এ সময়ের ছাত্র আন্দোলনের প্রবণতা ও গতিপ্রকৃতি: বামপন্থিদের দায়

অভিনু কিবরিয়া ইসলাম
Published : 4 April 2019, 09:03 AM
Updated : 4 April 2019, 09:03 AM

এই সময়ে আন্দোলনের ধরন এবং তাতে সংগঠিত প্রগতিশীল শক্তি বা রাজনৈতিক সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে ইদানীং বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। ডাকসু নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের বিপরীতে আন্দোলনভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কিছু সফলতা এই প্রশ্নকে আরো সামনে নিয়ে আসছে। কোটা সংস্কার কিংবা নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কী, এ ধরনের আন্দোলনে প্রচলিত ধারার সংগঠনের আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কী না, ইত্যাদি আলোচনা হালেও পানি পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলোর ব্যর্থতা, সংকীর্ণতা ইত্যাদি বিষয়কে সামনে তুলে ধরে, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনই মুক্তির পথ কি না সেটাও ঘুরেফিরে বারবার আলোচনা হচ্ছে। প্রতিবাদের জন্য কোন মতাদর্শের গুরুত্ব আদৌ আছে কি না, আন্দোলনকে 'রাজনৈতিক' চেহারা দেওয়া, আন্দোলনের দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক কি না, সে বিষয়গুলো নিয়েও নানা ধরনের মতামত আমরা দেখছি। এ বিষয়গুলো নিয়ে নির্মোহ আলোচনা করার পটভূমি প্রস্তুত হয়েছে এখন।

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমান সময়ে ছাত্র আন্দোলনের আদর্শবাদী ধারাটিকে টিকিয়ে রেখেছে বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোই। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে তাদের যেমন সক্রিয় উপস্থিতি আছে, তেমনি যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদেও তাদের ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে সমাজে 'বাম' সম্পর্কিত যে স্টিগমা সৃষ্টি করা হয়েছে তার প্রভাবেই হোক, কিংবা ছাত্রসংগঠনগুলোর সংকীর্ণতা কিংবা দুর্বলতার কারণেই হোক, অথবা সাধারণভাবে শিক্ষার্থীদের বিচ্ছিন্নতা বা সংগঠনবিমুখতার কারণেই হোক, বাস্তবতা হচ্ছে বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলো বা তাদের জোট প্রকৃত অর্থে 'গণছাত্রসংগঠন' হয়ে উঠতে পারছে না। সংগঠনবহির্ভূত শিক্ষার্থীদের সাথে সংগঠন করা শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক গড়ে ওঠার জায়গা হচ্ছে আন্দোলন। আমরা দেখেছি বিভিন্ন আন্দোলনে সামনে কিংবা পেছনে থেকে বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলো নেতৃত্ব দিয়েছে, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের স্রোতকে তারা প্রভাবিত করে আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়েছে, এভাবেই তারা কিছুটা হলেও গণচরিত্র লাভ করেছে। কিন্তু অতিসম্প্রতি সেই ভূমিকাটি কী তারা পালন করতে পারছে? কিংবা কেন পারছে না? দায় কার? বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোর সীমাবদ্ধতা যে নেই তা নয়, কিন্তু পুরো বিষয়টিকে বুঝতে হলে এ সময়ের ছাত্রদের আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ও প্রবণতার দিকেও আমাদের নজর দেওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশে এই শতাব্দীতে সংগঠিত বড় আকারের ছাত্র আন্দোলনগুলোর দিকে আমরা যদি তাকাই, তাহলে দেখব, আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলো এবং সক্রিয়ভাবে সংগঠনের সাথে যুক্ত নয় এমন ছাত্রদের যোগাযোগের জায়গা তৈরি করেছে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম। 'ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ', 'গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য' কিংবা 'প্রগতিশীল ছাত্রজোট' যেগুলো ছাত্রসংগঠনের সম্মিলিত জোট- তারা বিভিন্ন আন্দোলন করলেও, বড় আন্দোলনে সেই প্ল্যাটফর্মে অনেক শিক্ষার্থীকে সম্পৃক্ত করা যায়নি। ২০০২ সালে শামসুন্নাহার হল আন্দোলনে গড়ে ওঠা 'নির্যাতনবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ' নামের প্ল্যাটফর্মটি ২০০৭-০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। শিক্ষার্থীদের ভেতরে গড়ে ওঠা সংগঠনবিমুখতাই কি সেইসব প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করেছিলো কি না, সেটিও ভাবার দাবি রাখে। তবে এইসব প্ল্যাটফর্মে বামপন্থি কর্মীরাই মূল ভূমিকা পালন করতো, সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়াতেও ছাত্রসংগঠনগুলোর অংশগ্রহণ থাকতো।

