ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা ও মানব পাচার রোধে বাজেট বরাদ্দ প্রসঙ্গে

ফরহাদ আল করিম
Published : 15 April 2019, 12:55 PM
Updated : 15 April 2019, 12:55 PM

নানাবিধ কারণে বাংলাদেশ মানব পাচারের ঝুঁকির মধ্যে থাকা একটি দেশ হিসেবে বর্তমানে পরিচিত। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে মানব পাচারের বৃহত্তম সোর্স কান্ট্রিও বলা হচ্ছে যা কাম্য নয়। কারণ সাগরপথসহ দেশের চারপাশে অরক্ষিত সীমান্ত, দারিদ্র, শ্রম অভিবাসনে আগ্রহীদের নিয়ম না মেনে বিদেশে যাওয়ার উদ্যোগ, পাচারের কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা ও পাচারকারীর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না থাকার কারণে পাচারকারীরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরো বেপরোয়া হয়ে গেছে। ফলশ্রুতিতে এ দেশ থেকে পাচারের হার দিন দিন যেমন বেড়ে যাচ্ছে; তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে চলছে।

মানবপাচার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর প্রতি বছর প্রতিবেদন পেশ করে যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। এই প্রতিবেদনে সারাবিশ্বের দেশগুলোর মানব পাচারের সার্বিক চিত্র ও সমস্যা সমাধানে দেশগুলো কি কি কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে তা প্রতিফলিত হয়। বিশ্বের সকল দেশের উপর র‌্যাংকিং করে তিনটি টায়ারে বিভক্ত করে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটিতে 'টায়ার থ্রি' হল সবচেয়ে নিন্মস্তরের বা নেতিবাচক একটি অবস্থান যেখানে ওই দেশটির মানবপাচারের উপর কোন কন্ট্রোল থাকে না এবং দেখা যায় না পরিস্থিতি উন্নয়নের নূন্যতম উদ্যোগও। এই তালিকায় আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ছাড়াও এশিয়ার দেশ লাওস, উত্তর কোরিয়া, চায়না রয়েছে। এই টায়ার বা স্তরের দীর্ঘ তালিকায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে আরো রয়েছে বলিভিয়া, দক্ষিণ সুদান, কঙ্গো, ভেনিজুয়েলা, ইরান ও রাশিয়ার মত পরিচিত দেশগুলো।

তবে বাংলাদেশের সৌভাগ্য হল- আমরা 'টায়ার থ্রি' এর ঠিক উপরের ধাপে আছি যা 'টায়ার-টু ওয়াচ লিস্ট' নামে পরিচিত। তার উপরে অবশ্য ক্রমান্বয়ে 'টায়ার টু' ও 'টায়ার- ওয়ান' রয়েছে। তিন বছর আগেও বাংলাদেশ 'টায়ার টু'তে ছিল। তবে মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার ন্যূনতম মানও বজায় না রাখায় তাদের প্রতিবেদনের র‌্যাংকিং-এ বর্তমানে আমরা 'টায়ার-২ ওয়াচ লিস্ট' বা দ্বিতীয় স্তরের নজরদারিতে চলে যাই যা দেশের জন্য একটি খারাপ সংবাদ। এই তালিকায় থাকা বিশ্বের অন্যান্য ৪৩টি দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আলজেরিয়া, সৌদি আরব, সেনেগাল, নাইজেরিয়া ও মালয়েশিয়া ইত্যাদি।

এই ইস্যুতে আমাদের অবস্থান নেতিবাচক কেন- বিষয়টি খতিয়ে দেখা জরুরী। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের গত দুই বছরের প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- মানব পাচার বিষয়ক অপরাধে তদন্ত, মামলা পরিচালনা ও অপরাধীর দণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন যথেষ্ট নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সীমান্ত এবং জনশক্তি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ ধরনের দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত, মামলা ও দণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রেও সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। সুতরাং দেশের স্বার্থে আমাদের এই বিষয়ে বর্তমানে মনোযোগী হওয়া দরকার। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা যদি এই অবস্থান থেকে উন্নতি না করে ভবিষ্যতে যদি আরও নিন্মগামী হই বা 'টায়ার-থ্রি' তে নেমে যাই তাহলে এটি বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের অবস্থানকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করবে এবং বিভিন্ন ইস্যুতে বর্তমান সরকারের উল্লেখযোগ্য ভাল ভাল অর্জনসমূহকে ঢেকে দিবে।

