ভোটে অনাগ্রহ, কী কারণ?

কবির য়াহমদ
Published : 8 April 2019, 01:22 PM
Updated : 8 April 2019, 01:22 PM

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটারদের অনাগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছাড়া অপরাপর দলগুলো নেই। আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আছেন ক্ষমতাসীন দলটির দলীয় মনোনয়নকে চ্যালেঞ্জ জানানো বিদ্রোহী প্রার্থীরা। এই নির্বাচন ভোটারদের মধ্যে কোনওধরনের সাড়া ফেলেনি। উলটো ভোটারহীনতায় থাকা এই নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

এ পর্যন্ত চার ধাপে সাড়ে চারশ'র বেশি উপজেলায় নির্বাচন হয়েছে, অনুমিতভাবেই আওয়ামী লীগের মনোনয়নে 'নৌকা' মার্কার প্রার্থীরা অধিকাংশ জায়গায় বিজয়ী হয়েছেন। তবে এই প্রার্থীরা ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারেননি। ৪ ধাপে গড় ভোট পড়েছে ৪০ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ভোটের এই হার নানামুখী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন ওঠেছে ভোটাররা কি তবে ভোটের গণতন্ত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন? নাকি আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না অথবা ব্যর্থ হচ্ছেন? এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিএনপি নেই বলে কি ভোটারদের এই অনাগ্রহ? বিএনপি নির্বাচনে থাকলে কি ভোটাররা ভোট দিতে কেন্দ্রে যেতেন? এমন অগণন প্রশ্ন উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) এপর্যন্ত চার ধাপে নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। পঞ্চম ধাপের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেনি ইসি; ধারণা করা হচ্ছে আসন্ন রমজানের ঈদের পর বাকি উপজেলাগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে এই সময়ে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া নির্বাচনে ভোটারদের অনাগ্রহের এই নজির পরের নির্বাচনগুলোর ওপর প্রভাব পড়বে বলেই মনে হয়।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ গত দশ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায়। এই সময়ে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন একাধিকবার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওইসব নির্বাচন নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। এই সময়ে এসে সমালোচনাকেও আমলে নিতে হচ্ছে কারণ সর্বশেষ নির্বাচনগুলোতে ভোটারদের অনাগ্রহ সত্যিকার অর্থে আমাদের ভোটিং ব্যবস্থাকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এনিয়ে যেমন উদ্বিগ্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ তেমনি উদ্বেগে নির্বাচন কমিশনও; যদিও ভোটারদের এই অনাগ্রহের দায় নিতে নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই অস্বীকার করে বসে আছে। ইসি এজন্যে দায়ী করছে রাজনৈতিক দলগুলোকে।

কেবল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনই নয়, এরআগে অনুষ্ঠিত হওয়া ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনেও ভোটারদের অনাগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। 'ভোটারদের অপেক্ষায় সংবাদকর্মী, ভোটকেন্দ্র' এমন শিরোনামেও সংবাদ বেরিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। ওই নির্বাচনে ভোটারদের এমন হালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, 'নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভোটের পরিবেশ তৈরি করে। তারা ভোটার আনে না। তাই নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি যে কম, এর দায় ইসির না। দায় প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলগুলোর'।

ইসি নির্বাচনে ভোটারদের অনাগ্রহের দায় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপালেও রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এনিয়ে ভাবান্তর নেই। নির্বাচনে ভোটারদের এই অনাগ্রহ তাদের মাঝে কোনো প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয়না। চার ধাপের নির্বাচনে ভোটপ্রদানের এই হার নিয়ে তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য চোখে পড়েনি। এই নির্বাচনকে রুটিনওয়ার্ক হিসেবেই দেখছে হয়ত তারা। ফলে দলের নেতাদের কারও মধ্যে ভোটকেন্দ্রে ভোটার টানার মতো আলাদা কোনো কর্মসূচি কিংবা নির্দেশনা আসেনি। এতে করে ক্ষতিটা হচ্ছে মূলত দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থারই।

এদিকে, নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি ভোটে ভোটারদের অনাগ্রহকে তাদের নির্বাচন বর্জনের ফল হিসেবে দাবি করলেও আদতে সেটা নয়। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক ভরাডুবির পর দলটির অস্তিত্ব নিয়েই যেখানে টানাটানি সেখানে তাদের নির্বাচন বর্জনের প্রভাব আদতে মাঠে কিংবা আলোচনায় কোথাও থাকার কথা নয়। ফলে বিএনপি নির্বাচনে আসেনি বলে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছেন না বলে যে দাবি তারও সত্যতা নেই। তবে নাগরিকের মধ্যে 'ভোট দিয়ে কী হবে'- এমন এক আওয়াজ ওঠতে শুরু করেছে।

