ভালো নেই মুজিবনগরের ঐতিহাসিক আমবাগান

ফেরদৌসী বেগম
Published : 17 April 2019, 08:25 AM
Updated : 17 April 2019, 08:25 AM

১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর তথা বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীন সরকারের শপথ নেওয়ার দিন। ৪৭ বছর আগে, ১৯৭১ সালের এই দিনে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী হয়।

আমার বয়স তখন নয় বছর। ঘর অন্ধকার করে ডাইনিং টেবিল এর তলায় বসে  স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র শুনতাম। সেই রেডিওতেই প্রথম ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের কথা জানতে পারি।

দীর্ঘ এত বছর পরও আম্রকানন, বৈদ্যনাথতলা, বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগর আমার কাছে হয়ে আছে এক স্বপ্নের, পবিত্র স্থান।

২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে আমি হঠাৎ করেই এক বিকেলে মেহেরপুরের মুজিবনগর আম্রতলায় ওই শপথ অনুষ্ঠানের স্থানে একা চলে যাই। সেই অনুভূতির কথা আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। তবে যুদ্ধে চাচাকে হারানোর ব্যাথা নিয়ে যখন আমগাছগুলোর দিকে তাকাই তখন মনে হচ্ছিল, এই আমগাছগুলোও শহীদ হয়ে যাচ্ছিল। মৃতপ্রায় আমগাছগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে আমার চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলাম না। ৭১ এর ১৭ এপ্রিল শপথ অনুষ্ঠানে থাকা এই আমতলার প্রত্যেকটি আমগাছ  আমাদের স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকারকে ছায়া দিয়ে, লুকিয়ে রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের মতো পাহারা দিয়েছে।

আমার মতে, এক-একটি আম গাছ এক একজন মুক্তিযোদ্ধা। এখানে যে ১১০৭টি আমগাছ আছে তা এক একটি স্মৃতিফলক। তবে এ স্মৃতিফলকগুলি প্রাণহীন নয়। এদের বাঁচিয়ে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। পৃথিবীর বহু দেশে ঐতিহাসিক এবং পুরনো গাছ সংরক্ষণ এর আইন আছে। আমি এখানে একটি হংকং এর আইন এর কথা উল্লেখ করতে পারি। আমার কাছে মনে হয়, ১১০৭ অর্থ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর এবং ৭ মার্চ এর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের দিন। আমি আশা করব, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে এ আমগাছগুলো মুকুলে মুকুলে সু-সজ্জিত হয়ে আবার আনন্দ হাসিতে মেতে উঠবে। আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে আমি বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতার শপথ অনুষ্ঠানের স্থল 'বৈদ্যনাথতলা', আম্রকানন, মেহেরপুরের মুজিবনগর বাংলাদেশের প্রথম রাজধানীর তিন তিন বার ঘুরে এলাম।

প্রথমে নভেম্বর ২০১৮ সালে গিয়ে আমি একজন উদ্ভিদ প্রযুক্তিবিদ হিসাবে আম্রকাননের আমগাছগুলো মৃতপ্রায় অবস্থায় দেখে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে মাননীয় মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে বিষয়টি বলি।

তিনি আমাকে জানান, এ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত তিনি আছেন। আমাকে আরও জানান বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মুজিবনগরকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্য এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। ফ্রেব্রুয়ারি মাসের কোনও এক সময়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের একটি সভা মুজিবনগর এ অনুষ্ঠিত হবে। আমিও সেই সভায় যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হই। ওইদিনের সভায় আম্রকাননের আমগাছগুলো রক্ষার জন্য কী করণীয় সে বিষয়ে একটি বিশদ বিবরণ দেওয়ার জন্য আমাকে অনুরোধ করা হয়।

গত ১৬ মার্চ থেকে ১৮ মার্চ আমি নিজ উদ্যোগে এবং নিজ খরচে মাননীয় মন্ত্রীর পরামর্শক্রমে মুজিবনগর পরিদর্শন করি। আমি সহ ৩ জন বিশেষজ্ঞ  নিয়ে ৪ জনের একটি পরিদর্শন টিম নিজ খরচে নিজ উদ্যোগে আম্রতলা পরিদর্শনে যাই। ১৬ মার্চ বিকেল বেলায় আম্রতলা ঘোরার সময় প্রথমেই দেখতে পাই যে, প্রচুর দোকানপাট, আবর্জনা, ময়লা পলিথিন ও পিকনিক পার্টির 'ওয়ান টাইম ইউজ' করার থালা-বাসন, পানির বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে এক বিশ্রি পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। প্রচণ্ড কোলাহলে স্মৃতিসৌধ এর ভাবগাম্ভীর্য ব্যাহত হচ্ছে।

১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এর ৯৯তম জন্মদিনে ভোরের সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে প্রথম স্মৃতিসৌধ এর বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমরা কর্মসূচি শুরু করি। আমরা পুরো ২০ একর আম্রকানন এলাকা ঘুরে দেখি এবং প্রতিটি আমগাছকে প্রত্যক্ষ করি, প্রয়োজন মতো ছবি তুলি এবং কোন গাছে কী করণীয় তার সম্বন্ধে বিষদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করি। বিকেল বেলায় আমরা ওই এলাকার স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে আলাপ-আলোচনায় জানতে পারি যে, গত ৪৭ বছর এই আমগাছগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

