়ের টানাপড়েনও কি জল ঘোলা করতে ভূমিকা রাখেনি?

এগুলোর কোনোটিরই সদুত্তর নেই। তবে এ হামলার পর দ্বীপরাষ্ট্রটিতে নিরাপত্তার ঘেরাটোপ যে আরও কঠোর হবে; রাষ্ট্র-সামরিকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ যে আরও বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাড়বে অবিশ্বাস, শঙ্কা, আতঙ্কের মাত্রাও।

বছর তিনেক আগে এক সেমিনারে অংশ নিতে কলম্বো গিয়েছিলাম। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো শহর যে এত সাজানো-গোছানো, এত পরিবেশবান্ধব, এত নিরাপদ হতে পারে, তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। এ অঞ্চলের সব শহরে যেহেতু পা পড়েনি, সুতরাং বলতে পারছি না- আর কোথায় কোথায় পথচারির পা জেব্রাক্রসিংয়ে পড়লেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই ক্রসিংয়ের দিকে আসতে থাকা গাড়িগুলো থেমে যায়! কোন দেশে রাত সাড়ে ১১টায়ও প্রায়ান্ধকার পার্কে অসংখ্য নারী-পুরুষ নির্ভয়ে শিশুসন্তানকে নিয়ে হেঁটে বেড়াতে পারেন? কিংবা রাত দুটোর সময়ও এক ট্যুরিস্ট টুকটুকে চেপে ভয়ডরহীনভাবে শহর ঘুরে দেখতে পারেন? সব মিলিয়ে কলম্বোকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।

উঁচু উচু সব ভবনের পাশে এত খোলা জায়গা, দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায়ও গিয়েছি, তুলনামূলক জনবহুল, কিন্তু খুবই আন্তরিক। সুন্দর সুন্দর সব প্যাগোডা, মসজিদ আর গির্জা যেন একসঙ্গে শহরটিকে ধরে রেখেছে। সেই কলম্বো যে কতখানি বদলে যাবে, এটা ভাবতেই কেমন বিষন্ন বোধ করছি।

ভৌগোলিক আর সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে ভরপুর এ দ্বীপদেশ যেন সন্ত্রাসবাদের ভয়াবহতা টপকে ফের বহুত্ববাদের শক্তিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, এটাই প্রত্যাশা।