এর কারণ মূলত বিগত সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় অকল্পনীয় কোনো ঘটনা না হলেও বিপুল বিজয়ের এই সংখ্যা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি মাত্র ছয় আসনসহ বিরোধী রাজনৈতিক জোট মাত্র আট আসন লাভ করবে এমনটা কে ভেবেছিল? এমন কি আওয়ামী লীগ নিজেরা ভেবেছিল? নেতাদের এক্ষেত্রে সৎ-উত্তর দেওয়া কতখানি সম্ভব এনিয়ে সন্দিহান থাকলেও নির্বাচনের এই ফলাফল খোদ আওয়ামী লীগের প্রান্তিক পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছেই আশ্চর্যপ্রদ বিষয় ছিল। ওই নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার যে অভিযোগ ওঠেছিল সেটা কেউ তাৎক্ষণিক ভাবে স্বীকার না করলেও পরবর্তীতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও একাধিক নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যে সে ইঙ্গিত মেলে।

গত ৮ মার্চ রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটে নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হলে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ভরে রাখার কোনো সুযোগ থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন। সিইসি বলেন, 'সমাজের মধ্যে একটার পর একটা অনিয়ম অনুপ্রবেশ করে, আবার সেটি প্রতিহত করতে একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। এখন ইভিএম ব্যবহার শুরু করে দেবে, তাহলে সেখানে আর রাতে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ থাকবে না।' এর আগে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে সুনামগঞ্জে বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সভায় প্রধান অতিথি নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, 'আমি পরিষ্কারভাবে জানাতে চাই, নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরা কিংবা ভোটের দিন, ভোটের পর গণনার সময় কোনো অনিয়ম মেনে নেওয়া হবে না।' ভোটের আগে ভোট, রাতে ভোট- নাগরিকের মাঝে ঘুরপাক খাওয়া এই ধরনের অভিযোগ তখন শক্ত ভিত্তি পায় সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারের এমন বক্তব্যে। ফলে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে কী হবে- এমন এক ধারণা জন্মাচ্ছে ভোটারদের মাঝে।

এদিকে, কেবল সাধারণ ভোটাররাই ভোটদানে আগ্রহ হারাচ্ছেন তা না। উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় নৌকা প্রতীক থাকার পরেও ভোট দেওয়ার হার খুবই কম। এই নির্বাচনের চার ধাপে অনুষ্ঠিত ৪৫৮ উপজেলার মধ্যে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের ৩১৮ জন প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন, এরবাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী ১৩৬ জনের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। ফলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মাঠে আছে বলেই কাগজেকলমে মেনে নিতে হচ্ছে। তবু ভোটের এই হার কেন? এর বিপরীতে অন্য চিত্রও আছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় ব্রাহ্মণহাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মহিলা ভোট কেন্দ্রে নৌকা প্রতীক কোনো ভোটই পায়নি; এবং আউলিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা পুরুষ কেন্দ্রে নৌকা পায় মাত্র দুই ভোট। ওই দুই কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৩২৭ ও ২৪৬৯ জন। বিষয়টি বিস্ময় জাগানিয়া! তবে কি আওয়ামী লীগই আগ্রহ হারাল নির্বাচনে? প্রায় পাঁচ হাজার ভোটারদের মধ্যে একজনও নাই নৌকার ভোটার? আওয়ামী লীগের ভোটাররাও কি তবে 'ভোট দিয়ে কী হবে'- এমনটা ভাবতে শুরু করেছেন?

এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কেবল ভোটার সংখ্যাই কম হিসেবে আলোচনায় থাকছে তা না এবার রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতও হয়েছেন। চার ধাপে এপর্যন্ত ১০৭ উপজেলার চেয়ারম্যান বিনা ভোটে জয় পেয়েছেন। এরা সবাই আওয়ামী লীগের। ভোট ছাড়াই চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন সর্বমোট ২২৩ জন জনপ্রতিনিধি। এগুলো এই নির্বাচনের দুর্বল দিক, একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারও।

এই নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ নিজেরাই গুরুত্ব দেয়নি- এমন আওয়াজ তুলতে চাইছেন অনেকেই। তবে এটা বলার সুযোগ নাই। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ৩০ জনের অধিক সংসদ সদস্যও প্রচারণায় ছিলেন বলে তাদেরকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিতে হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। তবু ভোটাররা নির্বাচনে আগ্রহী হচ্ছেন না। নির্বাচনের প্রথম ধাপে ৪৩ দশমিক ৩২ শতাংশ, দ্বিতীয় ধাপে ৪১ দশমিক ২৫ শতাংশ, তৃতীয় ধাপে ৪১ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং চতুর্থ ধাপে ভোট পড়ে মাত্র ভোট পড়ে ৩৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। সর্বশেষ মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়েও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নেওয়া যায়নি।

নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতির হতাশাব্যঞ্জক এই চিত্র আমাদের গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দিচ্ছে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নাগরিকের অংশগ্রহণের এই বিষয়টি নির্বাচন কমিশনও খেয়াল রাখছে বলে মনে হচ্ছে। অন্তত তাদের বক্তৃতাতে সে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে এ থেকে উত্তরণে তারা কিছু ভাবছে বলে মনে হচ্ছে না, তারা এজন্যে রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতাদের দিকে বল ঠেলে দিতে আগ্রহী। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের অনাগ্রহের এই বিষয়টি সম্পর্কে বলেছেন, 'ভোটে জনগণের যে অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে জাতি এক গভীর খাদের কিনারের দিকে অগ্রসরমান। আমরা গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় শামিল হতে চাই না। রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিকদের ভেবে দেখা দরকার'।