নিষিদ্ধ মুখোশ: রাজনীতির মুখ ও মুখোশ

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 9 April 2019, 12:20 PM
Updated : 9 April 2019, 12:20 PM
মঙ্গল শোভাযাত্রায় এবার ও ভুভুজেলা আর মুখোশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।  গতবারও তাই করা হয়েছিল। মনে হচ্ছে এটাই নিয়মে পরিণত হতে চলেছে। কে করবে প্রতিবাদ? কে শোনে কার কথা? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিকল্প নাই এটা মানি। এও জানি তিনি না থাকলে এদেশের ভবিষ্যত অন্ধকার। কিন্তু সরকারী দলের সবকিছু মানা কি আসলেই সম্ভব?
যে  আদর্শ যে মূল্যবোধ আর যে নৈতিকতা আওয়ামী লীগের শক্তি তা এখন অবহেলিত। মুক্তিযুদ্ধের শেষ সলতেটা তাদের হাতে থাকলেও এর জ্বলা-নেভা নির্ভর করছে অনেক কিছুর ওপর।  একসময় জামায়াত যে সব কাজ করতে চেয়েছিল ঝামেলা পাকালেও মানুষ তা ব্যর্থ করে দিয়েছে বারবার। আজ তারা অদৃশ্য। বিএনপিও অর্ধমৃত। ফলে সরকারী দল মনে করতেই পারে সবকিছু কঠোর নিয়ন্ত্রণে। আর সে জায়গা দখল করে নিয়েছে হেফাজত। কখনো ওলামা লীগ। কী করছে তারা? ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করে পরিবেশ এমন করে তুলছে যাতে একসময় এসব মুখ ও মুখোশ একাকার হয়ে আমাদের চেহারা ও পরিচয় দুটোই এমন করে তুলবে যে কেউ কাউকে আর চিনতেও পারবো না।
জনগণের অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ততা আজ থাকা না থাকা কোনও বিষয় না। ভোট হলেও কি না হলেও কি? তবে ফলাফল তো ঠিক থাকছে। আসলে কি তাই? সব জয় কি জয় হয় শেষপর্যন্ত? বৈশাখী শোভাযাত্রার কথা একটু থামিয়ে চলুন দেখিতো কি হয়েছে এবারের উপজেলা নির্বাচনে। যারা ঠাট্টা করে বলছেন, সার্থক উপজেলা নির্বাচনের পর ভুভুজেলার দরকার কী? তাদের বলি, এবার উপজেলা নির্বাচনে দেখলেন তো নিজেরা নিজেরা লড়াই করে ক্লান্ত। এমন কি একটি কেন্দ্রে নৌকা নাকি শূন্য ভোট পেয়েছে! একজনও বাক্সে সিল মারা ব্যালট পেপার ঢোকাতে পারেনি? এটা কেমন আশ্চর্যের বিষয় না? আসলে কি বলেন তো, খেলার আরেক অধ্যায় হয়তো শুরু হয়ে গেছে। এটাই কি স্বাভাবিক না?
একসময় সিল মারতে মারতে ক্লান্ত মন হয়তো আর সিল মারতে চায়নি। রাত-বিরেতের ভোট তো। গ্রামে-গঞ্জে কে কার খবর রাখে? হয়তো সন্ধ্যা বেলায় চোখে দেখেনা এমন কেউ সিল মেরেছিল! হয়তো রাগ করে কেউ নৌকার বাক্স খালি রেখেছে! আবার এমনও হতে পারে অত্যুৎসাহী কেউ প্রায় শুনছে নির্বাচন ফেয়ার হচ্ছেনা। ভোট কারচুপি হচ্ছে। ফলে এমন এক কাণ্ড করে দেখিয়েছে, যাতে মনে হতে পারে কি দারুণ ভোট হয়েছে, যেখানে নৌকায় কোনও ভোটই পড়েনি।
বিষয়টার গভীরতা ভাবুন। যদি সুষ্ঠু স্বাভাবিক ভোট হয় এমন কোনও কেন্দ্র আছে যেখানে নৌকায় একটি ভোটও পড়বে না? এমনটা ধানের শীষের বেলায়ও সত্য। তাদের বাক্সও খালি যাবেনা। কিন্তু ভোটাভুটি এমন এক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যে বাক্স ভর্তি বা খালি রাখা কোনও ব্যাপার না। কিন্তু এর ভেতর ষড়যন্ত্র ও আগামীতে বিপদের সংকেত আছে। সেটা ভেবে দেখার মন মানসিকতা কি সরকারী দলের লোকজনের আছে? তাদের মনে ফূর্তি মুখে আরামের ছাপ। এই আরাম যদি হারাম হয় তো অবাক হবার কিছু আছে আসলে?