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে ব্লগারদের সামনে রাখা হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াতে ছাত্রসংগঠনগুলোই মূল ভূমিকা পালন করতো। রাজনীতিবিদদের গণজাগরণ মঞ্চে বক্তৃতা দিতে দেওয়া হয়নি, কেননা প্রচলিত রাজনীতির প্রতি এক ধরনের অবিশ্বাস জন্মেছিলো শিক্ষার্থীদের। কিন্তু সেই অবস্থাতেও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করেছিলো। কিন্তু সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেখা গেলো ভিন্নতর পরিস্থিতি। নতুন যে প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাতে বামপন্থিরা ছিলো না। কোটা আন্দোলনের শুরুর দিকে এ আন্দোলনে ছাত্রলীগের মদদ ছিলো নানা সমীকরণে, সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অধিকাংশ নেতাই ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ছিলো। এই আন্দোলনে অন্যান্য শক্তির তৎপরতাও ছিলো। বামপন্থিরাও এই আন্দোলনের সাথে থেকেছে, তারা মার খেলে প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেনি বা তাদের নিতে দেওয়া হয়নি। আবার নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের কোন কেন্দ্র ছিলো না, শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই গড়ে উঠেছে। সেখানে কোন সংগঠনেরই সেভাবে ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিলো না। আবার কোটা সংস্কার, সাত কলেজের আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে 'নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ' নামে যে প্ল্যাটফর্মটি গড়ে উঠেছে, সেটা গড়ে উঠতে বামপন্থিরা ভূমিকা রাখলেও, তাদের এই প্ল্যাটফর্মের একটি অংশের নেতৃত্বে ডাকসু নির্বাচনে 'স্বতন্ত্র জোট' নামের প্যানেল তৈরি হয় এবং বামপন্থিদের থেকে আলাদা হয়ে নির্বাচন করে তারা ভালো সাড়াও ফেলে।

