দাম বৃদ্ধির ফায়দা

কিউ আর ইসলাম
Published : 5 July 2012, 08:04 AM
Updated : 5 July 2012, 08:04 AM

দ্রব্যমূল্য এখন লাফিয়ে বৃদ্ধি পায়। একই জিনিস আজকে যে দামে বিক্রি হবে আগামীকাল সেই একই মূল্যে পাওয়া যাবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। ফলে আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রাখা এখন খুবই মুষ্কিল। বিশেষ করে যাদের আয় সীমিত। দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ যেন এখন সরকারের আয়ত্বের বাইরে। ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিটি দল দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ করবে বলে অঙ্গীকার করে। কিন্ত ক্ষমতায় পাওয়ার পর সরকারকে এ ব্যাপারে অপারগ মনে হয়। এমনকি বিরোধী দলও ইদানিং দ্রব্যমূল্য নিয়ে আগের মত আর হৈচৈ করে না। হঠাৎ মনে হল এমনটা নয় তো –
সরকার দলীয় নেতাঃ ভালো আছেন ভাই?
বিরোধী দলীয় নেতাঃ ভালো আর থাকলাম কই যেভাবে এই গরমে জেল খাটালেন।
সরকারঃ আপনার দল রাস্তায় না যেয়ে সংসদে গেলেইতো পারে। তাহলে আর এই দশা হয় না।
বিরোধীঃ সংসদে যে ভাবে আমাদের আক্রমণ করেন এতে আপনাদেরই দলীয় কর্মীদের উৎসাহ বেড়ে যায়। আমরা আর এই সুযোগ দিতে রাজী নই।
সরকারঃ আরে ভাই আপনারাওতো আবার ক্ষমতায় আসবেন। তখন না হয় আমরা সংসদে যাবো।
বিরোধীঃ যেয়েতো একই কাজ করবেন। আর ক্ষমতায় এসেই বা লাভ কি?
সরকারঃ মানে?
বিরোধীঃ সবকিছুরইতো দাম বাড়িয়ে দিলেন। গ্যাস, ডিজেল, তেল, ডিম। চিনির দাম ডবল করে দিলেন। কিছুই বাদ থাকল না। আমরা এসে কিসের দাম বাড়াবো। সরকারের তো একটাই কাজ। দাম বাড়িয়ে দেয়া।
সরকারঃ দাম বাড়িয়ে দেয়ায় কোন প্রতিবাদ করলেন না কেন? হরতালও দিলেন না।
বিরোধীঃ দু'দলে একই কাজ করে লাভ কি? আমরা দাম বাড়িয়ে দিলে আপনারা হরতাল দেন। আর আপনারা বাড়িয়ে দিলে আমরা দেই। আমরা ডিজেল-পেট্রোলের দাম বাড়িয়ে একবারে প্রায় ডবল করে দেয়ার পর আপনারা হরতাল দিলেন। পরের বার আপনারা একবারে পঞ্চাশ পার্সেন্ট বাড়িয়ে দিলেন আমরাও হরতাল দিলাম। সমানে সমান।
সরকারঃ জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিলে ক্ষতি কী? দেখছেন না যত দাম বৃদ্ধি পায় ততই বিক্রি বেড়ে যায়। গত বছরের পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানাভিত্তিক আয়ব্যয় জরিপ দেখেছ্নে? আপনাদের সময় চিনির দাম প্রতি কেজি পঁয়ত্রিশ টাকা ছিল। কিন্তু জনপ্রতি চিনি খেত বছরে দু' কেজি নয় শত সাতান্ন গ্রাম। বর্তমানে চিনির দাম বেড়ে ষাট টাকার বেশী হলেও খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে বছরে তিন কেজির উপরে চলে গেছে। আপনাদের সময় বছরে ছয় -সাত লক্ষ টন চিনি আমদানী করেছেন। আমরা আমদানী করছি দেড়গুণ বেশী। এই কয়েক মাস আগেও এক শত বাষট্টি কোটি টাকা খরচ করে পঁচিশ হাজার টন চিনি আমদানী করা হয়েছে। ডিমের দাম বেড়ে এখন দশ টাকার উপরে। কিন্ত মানুষের খাওয়া কমেনি। আপনাদের সময় দাম পাঁচ টাকা হলেও খেত বছরে চল্লিশটি। দেখেছেন গ্যাস, ডিজেল, প্যাট্রোল, অকটেনের দাম বাড়িয়েছি। গাড়ীর আমদানী শুল্ক বাড়িয়েছি। ট্যাক্স বসিয়েছি। সাথে সাথে রাস্তাঘাটে নতুন নতুন গাড়ীতে ভরে গেছে। আরো একটা উদাহরণ দেই।
বিরোধীঃ কোনটা?
সরকারঃ সারা বছরে জিনিসপত্রের দাম সবচেয়ে বেশী কখন হয়? খাদ্য, কাপড়চোপড়, আসবাবপত্র, সোনা গহনা, ট্রেন বাসের টিকিট সবকিছুরই দাম বেড়ে যায় কোন মাসে?
