হে অট্টালিকার মালিক বিবেক কি জাগ্রত হবে?

জিয়া আহমেদ
Published : 6 April 2019, 01:18 PM
Updated : 6 April 2019, 01:18 PM

কবি নবারুণ ভট্টাচার্য তার কবিতায় বলেছিলেন- 'এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না'। আজ তার কথায় সুর রেখে বলা যায়, 'এই মৃত্যুকূপ নগরী আমাদের না'। তাহলে কারা এ নগরীর মালিক? তাহলে কারা এ নগরকে বিষাক্ত করেছে? বসবাসের অযোগ্য করেছে? কারা তুলেছে অপরিকল্পিত সুউচ্চ ভবন?

এ তালিকায় রয়েছে ভূমিখেকো, দূষণকারী এবং এসব অপরিকল্পিত ও অস্বচ্ছ কাজের স্বীকৃতিদানকারীরা।

ঢাকার মতো চারশ বছরের ঐতিহ্যবাহী শহর কতটা ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে কালের বিবর্তনে সেটি এর সাদাকালো পুরাতন ছবিগুলো দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়। মুঘল আমল, ইংরেজ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতার কিছু কাল পর পর্যন্ত ঢাকা বসবাসের জন্য অনেক আরামপ্রদ শহর ছিল। এই তিলোত্তমা নগরী আজ কতটা অনিরাপদ এবং অনিশ্চয়তার- তা কেবল যারা এখানে বাস করছেন তারাই জানেন।

দুর্যোগ, বিশেষ করে মানবসৃষ্ট দুর্যোগের নগরী হয়ে উঠেছে ঢাকা। বসবাসের অযোগ্য দ্বিতীয় শহর, ও বায়ুদূষণের দিক থেকে প্রথম ১০টি শহরের একটি।

গত ৫ বছরে ৬৪৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে দেশে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে ঢাকা কিংবা এর আশেপাশের জায়গাগুলোতে। আগুন লাগার কারণগুলোর মধ্যে বিদ্যুতের শর্ট সাকিট ছিল অন্যতম।

দ্বিতীয় ছিল গ্যাস কিংবা সিলিন্ডার চুলা থেকে আগুন লাগা। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে আমরা জেনেছি, এ পাঁচ বছরে শতকরা ৩৭ শতাংশ আগুন শর্ট সার্কিট থেকে লেগেছে। আর চুলা থেকে লাগা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল ২৪ শতাংশের কাছাকাছি।

এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার মধ্যে- ২০১০ সালের ৩জুন পুরান ঢাকার নিমতলিতে প্রায় ১২৪জন, ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরিন গার্মেন্ট এ ১১১ জন, গত বছর রাজধানীর হাজারিবাগের বউবাজারে ১১জন নিহত হন। এই রকম আরও অনেক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতদের ছোট-বড় পরিসংখ্যান রয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে এসব অগ্নিকাণ্ডের দায়ভার কার উপর কতটুকু বর্তায়! সম্প্রতি এফআর টাওয়ার অগ্নিকাণ্ড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে সবচেয়ে অভিজাত এলাকাগুলোও ঝুঁকির বাইরে না।

ঢাকার অগ্নিকাণ্ডের যেকোনও ঘটনায় প্রথমেই আসে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর নাম।

এ সংস্থাটির কর্মযজ্ঞের আওতা জানার ইচ্ছা ভীষণ। রাজউকের নামে জনগণের অভিযোগের পাল্লাটা অনেক ভারী। রাজউকের কার্যাবলী শুধু খাতা কলমে বলেই তাদের অভিযোগ। যদি তাই হয়, তাহলে 'বিল্ডিং কোড' শব্দটা হারিয়ে গেছে হয়তো!

আমাদের দেশে খুব কম সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের কাজের মধ্যে সমন্বয় থাকে। যেমন, রাজউকের আইনে আছে ১০ তলা পর্যন্ত ভবনে অগ্নি-ব্যবস্থাপনা অনুমোদিত হতে হবে। আর ফায়ার সার্ভিসের আইন অনুযায়ী ৬ তলার বেশি উঁচু ভবন করলে অনুমোদন নিতে হবে এবং অগ্নিব্যবস্থাপনা থাকতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে এই দুই প্রতিষ্ঠানের আইনের মধ্যে সমন্বয় নেই কেন? রাজউক, ফায়ার সার্ভিস এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকা উচিত। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলী নির্দিষ্ট করা এবং যে প্রতিষ্ঠানের যে দায়িত্ব তা সুষ্ঠুভাবে পালন করা উচিত।

আমাদের দেশে, বিশেষ করে ঢাকা শহরের ভবন মালিকদের একাংশের পেট একটু বেশি মোটা। মানুষের মৃত্যুঝুঁকি প্রকট জানা সত্ত্বেও ভবনের অনুমতি যত তলা পর্যন্ত নেওয়া থাকে, এসব ভবন মালিকরা তার চেয়ে কয়েক তলা বেশি সম্প্রসারণ করেন এবং এমন কি ছাদের উপরে চিলেকোটা বানিয়ে তা হরহামেশাই ভাড়া দেন।

ফায়ার সার্ভিস থেকে অনেক বাড়ির মালিককে নোটিশ দেওয়া হয়। খুব কম সংখ্যক বাড়ির মালিকই তা গ্রাহ্য করেন। কারণ তাদের অগ্নি ব্যবস্থাপনার দরকার নেই। কিন্তু যখন কোনও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে সবার আগে তাদেরকে সেই ফায়ার সার্ভিসের দ্বারস্থ হতে হয়।

