চৈত্রের খরতাপে স্বস্তি শুধু বৈশাখে

বিনয় দত্ত
Published : 21 April 2019, 03:09 PM
Updated : 21 April 2019, 03:09 PM

১.

পহেলা বৈশাখ, বাঙালির সার্বজনীন উৎসব। এই সার্বজনীনতায় এমন, এইখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, দেশি, বিদেশি, গরীব, ধনী সকলেই সামিল হন। আরো সহজভাবে বলতে গেলে এটি একমাত্র উৎসব, যে উৎসবে সকল ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, গোত্রের লোক আসতে পারেন এবং এটি সকলেরই উদযাপনের উৎসব।

এই সার্বজনীনতায় অনেকেই এখন গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। খুঁজছেন ধর্মীয় রীতিনীতির উৎসমুখ। কোনটা পালন করা যাবে, কোনটা পালন করা যাবে না, কোনটা খাওয়া যাবে, কোনটা খাওয়া যাবে না, কোথায় যাওয়া যাবে, কোথায় যাওয়া যাবে না, কি পরিধান যাবে, কি পরিধান যাবে না এইটা নিয়ে একশ্রেণির ধর্মীয় গোষ্ঠী একের পর এক বিবৃতি দিচ্ছে এবং তা গণমাধ্যম ঢালাও করে প্রচার করছে। এতে করে জনমনে একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে।

পহেলা বৈশাখের বিভিন্ন আয়োজনের পিছনে আমাদের আদি সংস্কৃতি তথা বাঙালির মনন, সংস্কৃতির শিকড় জড়িয়ে আছে এইটা বোঝার মতো বোধ এবং বুদ্ধি নেই দেখেই ধর্মীয় গোষ্ঠীরা এইভাবে প্রহসনের বুলি আওড়াচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হল, কোনো কিছু বিচার না করে একশ্রেণির মানুষ তা অন্ধের মতো বিশ্বাস করছেন। এইটাই মূলত সমস্যা।

স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের মতপ্রকাশের শতভাগ অধিকার আছে, এই অধিকার আদায়ের জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি, নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা করেছি এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তি বিশ্বকে দেখিয়েছি। অদ্ভুত হলেও সত্যি, এই মতপ্রকাশ যারা বেশি বেশি করছেন তারা সবসময় নিজের সুযোগ এবং সুবিধা দেখে এবং বুঝে করছেন। অর্থাৎ নিজেদের অবস্থান শতভাগ শক্ত করে এরা বিভ্রান্তিকর বিবৃতি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিভিন্ন ধরনের মতবাদ, বিভিন্ন আদর্শের বিশ্বাস, বিভিন্ন ধারণায় যখন মানুষ ভাগ হয়ে পড়ছে তখন আমাদের দেশের ধর্মীয় গোষ্ঠীরা বার বার তাদের মতবাদ জোর করে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এই চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা যে একধরনের অপরাধ তা কারো মাথায় ঢুকছে না। বার বার তাদের মতবাদের বাইরে ভিন্ন কিছু করলেই তাদের আঁতে ঘা লাগছে। আর তখনই তাদের স্বরূপ প্রকাশ পাচ্ছে।

২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল। রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলছিল। সেদিন শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে নিরীহ কিছু মানুষ আহত হয় এবং নিহত হয়। এই প্রাণহানির পর সবার মধ্যে একধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তাই চেয়েছে যেন সকলের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু তারা সফল হয়নি। ২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে নারী লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। এইবারও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী একই চাওয়া যাতে নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে। কিন্তু এইবারও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর চাওয়া সফল হয়নি।

২.