যদিও আমরা মনে করি যে- মানবপাচার ও অনিরাপদ শ্রম অভিবাসনের ইস্যুতে আমাদের কার্যকর উদ্যোগের অভাব। বিষয়টি কিন্তু আবার পুরোপুরি ঠিকও না। এই পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকার যেমন চেষ্টা চালাচ্ছে তেমনি সরকারের সাথে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও এনজিওরা কাজ করে যাচ্ছে। আন্তরিকতা দিয়ে সরকার বিভিন্ন আইন কানুন ও নীতিমালা তৈরী করে সমস্যা সমাধানের প্রয়াস চালাচ্ছেন। যেমন: সরকার ২০১২ সালে 'মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২' প্রনয়ণ করেছে যার লক্ষ্য মানব পাচাররোধে সামজিক অংশগ্রহণে প্রতিরোধ, সুরক্ষা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অন্যায়কারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এছাড়াও ২০১৩ সালে সরকার প্রণয়ন করেছেন- 'বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৩'। ক্রমান্বয়ে ২০১৭ সালে প্রণীত হয় আরো দুটি বিধিমালা যা 'বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১৭' এবং 'মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন বিধিমালা-২০১৭'। নিরাপদ উপায়ে শ্রম অভিবাসনে সহায়তা ও মানবপাচার রোধে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই আইন ও বিধিমালাগুলো অবশ্যই একটি মাইল ফলক। তবে আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী সচেতনতা বৃদ্ধি, সংশ্লিষ্টদের আইন জানানো ও আইনের প্রয়োগ নিয়ে আরো নুতন নুতন কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে যাতে সকল মানুষ উপকৃত হয়।

'মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২' বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- এই আইনের উল্লেখযোগ্য ধারা-১৯ এ বলা হয়েছে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করিতে হইবে এবং ধারা-২১ এ বলা হয়েছে মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করিতে হইবে। এছাড়াও এই আইনের ২১(২) ধারা অনুযায়ী, অপরাধসমূহ বিচারের জন্য সম্মানিত দায়রা জজ কিংবা অতিরিক্ত দায়রা জজ পদমর্যাদার বিচারকের সমন্বয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখন পর্যন্ত দেশের কোনো জেলায়ও ট্রাইব্যুনালটি হয়নি। ফলে এই মামলার বিচার কার্যক্রম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে চলছে। এ ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা এবং যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মামলা যা জরুরী ভিত্তিতে উদ্যোগ নিয়ে সমাধান করা দরকার। এই আইনের এ ছাড়াও ধারা-২৪ এ বলা হয়েছে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করিবে। কিন্তু মানবপাচার ইস্যুতে অভিযোগের নিস্পত্তি সহজে হচ্ছে না বরং দিন দিন মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২০১২ সালে সরকার এক প্রজ্ঞাপনে বলেন মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠিত না হওয়া পর্যন্ত, প্রত্যেক জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালকে উক্ত জেলার মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল হিসাবে নিয়োগ বা ক্ষমতায়িত করিল। এখানে উল্লেখ্য যে-২০১৫ সালে সমুদ্রপথে বাংলাদেশ হতে মানব পাচারের ঘটনা নিয়ে বিশ্বজুড়ে সমালোচনা শুরু হলে সে সময় মাননীয় আইনমন্ত্রী প্রাথমিকভাবে অন্তত সকল বিভাগে ট্রাইব্যুনাল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যাতে মামলাগুলো গতিশীল হয় ও পাচারকারীরা শাস্তি পায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- এ পর্যন্ত দেশে একটি ট্রাইব্যুনালও গঠন হয়নি। ফলে বিচার প্রক্রিয়া যেমন ক্রমশ বিলম্বিত হচ্ছে; তেমনি অভিযোগকারীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনটি ২০১২ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রণয়নের পর থেকে এ পর্যন্ত ৪৪৪৬টি মামলা হলেও সামান্য সংখ্যক মামলার সাজা হয়েছে যা হতাশাজনক। সরকারি তথ্য অনুযায়ী আইনটি প্রণয়নের পর থেকে এ পর্যন্ত মামলার সংখ্যার দিয়ে দেশের শীর্ষ জেলাগুলো হলো- ঢাকা, যশোর, কক্সবাজার, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, সাতক্ষীরা, জামালপুর, রাজবাড়ী, হবিগঞ্জ, নড়াইল, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, বাগেরহাট, বরগুনা ও নওগাঁ ইত্যাদি জেলা। শুধুমাত্র ঢাকা জেলার মামলার সংখ্যা ১৬শ'র বেশি ছাড়িয়ে গেছে যা সবার শীর্ষে রয়েছে; ক্রমান্বয়ে যশোর এর অবস্থান দ্বিতীয় শীর্ষে রয়েছে। তবে সীমান্ত জেলাগুলোতে কমবেশি মামলা আছে যা নিয়েও নতুন করে ভাবা দরকার। এই সব এলাকাতে বেশি বেশি সচেতনতা বাড়ানো ছাড়াও সারাদেশে যারা পাচারের শিকার হয়ে ফিরে আসছেন তাদেরও পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের সাথে এনজিও'রাও এক হয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও পুনর্বাসনে কাজ করতে পারে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষরা তৃণমূল পর্যায়ে আরো বেশি উপকৃত হবেন।