স্মৃতিসৌধের ২৩টি স্তম্ভ যা সূর্যের মতো দেখা যাচ্ছে তা হলো পাকিস্তান আমাদেরকে যে ২৩ বছর শোষণ করেছে ৪৭ থেকে ৭১ তার প্রতীক। ১১টি সিঁড়ি আছে তা মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ১১ টি সেক্টরে যুদ্ধ হয়েছে তার প্রতীক এবং মাঝখানে যে লাল মঞ্চটি রয়েছে তা হল শপথ অনুষ্ঠানের মঞ্চটি, যা তৈরি হয়েছিল সেইসময় আশেপাশের বাড়ি থেকে চৌকি, টুল ইত্যাদি এনে। এখানেই শপথ নিয়েছিলেন প্রথমে তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল, খন্দকার মোস্তাক এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলী।

ডান দিকে অবস্থিত অসংখ্য পাথর মাথার খুলির মতো রাখা, যা ৩০ লাখ শহীদের মাথার খুলির প্রতীক। আরও ডান দিকে গেলে একটি ঢালে দেখা যায় রক্ত নদী তৈরি করে রাখা হয়েছে। তারপরে একটি ছোট রাস্তার মতো দেখা যায়, যাতে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ৭১ পর্যন্ত ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

ডানপাশে একটি গাছ রয়েছে তার একটি শাখা আছে যাতে শপথ অনুষ্ঠানের সময় ওয়ারলেস স্থাপন করা হয়েছিল। তৎকালীন মেহেরপুরের এসডিও বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী সাহেবের সম্পূর্ণ আয়োজনে এই শপথ অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন মেহেরপুরের এসপি মাহবুব এর নেতৃত্বে এ নতুন সরকারকে গার্ড অব অনার। স্মৃতিসৌধ পার হয়ে ভিতরে এগিয়ে গেলে ভাস্কর্য আকারে সব কিছু দেখা যায়। আজকের দিনে আমার একটি অনুরোধ বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা সফর হিসাবে বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগর সফর বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হোক।

১.  আমবাগানে যত্রতত্র দোকানপাট, ময়লা আবর্জনা, পিকনিক পার্টির দৌরাত্ম্য, এর ভেতর দিয়ে অবাধ মোটরসাইকেল এবং ভ্যান চলাচল যা আমগাছের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

২. পুরো ২০ একর এর আম্রকাননের তলার মাটি সিমেন্ট বাঁধাই এর মতো শক্ত হয়ে গেছে। বর্ষাকাল ছাড়া এইখানে কোনও রকমের পানির ব্যবস্থা নেই। পানির স্তর ১৭০ ফিট নিম্ন হওয়ায় বৃষ্টির পানি পড়া মাত্রই তা শুকিয়ে যায়।

আমগাছগুলোর প্রত্যেকটির নিচে গুঁড়িতে ডালপালাতে ছত্রাক, হপার এবং নানাবিধ ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগ দেখা যায়। স্থানীয় লোকদের মতে এ আমগাছে কখনই কোনো কীটনাশক ছত্রাকনাশক বা পানিও দেওয়া হয় নাই। কয়েক বছর পর পর দুয়েকটি গাছে মুকুল দেখা গেলেও তা আমে পরিণত হয় না।

৩. আমগাছগুলোর প্রত্যেকটির নিচে গুঁড়িতে ডালপালাতে ছত্রাক, হপার এবং নানাবিধ ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগ দেখা যায়। স্থানীয় লোকদের মতে এ আমগাছে কখনই কোনও কীটনাশক ছত্রাকনাশক বা পানিও দেওয়া হয় নাই। কয়েক বছর পর পর দু'একটি গাছে মুকুল দেখা গেলেও তা আমে পরিণত হয় না।

৪. ৯০ শতাংশ আম গাছে Gall disease বা undefined cell division, calluses, Cancer- এর মতো তৈরী হয়েছে, যা দীর্ঘদিন কোনও ওষুধ না দেওয়ায় বড় বড় মৌচাকের মতো তৈরি হয়েছে।

৫. প্রত্যেকটি আম গাছের ডালে প্রচুর পরিমাণে আগাছা, ফার্ন, দেশীয় অর্কিড জন্মে গাছের জীবনীশক্তি প্রতি মূহুর্তে ক্ষয় করছে। পাতা দিয়ে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে যে খাদ্য তৈরী করে তাও তারা শোষণ করে নিচ্ছে। পরজীবী উদ্ভিদ এর এটাই ধর্ম।

৬. দীর্ঘদিন গাছ ছাঁটাই না করায়, কখনই নতুন পাতা গজায়নি। আর পুরনো পাতাগুলো তার প্রাণশক্তি হারিয়েছে এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার হার প্রায় ২০ ভাগে নেমে এসেছে। নিচে পানি না থাকায় এর হার আরও কমে এসেছে।