আমরা যতই দোষ চাপিয়ে দেই আমাদের দেশের ফায়ার সার্ভিস অত্যাধুনিক নয়। তাদের যুগোপযোগী যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে।

পাশাপাশি বিল্ডিং কোড না মানা, ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় না থাকা ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যা তো রয়েছেই।

তবে আমার দৃষ্টিতে আসল দোষী ভবনমালিকরাই। তারা জানেন তাদের ভবনটি নিরাপদ নয়। তা জেনেও দিব্যি ভাড়া দিচ্ছেন এবং অগ্নিব্যবস্থাপনার কোনও উদ্যোগ নিচ্ছেন না।

সমাধান এক জায়গাতেই রয়েছে। আগে ভবন মালিকদের সচেতন হওয়া। তাদেরকে বাধ্য করা ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখার ব্যবস্থা করা। নাহলে আগুনে প্রাণহানির পরিমাণ কমবে না।

সরকারের উচিত রাজউক, ফায়ার সার্ভিস এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় রেখে একটা বিশেষায়িত সেল ঘটন করা।

প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকাসহ বড় বিভাগীয় শহরগুলোতে এই সেল কাজ করবে।  সেলের কাজ হবে বিল্ডিং কোড ও অগ্নি-নিরাপত্তাসহ ভবনে মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি যাচাই-বাছাই করা।

ভবন নিরাপত্তায় গাফিলতিকারীদের কঠোর আইনের মুখোমুখি করাটাও এখন সময়ের দাবি। কেননা, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বিচার বা শাস্তিহীনতার নজিরের সংস্কৃতি থাকায় ফায়ার সার্ভিস ও রাজউক এর নোটিশ ও আইন অবজ্ঞা করতেও অসাধু ভবনমালিকরা ভয় পান না।

ঘটনা ঘটার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং তদন্ত কমিটি তাদের কাজ শেষ করে ঠিকই, রিপোর্টও দেয়। কিন্তু কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ কেন নেওয়া হয় না তা বোধগম্য নয়। অনেক সময় এমনও দেখা গেছে, সুপারিশ বাস্তবায়ন কোন প্রতিষ্ঠানের আওতায় তা নিয়েও দ্বন্দ্ব বা ধোঁয়াশা রয়েছে।

এই বিষয়টি সরকারের উর্ধ্বতন মহলের দৃষ্টিগোচর হওয়া উচিত।

উন্নত দেশেও যে মানবসৃষ্ট দুর্যোগের প্রাণহানি ঘটে না এমনটা নয়। আমরা দেখেছি ২০১৭ সালের লন্ডনের ২৪ তলায় ভবন গ্রিনফল টাওয়ারে আগুন লেগে ৭০জনের মতো মানুষ মারা যান এবং ৭৯ জন মানুষ আহত হন।

এই ঘটনা পৃথিবীর অগ্নিকাণ্ড সংশ্লিষ্ট অন্যতম একটি ঘটনা যা সুউচ্চ ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন জাগানোর মতো ছিল।

সুউচ্চ ভবনের নিজস্ব অগ্নিনিরাপত্তা সিস্টেমে ফায়ার এক্সটিংগুইশার, স্মোক অ্যালার্ম, স্প্রিঙ্কলার, হাইড্রেন্ট ইত্যাদি থাকা জরুরী। দুর্যোগকালীন যাতে সহজেই বেড়িয়ে আসা যায় তার জন্য বিকল্প প্রশস্ত সিঁড়ি থাকা দরকার তবে তা অবশ্যই বাঁধা মুক্ত অর্থাৎ কোনওরকম জটলা ছাড়া থাকতে হবে। সবচেয়ে বড় যে বিষয় তা হচ্ছে ভবন মালিকদের বিবেককে জাগ্রত করা।

অদ্ভুত এক শহর ঢাকা, যেখানে ক্লান্তিহীন মানুষ এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরির সাথে বসবাস করে। সব জায়গায়, অলিতে-গলিতে, আনাচে-কানাচে ঝুঁকি আর ঝুঁকি।

কবি শামসুর রহমান তার 'এ শহর' কবিতায় বলেছিলেন- 'এ শহর প্রত্যহ লড়াই করে বহুরূপী নেকড়ের সাথে।'

বহুরূপী নেকড়েদের দৌরাত্ন্য কমুক, ঢাকা শহরকে তার আগের জায়গায় ফিরে নেওয়া যাবে না এ কথা যেমন সত্য তেমনি বিবেকের জাগরণ ব্যতীত দুর্যোগ প্রতিরোধ অসম্ভব।

এফআর টাওয়ারের আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া এক যুবক সেদিনের পর থেকে আর ঘুমাতে পারছেন না। ঘুমাতেই গেলেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠে আগুনের লেলিহান শিখা, যা পুড়ে ছাই করে দিচ্ছে সবকিছু। সে ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করছে নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতা-

"কিছু একটা পুড়ছে

আড়ালে, বেরেতে, তোষকের তলায়, শ্মশানে

কিছু একটা পুড়েছেই

আমি ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছি

…….

কিছু একটা পুড়ছেই

হল্‌কা এসে লাগছে আঁচের

ইমারত, মূল্যবোধ, টাঙানো বিশাল ছবি

প্রতিশ্রুতি, টেলিভিশন, দুপ্তপ্রাপ্য বই

কিছু একটা পুড়ছে…"

হে সুউচ্চ ভবনের অধিপতিরা আশা করছি আপনাদের সুপ্ত বিবেক জাগ্রত হবে। তাহলে আমাদেরকে আর দেখতে হবে না স্বজন হারা মানুষের আর্তনাদ।