সরকার মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে সরকার আবারও একটি ৫ বছর মেয়াদী জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (ন্যাশনাল প্ল্যান অব এ্যাকশন: ২০১৮-২০২২) গঠন করেছে। এটি এই ইস্যুতে সরকারের তৃতীয় কর্মপরিকল্পনা যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নেতৃত্বে গঠিত হয়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। সর্বশেষ প্রণীত এই কর্মপরিকল্পনাটিতে আইন প্রয়োগ, ঝুঁকি হ্রাস, উদ্ধার, প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সরকার এবং বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সক্রিয়ভাবে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে। উল্লেখ্য এই কর্মপরিকল্পনাটিতে ট্রাইবুন্যাল গঠনের প্রতিও আবারও বলা হয়েছে যা দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করলে বিচার প্রক্রিয়ায় গতিশীলতা আসবে এবং মানবপাচারের মামলার সংখ্যা কমতে থাকবে। ট্রাইবুন্যাল গঠনে যদি আমরা দেরী করি তাহলে পাচারের শিকার মানুষের ভোগান্তি একদিকে যেমন বাড়তে থাকবে; তেমনি মানুষের মাঝে আইন অনুয়ায়ী মামলা করার অনীহা তৈরি হবে।

যেহেতু আইন ও কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ আছে সুতরাং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে এই ট্রাইবুনালটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ দ্রুত নেয়া দরকার। কারণ এর দীর্ঘসুত্রিতার জন্য একদিকে বর্হিবিশ্বে যেমন আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে; তেমনি পাচারের শিকার মানুষদের অধিকার খর্ব হচ্ছে। তাই এই ইস্যুতে মামলার সংখ্যা বিবেচনা করে সমগ্র দেশে সম্ভব না হলেও প্রাথমিকভাবে দেশের আটটি বিভাগে কিংবা পাচার বেশি ঘটনা ঘটে এমন শীর্ষ ঝুঁকিপূর্ণ জেলায় অন্তত একটি করে ট্রুাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করলে ভুক্তভোগীরা সঠিক সময়ের মধ্যে ন্যায়বিচার পাবেন; দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং দরকার এখন সরকারিভাবে বাজেট বরাদ্ধ দিয়ে আইনে উল্লেখিত ট্রাইবুনালটি চালু করা ও আইন প্রয়োগে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেয়া।

আমরা জানি আগামী বাজেট খুবই সন্নিকটে। তৃতীয়বারের মত দায়িত্ব নেয়া বর্তমান সরকার দেশের মানুষের সার্বিক চাহিদা বিবেচনা করে ইতোমধ্যে হয়তোবা আগামী বাজেট প্রণয়নের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। তবে মানবাধিকার, সুশাসন ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রান্তিক মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে সরকারের উচিত আগামী বাজেটে এই খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেয়া দরকার। এছাড়াও মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পেতে চাইলে অন্যান্য উন্নয়ন সূচকের সাথে আমাদের পাচারের শিকার ব্যক্তি ও রেমিটেন্স আহরণকারী অভিবাসী কর্মীর মানবাধিকার ইস্যুতেও উন্নতি দেখাতে হবে যা বিবেচনায় আনা জরুরী।