কেন ছাত্র আন্দোলনে এই ধরনের প্রবণতা তৈরি হচ্ছে? প্রচলিত ছাত্র সংগঠনের বাইরে কেন নতুন নতুন ইস্যুভিত্তিক স্বতঃস্ফুর্ত সংগঠন গড়ে উঠছে? এই সময়ের ছাত্র আন্দোলনের প্রবণতা ব্যাখ্যা করতে হলে এ অঞ্চলের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ও তা গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটকেও বিবেচনায় নিতে হবে। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি এবং তাতে সংগঠনের ভূমিকার বিষয়গুলো কোন কোন বাস্তব কারণে বদলেছে, তাকেও বিবেচনায় নেওয়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে আমরা দেখি, ছাত্র আন্দোলনের বিকাশ ও গতিপথ আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল। কীভাবে? অল্প কথায় বললে আমরা দেখব, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ছাত্রসমাজের ভেতর দরিদ্র কৃষকশ্রেণির সন্তানদের সংখ্যার আনুপাতিক বৃদ্ধি ঘটে। এছাড়া, শাসকশ্রেণি গণবিরোধী শিক্ষানীতি ও পূর্ব বাংলায় শিক্ষা সংকোচনের নীতি গ্রহণ করলেও, স্থানীয় উদ্যোগে পূর্ববাংলায় অসংখ্য স্কুল কলেজ গড়ে ওঠে। নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক পরিবার থেকে আগত ছাত্ররাই বাংলাদেশে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত গড়ে ওঠার জায়গাটি প্রস্তুত করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপ, চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা এবং তার প্রভাবে ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম, সেসময়ে বহু তরুণকে রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ করে। একদিকে ছাত্রসমাজ তথা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মূলধারাটি তখনো ব্যাপকতর জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি, অপরদিকে জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও বামপন্থি ও জাতীয়তাবাদী ধারা বিকাশের বাস্তব সম্ভাবনা, এই দুই বাস্তবতাই ছাত্র আন্দোলনকে ক্রমশ র‌্যাডিকাল চরিত্র নিতে প্রভাবিত করে। ফলে, ছাত্রসমাজ এবং গণমানুষের মধ্যে এক নিবিড়, অর্গানিক যোগাযোগ এবং আন্তঃসম্পর্ক স্থাপিত হয়।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণদের মধ্যে আদর্শবাদী রাজনীতির ধারাটি বেশ শক্তিশালী ছিলো। ছাত্র তরুণদের সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন গণমানুষের সংগ্রামে তাদের সম্পৃক্ত করে। 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের' ডাকে হাজারো তরুণ আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত থাকে। মতিউল-কাদের শহীদ হন ভিয়েতনামে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে। এরপর সামরিক শাসকদের আমলে ছাত্র আন্দোলনকে কলুষিত করার সবরকম প্রচেষ্টা চললেও সে সময়কালের বিভিন্ন আন্দোলনে মেহনতি মানুষের সাথে শিক্ষিত রাজনীতিসচেতন জনগোষ্ঠীর দূরত্বটা এখনকার মত পর্বতসম হয়ে যায়নি। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে ছাত্রদের সাথে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ শরীক হয়েছিলো। এসময়কালেও আমরা দেখি কমরেড তাজুলের মত বীর যোদ্ধা, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও যুক্ত হন শ্রমিক আন্দোলনে, কিংবা শহীদ টিটো, যিনি ছাত্র আন্দোলনের সাথে সাথে যুক্ত হন ক্ষেতমজুর আন্দোলনে এবং উভয়েই স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে শহীদ হন। এ সময়কালে ছাত্র সংগঠনগুলো বা তাদের জোটই ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। যৌক্তিক দাবিতে ছাত্রসংগঠনের ব্যানারেই মিছিল করতে শিক্ষার্থীদের আপত্তি ছিলো না।

১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের ফলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলেও- তা হয়নি। ৯০-পরবর্তীতে গোটা দুনিয়াতেই এক বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। পতন হয় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের। এক মেরু বিশ্বের অধিপতি হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র। এদেশে অনেকেই সমাজতন্ত্রের শেষ দেখে ফেলেন। অনেক প্রগতিশীল তরুণ হতাশ হয়ে পড়ে- শিক্ষিত মধ্যবিত্তনির্ভর বামপন্থি আন্দোলনে তা বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই দুর্বলতার সুযোগে খুব সহজেই সিভিল সোসাইটিতে তৈরি হয় নিওলিবারেল চিন্তাদর্শনের আধিপত্য। সামরিক স্বৈরাচারের আমল থেকেই কর্পোরেট-বহুজাতিক কোম্পানী-এনজিওগুলো এদেশে বিস্তার লাভ করে, সেই সাথে তথাকথিত কর্পোরেট সংস্কৃতি। সমাজের মৌলিক সমস্যাগুলোর দিকে চোখ সরিয়ে নিয়ে, বিচ্ছিন্নভাবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, দারিদ্র্য বিমোচনের কিছু ইস্যুতে কথা বলতে থাকে তথাকথিত এনজিওনির্ভর সিভিল সমাজ, যাতে মুক্তবাজার নামক নয়াউপনিবেশবাদী ধ্যানধারণা আড়ালে চলে যায়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা তারা করে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রপরিচালনার মূলে যে অর্থনৈতিক নীতি তার সমালোচনা করে না। এসময়কালে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোও শাসকশ্রেণির স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত। ভোগবাদী জীবনদর্শন নিত্য-নতুন চাহিদা তৈরি করছে বিজ্ঞাপনের নামে। অ্যান্ড্রয়েড ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া তরুণদের মনোজগতে বিশাল প্রভাব বিস্তার করছে, ভার্চুয়াল জগতে অখণ্ড মনোযোগ বাস্তব জগতকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। গানে-নাটকে-সিনেমায়-সাহিত্যেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে ফুটে উঠতে খুব কমই দেখা যাচ্ছে।