প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সারা দেশে কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়িক লেনদেন হয়। কারণ, এই উৎসবকে কেন্দ্র করে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা উত্তোলন বেড়ে যায়। পোশাক, কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়া, ঘোরাঘুরি ও ঘরের অন্যান্য জিনিস ক্রয়ের চাহিদা বাড়ে। এককথায় পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে সরকারি চাকরিজীবীদের বৈশাখী ভাতা প্রদান।

দেশের মানুষের পোশাকের জোগান দেওয়ার জন্য পুরান ঢাকা, কেরানীগঞ্জ, কালীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুদ্র-মাঝারি কারখানা গড়ে উঠেছে। এ ধরনের ছয় হাজার কারখানার সংগঠন অভ্যন্তরীণ পোশাক প্রস্তুতকারক মালিক সমিতি। তাদের হিসাব অনুযায়ী, পয়লা বৈশাখে সারা দেশে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হয়। ধারণা করা হয়, সারা বছর যে ব্যবসা হয় তার ৫০ শতাংশ হয় রোজার ঈদে এবং ২৫ শতাংশ হয় পহেলা বৈশাখে।

যেখানে একটি উৎসবের সাথে অনেকের ভাগ্য-ব্যবসা জড়িত সেখানে কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী যদি ফতোয়া দেয় পহেলা বৈশাখে কেনাকাটা করা হারাম কেউ শুনবে? আপনাদের কি মনে হয়? আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি আপনি কি শুনবেন? আমার ধারণা আপনি নিজেও শুনবেন না।

সৃষ্টির শুরু থেকে একধরনের বিরোধী শক্তি বা বিরোধী গোষ্ঠী সবসময় কাজ করেছে। তারা কখনো সক্রিয়, কখনো নিষ্ক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। কেউ তাদের কথা শুনেছে, কেউ শোনেনি। এইসব বিরোধী গোষ্ঠীর জন্য যে ঐতিহ্য যুগের যুগের পর চলে এসেছে তা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাবে? যে বিশ্বাসের সাথে আমাদের সংস্কৃতির শিকড় জড়িয়ে আছে তা কি মুছে যাবে? আমার মনে হয় না।

৩.

রমনার বটমূলের অনুষ্ঠান শেষ হয় সংগঠনের সভাপতি সন্‌জীদা খাতুনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। এইটা একটা অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। এইবার তিনি তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, 'বৎসরকাল পেরিয়ে আমরা আবার নতুন দিনের মুখোমুখি। কেমন সময় পেরিয়ে এলাম? চোখ মেললে কিংবা কান পাতলে নিত্যই শিশু-নারী, বল-ভরসাহীন মানুষ তথা সমগ্র মানবতার ওপরে নির্মম আচরণের সংবাদ পাই। নিয়ত মার খাচ্ছে সমাজের ধারণা। কোথায় যাচ্ছি আমরা? নিষ্কলুষ শিশুসন্তান অত্যাচারের শিকার হয় কী করে? সমাজ কি পিতামাতা, ভাইবোন, সন্তানসন্ততির গৃহ আর প্রতিবেশী নিয়ে গঠিত শান্তির নিবাস নয়? স্বার্থান্বেষী অমানুষদের আত্মসুখ সন্ধানের ফলে নির্যাতনের হাত থেকে পরিত্রাণ পায় না কচিকাঁচা থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সমাজের কোনও মানুষ।'

এই হচ্ছে ছায়ানট। যে আন্দোলন সংগ্রাম, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের মধ্যে ছায়ানটের জন্ম এবং যাত্রা, সেই ছায়ানটের সভাপতি পয়লা বৈশাখের দিন গোটা দেশের চিত্র তুলে ধরেছেন তার বক্তব্যে। বাংলা বছরের প্রথমদিন, হাসি-আনন্দে পাড় করে দেয়া যেত, ভালো ভালো কথা শোনানো যেত কিন্তু তা হয়নি। ছায়ানট তার ঐতিহ্যানুযায়ী দেশের চালচিত্র সকলের সামনে তুলে ধরেছেন। এইবার ছায়ানটের আয়োজনের প্রতিপাদ্য ছিল 'অনাচারের বিরুদ্ধে জাগ্রত হোক শুভবোধ'।

আমি প্রায় একদশক ধরে বটমূলে উপস্থিত থেকে নিয়মিত ছায়ানটের অনুষ্ঠান দেখি। অনুষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য অংশ মনে হয়েছে সভাপতির বক্তব্য এবং গান-কবিতার নির্বাচন। যে সময় দেশের পরিস্থিতি যেই রকম তখন সেইভাবে গান ও কবিতার তালিকা সাজানো হয় এবং সংগঠনের সভাপতি তার বক্তব্য তা তুলে ধরেন। এ যেন অন্যরকম প্রতিবাদ।