বিরোধীঃ ঈদের আগে রমজান মাসে।
সরকারঃ করেক্ট। আর এই মাসেই সবচেয়ে বেশী বিক্রি হয়। দাম বেড়েছে বলেইতো বেশী বিক্রি। গতবার আপনারা যখন দেশের অর্থনীতি খারাপ বলে আমাদের নাজেহাল করছিলেন তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী ঈদের বাজার দেখিয়ে জবাব দিয়েছিলেন যে দেশের অর্থনীতি খারাপ হলে এতলোক কেনাকাটা করে কিভাবে। আমরা এখন অর্থনীতি বুঝে গেছি।
বিরোধীঃ মানে।
সরকারঃ বেশী দামে বেশী বিক্রি। বেশী বিক্রিতে বেশী লাভ। বেশী লাভে বেশী আয়। দেখেননি আমদের অর্থমন্ত্রী কী বলেছেন। মানুষের আয় ডবল হয়ে গেছে। সস্তায় জিনিস কিনতে কে দৌঁড়ায়? গরীবেরা, যাদের আইডি কার্ডই নেই। ভোটারই হতে পারেনি। তাহলে জিনিসপত্রের দাম সস্তা রেখে লাভ কি?
বিরোধীঃ বাহ, ভালোই আবিষ্কার করেছেন।
সরকারঃ আরে এটা আমাদের আবিষ্কার নয়। গোপনে বলি এটা এরশাদের আবিষ্কার। আমরা যাকে স্বৈরাচার বলি। শুনলে আবার উনি দুঃখ পাবেন। মনে নেই ওনার সময়ে চিনির দাম যেই বারো থেকে বেড়ে বত্রিশ টাকা হল সবাই কিনতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিছু দিনের জন্য চিনির নামই বদলে গেল। দোকানে যেয়ে বলতে হত এক কেজি 'জাফর' দিন। বাজারে খেয়াল করে দেখবেন, যে ইলিশ মাছটার দাম দুই বা আড়াই হাজার টাকা সেইটা আগে বিক্রি হয়। সস্তা দামেরটা বিক্রির জন্য নিয়ে বসে থাকতে হয়।
বিরোধীঃ আরো একটা উদাহরণ দেই। কোরবানীর গরুর দাম যখন বেড়ে যায় তখন সবাই হৈহৈ করে হাটের দিকে ছুটতে থাকে। যে দামেই হোক গরু কিনে তবে বাড়ী ফিরে। গত বছর ব্যাপারিরা গরু ট্রাকে ভরে চুপচাপ হাটের কাছাকাছি রেডি হয়ে বসে ছিল। এদিকে রটে গেল হাটে গরু নেই। মুহূর্তে দাম বেড়ে গেল। কোরবানী মিস হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে সবাই গরু-ছাগলের হাটে দৌঁড় দিল। এই সুযোগে ব্যাপারিরা এক এক করে ট্রাক খালি করতে লাগল আর বেশী দামে বিক্রি হয়ে তাদের পকেট ভারী হল।
সরকারঃ বিদেশ থেকে সস্তা মাল বাজারে এনে দাম বাড়িয়ে ছেড়ে দিন। যে দামই হোকনা কেন সাফ হয়ে যাবে।
বিরোধীঃ জিনিসপত্রের দাম আমরাও বাড়িয়েছি। কিন্তু মনে হচ্ছে ফায়দা নিতে পারি নাই।
সরকারঃ কী রকম?
বিরোধীঃ এদেশে প্রথম আমরাই ভ্যাট চালু করি। রেস্টুরেন্টে, মিষ্টির দোকানে, সিগারেটের উপর ভ্যাট বসিয়ে দেই।
সরকারঃ এই ভ্যট বসিয়ে দেয়ায় রাজস্ব আয় কতটা বাড়িয়েছেন জানি না। তবে আপনাদের জন্য অবশ্য রেস্টুরেন্ট ও মিষ্টির দোকানের সংখ্যা আর সিগারেটের উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। গলিতে গলিতে এখন রেস্টুরেন্ট ও মিষ্টির দোকান। একবেলা খেতে গেলে একশ টাকার উপরে। এককেজি মিষ্টির দাম তিন থেকে পাঁচ শত টাকা। কোন কোন দোকানে তার থেকেও বেশী। সবাই খাচ্ছে, মিষ্টি কিনছে।
বিরোধীঃ ঠিকই বলেছেন, দাম বাড়িয়ে দিলেই বিক্রি বেশী। মোটা চাল পলিশ করে সরু আর সাদা বানিয়ে দিন দাম ডবল করে দিন সবাই কিনবে। শুকিয়ে যাওয়া সব্জি পানি মেরে, রং দিয়ে টাটকা বানিয়ে দাম বাড়িয়ে দিন ক্রেতার অভাব নেই।
সরকারঃ তাপরপর সোনার দাম দেখেছেন? বাড়তে বাড়তে প্রতিভরি ৫০ হাজার টাকার উপরে। কিন্তু এতে কি কেনাকাটা বন্ধ হয়েছে? শহরে কোথাও কোন জুয়েলারী দোকান বন্ধ হয়েছে? বরং দামী দামী জায়গায় নতুন খোলা হচ্ছে।
বিরোধীঃ কিন্তু গ্রামে যে ধানের দাম তো কমে গেল ভাই।
