নুসরাতের শব কাঁধে বাংলাদেশ

Published : 12 April 2019, 02:13 PM
Updated : 12 April 2019, 02:13 PM

মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নুসরাতের মৃত্যুতে কাঁদছে বাংলাদেশ। 'যৌন নিপীড়ক' মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজুদ্দৌলার প্রতি ঘৃণায় সামাজিক মাধ্যমে ঝড়। সাহসী, প্রতিবাদী নুসরাতের অগ্নিদগ্ধ, ব্যান্ডেজমোড়ানো শবদেহের ছবি দেখে বেদনার্ত হয়নি, এমন মানুষ বিরল। মনে হচ্ছে যেন নুসরাতের শব কাঁধে নিয়ে শোক করছে বাংলাদেশ।

নুসরাত বাংলাদেশে একজন নয়। এর আগেও এমন অনেক শবদেহ বহন করতে হয়েছে সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রকে। দেখতে হয়েছে রিশা ও তনুদের অসহায় মৃত্যু। সামাজিক মাধ্যমে ঝড়ও নতুন কিছু নয়। একের পর এক বিষয়ে উত্তাল হওয়াই সামাজিক মাধ্যমের বৈশিষ্ট্য।

কিন্তু নুসরাতের যৌন-আক্রান্ত হওয়া, প্রতিবাদ করা, তার উপর আবার আক্রমণ চালানো, কেরোসিন ঢেলে অগ্নিসংযোগ এবং অবশেষে তাকে পুড়িয়ে হত্যা করা- এর মধ্যে একটি বেশ গুরুতর বিষয় লক্ষ্যণীয়। নুসরাত যখন মৃত্যুশয্যায় সেসময় অধ্যক্ষ সিরাজুদ্দৌলার মুক্তি দাবি করে সোনাগাজী এলাকায় একটি মিছিল বের হয়। সে মিছিলের প্রকৃত ছবি এবং ফটোশপ করা ছবি দুটোই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ফটোশপ করা ছবিটি প্রসঙ্গে কিছু বলার কোনও মানে না হলেও প্রকৃত ছবিটিতে দেখা যায় মাদ্রাসার কিছু শিক্ষার্থীকে। বোরখা পরিহিত নারীদেরও দেখা যায়। নুসরাতের দেহে যারা অগ্নিসংযোগ করে তারাও ছিল বোরখা পরা নারী। নুসরাতের হত্যার পর দেশের মাদ্রাসাগুলোর পরিচালকদের পক্ষ থেকেও কোনও প্রতিবাদ বা নিন্দা জানানো হয়নি।

এখানেই প্রশ্ন ওঠে দেশের মাদ্রাসা-শিক্ষা ব্যবস্থার আড়ালে জমে থাকা অন্ধকার নিয়ে। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে রয়েছে অসংখ্য মাদ্রাসা ও এতিমখানা। মাদ্রাসা ও এতিমখানায় শিশুদের উপর মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালানোর খবর অনেকবারই পত্রিকায় এসেছে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অনেক বছর ধরেই। এই নির্যাতিতদের মধ্যে ছেলে ও মেয়েশিশু রয়েছে। মসজিদের ভিতরে ছেলে ও মেয়েশিশুর যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনাও পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে অসংখ্যবার। অনেক শিশুকে হত্যাও করা হয়েছে। মক্তব ও মাদ্রাসায় সকল শিক্ষকই যে অপরাধী তা নয়। কিন্তু এসব জায়গায় প্রচুর অপরাধী যে রয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের মতো ধর্মান্ধ সমাজের সমস্যা হলো মাদ্রাসা শিক্ষকদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ করতে গেলেই মনে করা হয় ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে। এখানে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, ভ্যাটিকানের ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধেও অনেকবার শিশুর উপর যৌন নির্যাতন চালানোর অভিযোগ উঠেছে। এর মানে কিন্তু এই নয় যে, খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে কোন কথা বলা হচ্ছে। এর মানে হলো অপরাধী যাজকের শাস্তি বিধান করা এবং শিশুকে নির্যাতন থেকে বাঁচানো। তাহলে মাদ্রাসা শিক্ষকের অপরাধের শাস্তি চাইলে সেটাকেও ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করানোর কোন মানে নেই। নির্যাতনকারী ধর্ষক  অধ্যক্ষের মুক্তি দাবি করে যারা মিছিল করেছে নিঃসন্দেহে তাদের মগজ এমনভাবে ধোলাই করা হয়েছে যে তারা বুঝতেই পারেনি তারা কি করছে। অথবা তারা সিরাজুদ্দৌলার চ্যালাচামুন্ডাদের ভয়ে বাধ্য হয়েছে। মাদ্রাসাগুলোর ভিতরে কি ধরনের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম রয়েছে তা এই মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের দেখলেই বোঝা যায়।