তিনি বলেন, "অন্তরে ইচ্ছা জাগুক, 'ওরা অপরাধ করে' কেবল এই কথা না বলে, প্রত্যেকে নিজেকে বিশুদ্ধ করার চেষ্টা করি। আর আমরা যেন নীতিবিহীন অন্যায়-অত্যাচারের নীরব দর্শকমাত্র হয়ে না থাকি। প্রতিবাদে, প্রতিকার সন্ধানে হতে পারি অবিচল। নববর্ষ এমন বার্তাই সঞ্চার করুক আমাদের অন্তরে।"

নিজের মধ্যে শুদ্ধতা জাগিয়ে তুলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধে মুখর হওয়ার আহবান জানান বিনম্রভাবে। আমরা যেন অন্যায় দেখে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন না করি এই জন্য তিনি তার বক্তব্যে সুস্পষ্ট ধারণা দেন।

বক্তব্যের এক অংশে তিনি বলেন, 'আমরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করব, আমাদের ক্ষোভ জানাবো, প্রতিবাদ জানাবো অনাচারের বিরুদ্ধে।…নুসরাত জাহান, তনু, সাগর-রুনি, মিতু…যেসমস্ত বিষয়ে আমরা আজ পর্যন্ত কোনো খবর পেলাম না বিচারের, সেসব বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং বিগত প্রাণগুলোর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে থাকব।'

দেশের অনেক বড় বড় মহারথীরা সংকটের সময়ে মুখ খুলেন না, কথা বলেন না, প্রতিবাদ করেন না। কিন্তু এর থেকে ব্যতিক্রম হল ছায়ানট। কি চমৎকারভাবে দেশের অন্যতম প্রধান সংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট দেশে যে বিচারহীনতা চলছে তা তুলে ধরেছেন।

৪.

"স্বার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে
স্বার্থক জনম, মা গো, তোমায় ভালোবেসে।।"

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই দুই লাইন আমি যখনই পড়ি, তখনই আমার দেশমাতৃকাকে নতুন করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, দেশের অপশক্তি, কুসংস্কার, অন্ধকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে ইচ্ছে করে। কত সুন্দর আমাদের এই দেশ, কত উৎসবমুখরতায় ভরপুর আমাদের তরুণ প্রাণ, কত বিচিত্র সম্ভাবনা আমাদের নবাগত শিশুদের মধ্যে। যে জায়গায় এতোকিছু সেই জায়গায় অন্ধকার জগতের বাসিন্দারা কি বললো তা আমাদের শোনারই দরকার নেই।

চৈত্রের খরতাপে স্বস্তি শুধু পয়লা বৈশাখের আনন্দে, স্বস্তি নিজেদের শিকড়ের শক্তিতে ফিরে যাওয়ার মাঝে, কুসংস্কারকে হটিয়ে সংস্কৃতির মেলবন্ধনে সামিল হওয়ার মাঝে। আমি মনে করি একজন মানুষের প্রথমে মানুষ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠাটা, মানবিক গুণসম্পন্ন, বোধের শক্তিতে জাগরিত হওয়া সবচেয়ে জরুরী। এই পরিচয়ের পর তারপর তার জাতীয় পরিচয় এবং সর্বশেষ ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত হওয়া উচিত।

যারা মানবিক গুণ বাদ দিয়ে, নিজের জাতীয় পরিচয় পিছনে ফেলে ধর্মীয় পরিচয় সামনে নিয়ে এসেছে তাদের জন্য করুণা ছাড়া আর কিছুই হয় না। যার মধ্যে মানবিক গুণ নেই, যে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছে সে আর যাই হোক বড় ধার্মিক হতে পারবে না। তাই আমাদের সকলের উচিত আগে মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠা, এরপর বাঙালি পরিচয়ে পরিচিত হয়ে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে ভালোবাসা, এরপর ধর্মীয়ভাবে শুদ্ধাচার গ্রহণ করা। মুনাফালোভী, স্বার্থপর, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মীয় বক্তার বক্তব্য শোনার চেয়ে জেনে বুঝে নিজের বুদ্ধিতে পথচলা ভালো।