অপরদিকে ক্রমবর্ধমান শিক্ষাবাণিজ্য, শিক্ষা উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রান্তস্থিত সমাজের বহু শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটেছে। উচ্চশিক্ষায় বাজারমুখী শিক্ষাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে- বাণিজ্যিকীকরণ ঘটছে। বাণিজ্যিকীকরণের ধারাবাহিকতায়, গত দুই দশকে একের পর এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হয়েছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও মানবিক মানুষ তৈরি করার পরিবর্তে কর্পোরেট চাকুরে তৈরি করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার বদলে ইনফরমেশনভিত্তিক খণ্ডিত বাজারি শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব, শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতা ও অন্ধ লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির শিকার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রকৃত উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক সৃষ্টিশীলতাকে উৎসাহিত না করে, শিক্ষার্থীদের সৃজনক্ষমতার বিকাশ না ঘটিয়ে, বাজার ব্যবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণ আত্মকেন্দ্রিক ক্যারিয়ারমুখি শিক্ষাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। যে যে বিষয়েই পড়াশোনা করুক, তার লক্ষ্য থাকছে সরকারি চাকরি বাগানো অথবা বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করা। এইসব বাস্তবতার ঘাত প্রতিঘাতে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে তৃতীয় প্রজন্মের সংকীর্ণ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের আনুপাতিক সংখ্যা বেড়ে গেছে, যারা অধিকাংশই প্রান্তস্থিত মানুষের থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন। আবার যারা সংগ্রাম করে একেবারে প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে উঠে আসছেন, তাদের অধিকাংশই আধিপত্যশীল ধ্যানধারনা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আত্মমুখী হয়ে উঠছেন, শেকড়ের টান আলগা হয়ে যাচ্ছে। ছাত্র আন্দোলনে এসব ঘটনাবলীর প্রভাব অনিবার্যভাবেই পড়েছে- অনিবার্যভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে সংগঠনবিমুখতা। শিক্ষিত তরুণদের এক বিরাট অংশ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছে-এবং ছাত্র-যুব আন্দোলনের প্রতি আস্থা হারিয়ে; ক্যারিয়ারসর্বস্ব, বিচ্ছিন্ন মানুষ হয়ে পড়ছে।

বর্তমান সময় সংগঠন ও রাজনীতিবিমুখতার আরো উর্বর ভূমি তৈরি করেছে। জাতীয় রাজনীতিতে গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে যেভাবে ভুলুন্ঠিত করা হচ্ছে, রাজনীতিতে একটি দলের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে কোন রাজনৈতিক শক্তিই সেভাবে দাঁড়াতে পারছে না। সুতরাং তার প্রভাবেও প্রচলিত রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতি অনাস্থা আসা স্বাভাবিক। এর মধ্যেও সমাজে বিদ্যমান নানা অসংগতি এবং শাসকশ্রেণির নিপীড়ন নিয়ে ছাত্ররা সচেতন হচ্ছে, লড়াই করতে চাইছে, কিন্তু প্রত্যেকটি অসংগতিকে তারা একেকটি বিচ্ছিন্ন বিষয় হিসেবে মনে করছে এবং এই অসংগতিগুলোর মধ্যেকার সংযোগসূত্রকে তারা খুঁজে পাচ্ছে না। সমাজবিকাশের মূলধারাকে তারা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছে, বাছবিচারবিহীনভাবে স্ট্রাকচারের সবকিছুকেই খারিজ করার নৈরাজ্যবাদী চিন্তার জগতে তারা পতিত হচ্ছে। উপরিকাঠামোর নানা অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা সংগ্রাম করতে চায়, সমাজ সম্পর্কিত বোধ গড়ে না ওঠা ও বর্তমান বাস্তবতাসৃষ্ট বিচ্ছিন্নতার কারণে কিন্তু অন্যায়-অবিচারের মূল দুর্গকে তারা চিহ্নিত করতে পারে না।