এসব ডামাডোলের ভেতর আমাদের জাতীয় উৎসব বৈশাখী উৎসব বা নববর্ষ এসে গেছে প্রায়। গত কয়েক বছরের মতো এবারও ভুভুজেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটি আমাদের দেশের কোনও বাদ্যযন্ত্র না। মূলত সকার খেলা দেখে এর ব্যবহার শিখেছি আমরা। আফ্রিকার দেশে দেশে মানুষকে বনে জঙ্গলে ডেকে পাঠানো থেকে উদ্ভুত এই যন্ত্রের আওয়াজ সবসময় শ্রুতিমধুরও না। কিন্তু আর দুটি বিষয় ভাবুন তো। একটি হলো সন্ধ্যা ছটার পর বাইরে থাকা যাবেনা। কেন? পরিবেশ পরিস্হিতি যদি ভালো থাকে তো কেন থাকা যাবে না? তার মানে কোথাও শঙ্কা ভয় কাজ করছে। এটা তো সমাধান হতে পারেনা। বৈশাখ তো গ্রীষ্মের শুরু। দিন বড় হয়। রোদ থাকে বেলা অবধি। সেখানে ছয়টায় ফিরে যাবার আদেশ কেন? আরেকটি হলো মুখোশ নিষিদ্ধ।
মুখ যেখানে মুখোশ সেখানে নতুন করে মুখোশের কি প্রয়োজন আছে? আপনি তাকিয়ে দেখুন তো বড় বড় মানুষের মুখ দেখে কি বোঝা যায় এগুলো মুখ না মুখোশ? তাদের কথা প্রতিশ্রুতি আর কাজ মেলালে কী মনে হয়? কী মনে হয় কোনও সরকারী ভবনে গেলে? কী ধারণা হয় কারো কথামত ঠিক সময়ে কোথাও পৌঁছালে? কেউ কথা দিলে আপনি কি আসলেই বিশ্বাস করেন যে সে কথা রাখা হবে? কেউ তা আশা করেনা। কারণ সবাই জানে মুখ এক আর ভেতরের মুখোশ আলাদা। ফলে মুখোশের নতুন করে ব্যবহার থাকলে কি, আর না থাকলেই বা কি? তবে মুশকিল হলো এর শিকার বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এ কাজটি এমনিতেই ঝুঁকির মুখে। এক শ্রেণির রাজনীতি আর একদল মানুষ সবসময় এর ঘোর-বিরোধী। তারা এটাকে ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের সাথে মিলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ করে রেখেছে। তারা চায় না এ শোভাযাত্রায় কোনও প্রতীক ব্যবহার করা হোক। তাদের আবদার এগুলো বন্ধ করতে হবে। কবে বন্ধ হবে জানিনা। তবে এটা বোঝা কঠিন না মুখোশ নিষিদ্ধ এর অংশ হোক বা না হোক তাতে এর প্রভাব আছে।
আপাতত আমরা বুঝে নিচ্ছি এটা পরে যাতে কেউ কোন সন্ত্রাসী বা নিপীড়ণের মত খারাপ কাজ করতে না পারে সে জন্যে এই নিষিদ্ধ করণ। কিন্তু এভাবে কি দমন করা সম্ভব? মানুষের মনে যদি কু থাকে খারাপ চিন্তা কাজ করে সে তা চরিতার্থ করবেই। এটাই দেখে আসছি আমরা। অথচ মন মনন আর বিবেক সাফ করার কোন প্রক্রিয়া নাই সমাজে। সে কোন আদিকাল থেকে নারীদের সম্মান আর ভালোবাসার রেওয়াজ চলে আসছে সমাজে। পাশাপাশি যুদ্ধ করা জাতি আজ নারী দেখলেই মাথা গরম শরীর গরম করে ফেলে এটা কেমন কথা? কোথাব আসলে গলদ? কবে থেকে এই পচন ধরেছে আমাদের? ফিরে তাকান তো। যে যুবশক্তি আমাদের ভরসা ছিলো পথ দেখিয়েছিল আজ তারা কোন ষড়যন্ত্রের শিকার? কোন সামাজিক অপপ্রক্রিয়া বা জাল আমাদের ঘিরে ফেলেছে? কাদের প্রভাব কাদের উস্কানী আর প্ররোচণায় এসব হয় সবাই জানেন। কিন্তু ঐযে স্পর্শকাতরতা তাই এনিয়ে কিছু বলা যাবেনা। সমাজে এ নিয়ে কথা বললে ভোট কমার আশংকা আছে। আছে সমর্থন হারানো ভয়। ব্যস মুখোশ বন্ধ করে দিলেই হলো।
অথচ আজ চারপাশে শুধু মুখোশের কারসাজি। কে জানে এই যে আগুন আগুন এই যে আগুনে জীবন সম্পদ নাশ এতো দেখছি স্বাধীনতার পরপর দেখা বাস্তবতার আবার ফিরে আসা। তখন পাটের গুদাম খাবারের গুদামে আগুন দিয়ে আতংক সৃষ্টি করা হতো আর এখন উঁচু উঁচু ভবনের আগুন জ্বালিয়ে মারছে ঢাকাকে। রাজধানী কেন্দ্রিক একের পর এক আগুন কোথায় গিয়ে থামবে কে জানে? ঐযে বলছিলাম মুখোশ কিন্তু কিছুই বুঝতে দিচ্ছেনা। সে শুধু মাথা নাড়ে আর জ্বী হুজুর জ্বী হুজুর করতে ব্যস্ত।  এই স্তাবকতার পেছনে যে বিপদ তাই কি নববর্ষের শোভাযাত্রাকে মুখোশহীন করে আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে রাজনীতি ও সমাজে মুখ ই এখন মুখোশ? কেউ কি সাবধান হবেন না সাবধানতার পথ দেখিয়ে দেবেন? আমরা যে ক্রমাগত অসহায় হয়ে পড়ছি। দেশে বিদেশে বাঙালির এই দূশ্চিন্তা কি দূর করা সম্ভব ?