বিশ্ব বোকা দিবস: পহেলা এপ্রিল নাকি ২২ জুন?

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 6 April 2019, 02:46 PM
Updated : 6 April 2019, 02:46 PM

দৈনিক ইনকিলাব ০১ এপ্রিল, ২০১৯

"১ এপ্রিল মুসলিম গণহত্যার মর্মান্তিক ইতিহাস এপ্রিল ফুল পালন থেকে বিরত থাকুন -বিভিন্ন ইসলামী নেতৃবৃন্দ।  তারা বলেন, ১৪৯২ সালের 'পহেলা এপ্রিলে' রাণী ইসাবেলা কর্তৃক মুসলমানদের চরম ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে ঘোষণা দিয়ে বলে যদি বাঁচতে চাও কর্ডোভার জামে মসজিদে সমবেত হলে প্রাণভিক্ষা দেয়া হবে।  অতঃপর এই বলে সম্মিলিত হাজার হাজার আলেম-উলামা, সাধারণ মুসলমান, নারী-শিশু, বৃদ্ধ ও নিরীহ নাগরিকগণ মসজিদে অবস্থান নিলে তাদেরকে অগ্নিসংযোগ করে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়।  একইভাবে প্রতারণার মাধ্যমে জাহাজে চড়িয়ে আগুন লাগিয়ে হত্যা করা হয়।  খৃষ্ট জগতে বা মুসলিমবিদ্বেষী খৃষ্টান রাজ-রাণীর এ আনন্দঘন পৈশাচিকতার ঐতিহাসিক স্মারক দিবসই হচ্ছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির 'এপ্রিল ফুল'।

আচ্ছা, ভালো!

কর্ডোভা ছিল স্পেনে মুসলিম খেলাফতের রাজধানী। শেষ খলিফা আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ১২ (স্প্যানিশ নাম বোয়াবদিল) ছিলেন আফ্রিকার মুর গোত্রের লোক। তিনি যুদ্ধে পরাজয়ের পরে রানি ইসাবেলা ও তার স্বামী রাজা ফার্ডিনান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেন ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি। প্রতিটি ইতিহাস বইতে এ ঘটনাটা বিখ্যাত হয়ে আছে 'দি লাস্ট সাই অব দি মুর' অর্থাৎ 'মুর-এর শেষ দীর্ঘশ্বাস' নামে। পরাজয়ের পর তিনি স্পেন ছেড়ে যাবার পথে কর্ডোভার দিকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন, তাই এ নাম।

কেউ কেউ বলেন মুসলিম-নিধনের সময় রাজা ফার্ডিন্যাণ্ড ও তার স্ত্রী ইসাবেলা আনন্দ করে বলেছিলেন "ওহ মুসলিমস! হাউ ফুল ইউ আর" অর্থাৎ "ওহ মুসলিমস, তোমরা কি বোকা"! দাবিটা কোন ঐতিহাসিকের কোন দলিল থেকে এলো জানিনা। তবে ঘটনাটা সত্যি হলেও হতে পারে কারণ যুদ্ধে বিজয়ী পক্ষ সাধারণত পরাজিতদের ওপরে নিষ্ঠুর অত্যাচার করে। রানি ইসাবেলা অত্যন্ত নিষ্ঠুর ছিলেন, তিনি লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে হত্যা ও স্পেন থেকে বিতাড়িত করেছিলেন, – সবই আছে পশ্চিমা গবেষকদেরই লেখা ইতিহাসে।

কিন্তু কর্ডোভায় মুসলিম জনতাকে প্রাণভিক্ষার প্রতিশ্র্রুতি দিয়ে মসজিদে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে মারার মতো এতবড় ঘটনা কোনো নিৰ্ভরযোগ্য ইতিহাসে পাওয়া যায়না। বিজয়ীরা সাধারণত পরাজিতদের ওপরে প্রতিশোধ নেয়া বা ক্ষমা করা যাই হোক, করে থাকে বিজয়ের উত্তেজিত দিনেই, তিনমাস পরে নয়। যেমন নবীজী (স) মক্কা বিজয়ের সময় (সাত/আট জনকে ছাড়া) সবার প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন বিজয়ের দিনেই, তিনমাস পরে নয়। তারপরেও, নিশ্চয় করে বলা না গেলেও, ঘটনাটা ঘটে থাকতে পারে। 'এপ্রিল ফুল' দিবস কোত্থেকে এলো তার ওপরে বিশদ কাজ করেছেন পূর্ব-পশ্চিমের মুসলিম-অমুসলিম গবেষকরা, এ ব্যাপারে অনেক থিওরি আছে। কিন্তু নিঃসন্দেহে হওয়া যায়নি।

'এপ্রিল ফুল'-এর উৎস প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু বোকা বানাবার প্রমাণিত ঘটনা আছে ইতিহাসে। একটি রাজবংশ ৬৬১ সাল থেকে ক্রমাগত ৮৯ বছর রাজত্ব করেছিল। তারপর তাদেরই সাথে রক্তের সম্পর্কে আত্মীয় এক বিদ্রোহী দল বেশ কয়েকটা যুদ্ধের পর 'যাব' স্থানের যুদ্ধে সেই রাজবংশকে উচ্ছেদ করে নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। বিজয়ী দলের আশংকা ছিল পরাজিত দলের আর কেউ আবার যুদ্ধ শুরু করে কিনা, কারণ সেই সময়ের আগে পরে বহু বছর ধরে রাজাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছাড়াও এই দলের বিরুদ্ধে ওই দলের আর ওই দলের বিরুদ্ধে অন্য দলের বহু যুদ্ধ বিগ্রহ হচ্ছিল। তাই বিজয়ী রাজা তার ক্ষমতা স্থিত হবার পর 'সমঝোতা'র জন্য পরাজিত রাজবংশের সবাইকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে এক ডিনার পার্টিতে আমন্ত্রণ জানায়।