তবু, এই বাস্তবতায় যেকোনো ফর্মেই হোক, ক্ষমতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে শিশু কিশোর কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণেরা যে প্রতিবাদ করছে তা নিঃসন্দেহে আশার সৃষ্টি করে। তবে এই আন্দোলনগুলো একসূত্রে গাঁথা যাচ্ছে কি? গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন প্রাথমিক অবস্থায় শিক্ষিত তরুণরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে গড়ে তুললেও, সে আন্দোলনকে শেষপর্যন্ত শহুরে মধ্যবিত্তদের আন্দোলনের কানাগলিতে আটকে গেলো, শহুরে শ্রমিক ও গ্রামীণ কৃষিজীবী খেটে খাওয়া মানুষের সাথে শিক্ষিত সচেতন তরুণদের এই দূরত্বের সুযোগ নিলো মৌলবাদী শক্তি এবং সরকার। এমনকি সম্প্রতি কোটা সংস্কারের দাবিটিও পরিণত হতে পারতো কর্মসংস্থানের দাবিতে, যা সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে হয়তো সম্পৃক্ত করতে পারতো বৃহত্তর আন্দোলনে। আবার গার্মেন্ট শ্রমিকেরা যে আন্দোলন করছে, তার সাথে ছাত্র আন্দোলনের স্রোতধারা মিলতে পারছে না। ছাত্র আন্দোলনের সাথে গার্মেন্ট শ্রমিকসহ সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের দূরত্ব উভয়ের আন্দোলনকেই, ক্ষতিগ্রস্ত করছে, প্রকারান্তরে লাভবান করছে শাসকশ্রেণিকেই।

তবে এই ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনই ভবিষ্যতের আন্দোলনের সচেতন নেতৃত্ব তৈরি করতে পারে। উনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে রাশিয়ায় স্বতঃস্ফূর্ত শ্রমিক আন্দোলন কেবল নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিলো, তবে তার ধারাবাহিকতাকেই সে শতাব্দীর নব্বই-এর দশকে সচেতন শ্রমিক ধর্মঘট পালন শুরু হয়। লেনিন সে প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের উপাদানগুলো সচেতন আন্দোলনেরই ভ্রুণাবস্থা'। আশা করি, আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকেই শিক্ষার্থীরা যেমন শিক্ষা নেবে সংগঠিত হওয়ার, তেমনি বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোকেও নিজেদের দুর্বলতাগুলো অতিক্রম করে সেই শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্য হয়ে উঠবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফুর্ততায় যেমন ভেসে গেলে চলবে না, তেমনি স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলনের শক্তিকেও দূরে ঠেলে দেয়া চলবে না- এই উপলব্ধিটুকু বামপন্থি ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের মধ্যে আছে বলেই বিশ্বাস রাখতে চাই।

''ইতিহাসে 'বিশুদ্ধ' স্বতঃস্ফূর্ততা বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই, 'বিশুদ্ধ' যান্ত্রিকতা বলতেও তেমনি কিছু নেই। 'সবচাইতে স্বতঃস্ফূর্ত' আন্দোলন হলো তাই যাতে 'সচেতন নেতৃত্বের' উপাদানগুলোকে পরীক্ষা করা হয়নি বা সে নেতৃত্ব কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ রেখে যায়নি।" – আন্তনিও গ্রামসি, প্রিজন নোটবুকস, ১৯৬।