নুসরাত, বোন আমার ভাল থেক পরপারে

Published : 17 April 2019, 11:41 AM
Updated : 17 April 2019, 11:41 AM

ফেনীর সোনাগাজী পৌরসভায় এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার্থী ছিল নুসরাত। তার পুরো নাম নুসরাত জাহান রাফি। গত পয়লা এপ্রিল থেকে দেশব্যাপী শুরু হওয়া এইচএসসি ও সমমানের চলমান পরীক্ষার দুইটিতে অংশ নিচ্ছিল নুসরাত। তৃতীয় পরীক্ষাটি দিতে গিয়েও আর দেওয়া হলো না তার। কারণ সেদিন জীবনের সবথেকে কঠিন পরীক্ষা এবং সংকটে পড়ে যায় নুসরাত।

তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ণের অভিযোগ তুলেছিল নুসরাত। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল নুসরাতের পরিবার। এই মামলায় গ্রেপ্তারও হন অভিযুক্ত সেই অধ্যক্ষ। কিন্তু মামলা করার পর থেকে বিভিন্ন হুমকি-ধমকির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে নুসরাত এবং তার পরিবারকে।

গত ৬ এপ্রিল পরীক্ষা দিতে যথারীতি ভাইয়ের সাথে পরীক্ষা কেন্দ্রে যায় নুসরাত। কে জানতো যে এটা তার জীবনের শেষ পরীক্ষা ছিল! পরীক্ষা শুরুর আগে তার পরিচিত আরেক ছাত্রী মিথ্যা খবর দিয়ে তাকে কৌশলে প্রতিষ্ঠানের ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখা গেল ভিন্নচিত্র। নুসরাতের মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে পরিচয় আড়াল করে অপেক্ষা করছিল তারা চারজন। তারা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ এর নামে করা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য নুসরাতকে চাপ দিতে থাকে। নুসরাত তাতে রাজী হয়নি।একপর্যায়ে তারা নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়। ওই আগুনে শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যায় নুসরাতের। প্রতিহিংসার আগুনে দগ্ধ নুসরাতকে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ফেনী সদর হাসাপাতালে এবং পরে ওই দিনেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

শারীরিক অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাওয়ায় ৮ এপ্রিল, সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নুসরাতকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। শারীরিক অবস্থা এতটা নাজুক হয়ে পড়েছিল যে, সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা নুসরাতকে এই অবস্থায় সিঙ্গাপুরে না নেওয়ার পরামর্শ দেন।

জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে ঝুলতে থাকে নুসরাত। অবশেষে গত ১০ এপ্রিল বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন মারা যায় নুসরাত। এভাবে শেষ হয় ১৮ বছর বয়সী একটি প্রতিবাদী জীবনের বেঁচে থাকার ১০৮ ঘন্টার লড়াই।

এই ভয়টা-ই পাচ্ছিলেন দেশবাসী। সাহসিকা নুসরাত হেরে যাবে না তো! নুসরাত মৃত্যুর কাছে ঠিকই হেরে গেল।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভয় বার্তা নিয়ে বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া ৮ এপ্রিল বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে নুসরাতকে দেখতে যান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া সেদিন সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী নুসরাতকে সিঙ্গাপুরে পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছেন। নুসরাত যাতে সর্বোচ্চ চিকিৎসাটা পায় তার জন্য খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশ দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপর নুসরাতের অগাধ ভরসা ছিল। ভরসা ছিল দেশের মানুষের উপর। ৮০ শতাংশ পোড়া শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে থেমে থেমে দম নিয়ে নুসরাত বার বার বলেছিল, 'আমি সারা বাংলাদেশের কাছে বলব, প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলব, সারা দুনিয়ার কাছে বলব, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করব।' নুসরাত, তোমার এই দৃঢ় আত্মবিশ্বাস এবং ভরসা বৃথা যায়নি। তোমার কথা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের মানুষের কাছে, সারা দুনিয়ার কাছে পৌঁছে গেছে।

সেদিন থানায় তোমাকে যারা বলেছিল, তোমার কথা কেউ লিখবেনা; তারা সেদিন মিথ্যা কথা বলে তোমাকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিল। নয়তো দেশের মানুষের প্রতি তাদের ভরসা ছিলনা। তারা যে ভুল ছিল সেটা দেশের মানুষ তাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। টানা ১০৮ ঘণ্টা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে তোমার বীরোচিত মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তোমার সকল যন্ত্রণা শেষ হয়েছে। এখন ওইসব কাপুরুষদের যন্ত্রণা সবেমাত্র শুরু হয়েছে।

আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন এবং প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর নুসরাতের মৃত্যুর কাছে হারলেও অন্যায়ের কাছে মোটেও হারেনি। নির্দয় হামলার শিকার নুসরাতের এই করুণ মৃত্যু দেশবাসীকে ভীষণ নাড়া দিয়েছে। নুসরাতের এই যন্ত্রণায় দলমত, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কাতর হয়েছেন সবাই। সবার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে।

আমাদের মেয়েরা, বোনেরা যানবাহনে, রাস্তায়, অনুষ্ঠানে কিংবা বিভিন্ন জায়গায় পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। এটা এখন নিত্য-নৈর্মিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু কোনো ছাত্রী যখন খোদ তার চিরচেনা এবং ভরসাস্থল শিক্ষকের হাতে তারই শিক্ষালয়ে শ্লীলতাহানির শিকার হয় তখন এটা কোনো সাধারণ ঘটনায় থাকেনা। এটা ভয়ংকর এক ব্যাপার। আবার সেই অপরাধের প্রতিবাদ করলে গায়ে কোরোসিন ঢেলে আগুনে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার ধৃষ্টতা রাষ্ট্র এবং সমাজকে কি বার্তা দিয়ে যায়? নুসরাতকে নৃশংস কায়দায় পুড়িয়ে মারার এ ঘটনা মানুষের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এমন ঘটনা কারো জীবনে যাতে না ঘটে এই প্রার্থনাই করি।

এই নৃশংস ঘটনার পর থেকে আমার বার বার মনে হচ্ছিল নুসরাতের জায়গায় আমার স্নেহের ছাত্রী তাসপিয়া, খাইরুনেচ্ছা, সালমা, মোহচ্ছেনা, তসলিমা, জেসমিন, ইয়াছমিনদের মধ্যে যে কেউ হতে পারত। একথা ভাবতেই ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠে।

আমার বিস্ময় লাগছে এই যে, নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার জন্য পরিকল্পিত এই 'কিলিং মিশন'-এ যে চারজন সরাসরি অংশগ্রহণ করে তাদের অন্তত দুইজন মেয়ে বলে নুসরাত জবানবন্দী দিয়েছে। অপরদিকে প্রকৃত ঘটনার জানার পরও আর কিছু নারী রাস্তায় নেমে নুসরাতের বিপক্ষে মিছিল করলো! মমতার আরেক রূপ এবং কোমলতাই যাদের স্বভাব সেই মেয়ে, সেই নারী, সেই বোন, সেই মা কিভাবে এবং কেন এতটা পাষাণ এবং নির্দয়তার দিকে এগোচ্ছে?

নুসরাত আমৃত্যু প্রতিবাদ করে যাবে বলেছিল। সে তার কথা রেখেছে। কিন্তু রাষ্ট্র তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করবে তো! তার অসমাপ্ত লড়াই রাষ্ট্র সম্পূর্ণ করবে তো! চট্রগ্রামের মিতু এবং কুমিল্লার তনু হত্যাকাণ্ডের মতো সময়ে এই ঘটনাও হারিয়ে যাবে না তো! এই ঘটনার চূড়ান্ত পরিণতি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মতো যেন না হয়। আশংকা হয়, বড্ড আশংকা হয়। তবুও আস্থা রাখতে চাই রাষ্ট্রের উপর, আস্থা রাখতে চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপর। আমি কাউকে দোষারূপ করতে চাই না। তবে বলছি যে, কেবল ফেইসবুক কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় বইয়ে দেওয়াটা যথেষ্ট নয়। এ প্রতিবাদের ঝড় প্রবল বেগে আঁছড়ে পড়ুক দেশের প্রতিটি প্রান্তে, রাজপথে। এ ঘটনার ন্যায্য বিচার নিয়েই যেন নুসরাতের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো প্রতিবাদী এবং বিবেকবান মানুষগুলো ঘরে ফিরে। হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আপনাদের সাথে সমগ্র দেশবাসী আছেন।

একথাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই জঘন্য ঘটনা যারা ঘটিয়েছে দায়টা কেবল তাদের উপর বর্তাবে। তাদের কুকর্মের দায় ঢালাওভাবে সমগোত্রীয়, সমপেশার এবং সমপ্রতিষ্ঠানের সকলের উপর বর্তায় না। তবে মানুষ হিসেবে আমাদের সকলের কর্তব্য থেকে যায়।

নুসরাত কোনও দুর্বল চিত্তের মেয়ে নয়। নুসরাত এখন অসংখ্য মেয়ে যারা তার মতো প্রতিনিয়ত ঘটনার শিকার হচ্ছে তাদের কাছে এক জলন্ত দৃষ্টান্ত এবং প্রেরণার বাতিঘর হতে পারে।

এই ঘটনা সহজে দাগ কাটবেনা।এই ঘটনা সহসা ভুলে যাওয়ার নয়। নুসরাত, বোন আমার ভাল থেকো পরপারে। তোমার সদগতি কামনা করি।