মাদ্রাসা শিক্ষার পদ্ধতি কতটুকু যুগোপযোগী সেটাও ভেবে দেখার দরকার আছে বৈকি। এখন সারা বিশ্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুর শারীরিক ও মানসিক শাস্তির বিরুদ্ধে প্রচার চলছে। নিষিদ্ধ করা হচ্ছে এই বর্বরতা। অথচ মাদ্রাসাগুলোতে এখনও শিশুকিশোরদের ভয়ানক সব শারীরিক শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। শিশুকিশোরদের বেত মারা, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা, তাদের উপর ধর্ষণ ও বলাত্কার চালানো শিক্ষকদের কাছে ডালভাত। মাদ্রাসাগুলোতে এতটাই ত্রাসের রাজত্ব চলে যে এর প্রতিবাদ করার কথা শিক্ষার্থীরা স্বপ্নেও ভাবে না। তাছাড়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতদরিদ্র, দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা ছেলেমেয়ের সংখ্যাই বেশি। তারা ধরেই নেয় এভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়াটাই তাদের নিয়তি। মাদ্রাসাগুলোতে যে শিক্ষা দেওয়া হয় তাও একজন শিশুর ভবিষ্যতে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য কতটা উপযোগী হবে সেটাও একটা প্রশ্ন। দেশের কাওমী মাদ্রাসাগুলোতে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি বিরোধী শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখার সময় হয়ে গেছে অনেক আগেই। ধর্মের নামে তাদের দেওয়া হচ্ছে প্রগতি ও মানবাধিকারবিরোধী শিক্ষা।

ফিরে আসি নিহত নুসরাত ও নির্যাতনকারী সিরাজুদ্দৌলার প্রসঙ্গে। সাহসী নুসরাত তার উপর সংঘটিত নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছিল। তাই তাকে হত্যা করা হলো।  সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে আগেও নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই অভিযোগগুলো মাদ্রাসার পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়নি। যদি নিত তাহলে আজ নুসরাতকে মরতে হতো না। দেশের ছোট বড় প্রতিটি মাদ্রাসাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা দরকার অবিলম্বে। মানব সভ্যতা এগিয়ে চলছে বিজ্ঞানের আশীর্বাদে। মানুষ আজ ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তুলতে পেরেছে, মহাবিশ্বের রহস্য আবিষ্কারের সাধনায় মগ্ন রয়েছে।

একই দেশে তিন, চার রকম শিক্ষা পদ্ধতি চালু না রেখে সমন্বিত শিক্ষা পদ্ধতি প্রচলন করাটাই বিজ্ঞানসম্মত। তবু যদি মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতি রাখতেই হয়, তাহলে তা থেকে জমাট বাঁধা অন্ধকার দূর করে সেগুলোর আধুনিকায়ন করতে হবে। মাদ্রাসাগুলো যেন যৌন নির্যাতনের আখড়া, কুশিক্ষা ও কুসংস্কারের ডিপো এবং প্রগতিবিরোধী ও মানবাধিকারবিরোধী চিন্তার সূতিকাগারে পরিণত না হয় সেটা নিশ্চিত করতেই হবে। সরকারের কঠোর নজরদারি ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। নুসরাতের হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও  যৌন নির্যাতক অধ্যক্ষ সিরাজুদ্দৌলার কঠোর শাস্তি যেমন চাই তেমনি লাখো নুসরাতের নিরাপদ এবং সুস্থ জীবনও কামনা করি।