পরাজিত রাজবংশের ৮০ জন সদস্য উপস্থিত হলে তাদের সসম্মানে অভ্যর্থনা করে সুবিশাল ডিনার হলে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে সুবিশাল ডিনার টেবিলে প্রচুর সুস্বাদু খাদ্য সাজানো ছিল। ওদিকে পাশের ঘরে ইঙ্গিতের অপেক্ষায় ছিল অস্ত্রধারী ঘাতকের দল। পরাজিত রাজবংশের সবাই খেতে বসার সাথে সাথে ইঙ্গিত পেয়ে ঘাতকের দল ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে কিছু বুঝবার আগেই নৃশংসভাবে তাদেরকে কচুকাটা করে। সেই হুলুস্থুলের মধ্যে মাত্র একজন পালাতে পেরেছিলেন।

সেই পরাজিত রাজবংশ উমাইয়াদ খলিফারা, সেই বিজয়ী বংশ আব্বাসীয় খলিফারা। দু'দলই মক্কার কোরেশ বংশের দুই উপধারা। বোকা বানাবার এই নৃশংস বিশ্বাসঘাতকতা যে শহরে ঘটেছিল তার নাম আবু ফুর্টাস, মুসলিমের হাতে মুসলিম-গণহত্যার সেই মর্মান্তিক তারিখটা ছিল ২২ জুন, ৭৫০ সাল। যিনি পালাতে পেরেছিলেন তিনি আইবেরিয়ান উপদ্বীপ হয়ে স্পেনে চলে যান। তিনিই স্পেনের খেলাফতের বাদশাহ 'আল দাখিল' যাকে আমরা খলিফা আবদুর রহমান-১ বলে জানি।

তাহলে বোকা দিবস কোনটা?  প্রশ্নবিদ্ধ ১ এপ্রিল, নাকি প্রমাণিত ২২ জুন?  নাকি দুই-ই ?

কিছু আলেম-মওলানা ক্ষিপ্ত উগ্র হয়ে ওঠেন যখনই আমরা আত্মসমালোচনার জন্য খেলাফত আমলে মুসলিম-মুসলিমে হানাহানি রক্তপাতের উদাহরণ দেই যাতে আমরা সেই হিংস্রতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। তারা কি খেলাফত আমলে বিশ বাইশটা "আমিরুল মুমেনীন" নামে রাজরাজড়ার মুসলিম-মুসলিমে ক্রমাগত হানাহানি রক্তপাতের ইতিহাস এড়িয়ে  যেতে চান? কোরান কি বলেনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করো তোমাদের স্বজনের বিরুদ্ধে হলেও?

দুনিয়া এমনিতেই হানাহানি হিংস্রতায় ভরে গেছে। অতীতের সত্য মিথ্যা, যত হিংস্রতা সেসব অতীতেই থাকুক, এখন কোন ধর্মের কোন ধর্মগুরু যেন সে আগুন আবার টেনে এনে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দগ্ধ না করেন। তারা যেন আমাদেরকে পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা হানাহানি নয় বরং সহযোগিতায় অতীতের হিংস্রতা অতিক্রম করে যাবার পথ দেখান। তাহলেই আমরা সব ধর্মের সাধারণ মানুষেরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে এই সুন্দর গ্রহটা ভাগাভাগি করে বাঁচতে পারব।

দেশে কিছু ইসলামী বক্তার হিংস্র হুংকার ইসলামের সীমা ছাড়িয়ে গেছে, তারা ব্যর্থ করেছেন কোরানের হুকুম – "ধর্মে বাড়াবাড়ি করোনা"- সুরা মায়িদা ৭৭ ও নিসা ১৭১।

ক্রমাগত এতো হিংস্রতা প্রচার করার পরেও দেশে সবচেয়ে বেশি বাক-স্বাধীনতা তারাই ভোগ করেন, তাদের লাগাম টেনে ধরার কেউ নেই। অনতিবিলম্বে এটা বন্ধ হওয়া দরকার এবং দায়িত্বটা প্রধানত: শান্তিকামী আলেমদেরই।

পহেলা এপ্রিল এক খবরে দেখলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছয়টি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে আছে বক্তাদের আয়ের ওপর আয়কর বসানো এবং ওয়াজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য প্রদানকারীদের আইনের আওতায় আনা। কিন্তু দায়িত্বটা শুধু সরকারের নয়, দায়িত্বটা শান্তিকামী আলেমদেরও কারণ তারা দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপরে প্রভাব রাখেন। আইনের এই নিয়ন্ত্রণ খুব দরকারী এবং মুসলিম বিশ্বে এটা নুতন কিছু নয়।

১. ওয়াজে খোৎবায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের বিরুদ্ধে আইন করেছে আরব আমিরাত – সূত্র – আমেরিকা ও ক্যানাডার প্রাচীনতম বাংলা পত্রিকা দেশে-বিদেশে, ২১শে জুলাই ২০১৬।

২. সৌদি আরব আইন করেছে ওয়াজে খোৎবায় রাজনীতি মেশানো যাবেনা, বলেছেন ইসলামী বিষয়ক মন্ত্রী সালেহ আল শেখ – এশিয়া নিউজ ১লা এপ্রিল, ২০১৪।

৩. "ইমামদের ওপরে কুয়েত ও সৌদি আরব নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করছে … কুয়েত সরকার ওয়াজগুলোকে পর্যবেক্ষণ (মনিটর) করছে, এক ইমামকে টিভিতে নিষিদ্ধ করেছে ও এক বিদেশি ইমামকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে" – রয়টার্স, ২৫ নভেম্বর ২০১৩।

সবাইকে সালাম।