সরকারঃ আরে ভাই একটা জিনিষের দাম কমলেও অন্যগুলোতো বেড়েছে। সারের দাম বেড়ে চার গুণ হয়েছে। ডিজেলের দাম প্রায় ডবল। তাছাড়া গ্রামে দাম কম হলেও শহরেতো বেশী। আর দেখছেন না গ্রাম থেকে সবাই এখন শহরে ছুটছে। কেউ আর গ্রামে থাকতে চাচ্ছে না। শহরে এসে বেশী দামে কেনার জন্যেইতো এই ছুটাছুটি। দাম বাড়লে সরকারের জন্যেও অনেক সুবিধা।
বিরোধীঃ যেমন।
সরকারঃ লোকে কম খাবে। দূর্ভিক্ষের সম্ভাবনা থাকবে না। জিনিসপত্রে বাজার ভরা থাকবে। পকেটে টাকা বেশী থাকলেই কিনতে পারবেন। বাজারে খাদ্য ও জিনিসপত্রের অভাব বলে সরকারকে বদনাম করার সুযোগ পাবেন না। আর খাবারদাবারে যা ভেজাল এতে কম খাওয়াটাই এখন ভালো। রোগব্যাধি কম হবে। স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। হাসপাতালে ভিড় কম হবে। আরো সুবিধে আছে।
বিরোধীঃ কী সুবিধা?
সরকারঃ দাম বাড়লে খরচের ভয়ে লোকজনে রাস্তাঘাটে কম বের হবে। যানজট কম হবে। কিছুদিনের মধ্যে বিদ্যুতের দাম একবারেই বেশী বাড়িয়ে দেয়ার কথা হচ্ছে। বেড়ে গেলে দেখবেন বিদ্যুৎ আর আগের মত খরচ হবে না। দাম বৃদ্ধির ফলে খরচ কমে যাবে। লোডশেডিংও কমে যাবে। সরকারের সুনাম হবে। এরই মধ্যে দাম বৃদ্ধিতে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে দেশের ও সরকারের সুনাম ।
বিরোধীঃ কি ভাবে?
সরকারঃ সবাই এখন বাংলাদেশে বাজার খুঁজতে আসছে। নিজের দেশের মাল বিক্রি করতে আসে। দেখছেন না বাজারে এখন ভারতীয় আর চীনের তৈরি মালে ছড়াছড়ি। কানাডা থেকে ডাল কিনছি। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফল আনছি। আপনাদের সময় বেশীরভাগ দেশী মাল পাওয়া যেত।
বিরোধীঃ দাম বাড়লে মনে হয় দেশেরও আয় বাড়বে। বিদেশীদের বাংলাদেশে এসে বেশী বেশী দামে কিনতে হবে। বেশী খরচ করতে হবে। আমরা যেমন ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরে গেলে দু'দিনেই পকেট খালি হয়ে যায়।
সরকারঃ ঠিকই বলেছেন। তাছাড়া গ্লোবাল স্টান্ডার্ড এ পৌঁছাতে হলেও জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন। কয়েকদিন আগে বোম্বে মানে মুম্বাই গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের কথা শোনার সাথে সাথে ওনার বলে উঠতেন – আমাদের এখানে সবকিছুর দাম বেশী না? দামী শহরতো, সব ধনী লোকেরা থাকে। আপনার দেশতো গরীব, সবই সস্তায় পাওয়া যায়। বিশ রুপিয়াতে খানা খাওয়া যায়। আমিও উত্তর দিতাম সেদিন আর নেই।
বিরোধীঃ দাম বাড়লে জনগণ কি খুশী হবে?
সরকারঃ আরে ভাই জনগণের প্রয়োজন কখন হয়?
বিরোধীঃ ভোটের মানে নির্বাচনের সময়।
সরকারঃ এইতো পাকা রাজনীতিবিদের মত উত্তর দিলেন। যদি তাই হয় তাহলে নির্বাচনের সময় ভোটেরও দাম বাড়িয়ে দেবেন।
বিরোধীঃ টাকা দেবে কে?
সরকারঃ কেন শতকরা দশভাগ আসন ব্যবসায়ীদের দেবেন। বেশী হলে আরো ভালো। নিজের খরচ প্লাস অন্যেরটাও ফান্ডিং করবে। তবে ঋণখেলাপী কিনা দেখে নেবেন। সাধারণত এরাই বেশী খরচ করে।
বিরোধীঃ নির্বাচন এলেইতো আপনার দল 'দ্রব্যমূল্যের পার্থক্য' দেখিয়ে পোস্টার বের করে। এবার আমরা এই পোস্টার বের করব।
সরকারঃ বের করে দেখেন কোন কাজ হয় কিনা। আমাদের পোস্টারে এবার থাকবে 'দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতেই দেশের অগ্রগতি'।

কিউ আর ইসলাম: কৃষি, পানি ও পল্লীউন্নয়ন বিশ্লেষক।