উত্তাল মার্চ এবং মার্চের ডাকসু

বিনয় দত্ত
Published : 3 April 2019, 12:36 PM
Updated : 3 April 2019, 12:36 PM

১.

মার্চ মাস। উত্তাল সময়। এই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক ভাষণে বাঙালি জাতি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই মার্চেই স্বাধীনতার ডাক এসেছিল। এই মার্চেই নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। যেই মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীন দেশ পেয়েছি সেই মুক্তিযোদ্ধাদের এখনো পর্যন্ত সঠিক তালিকা প্রণয়ন হয়নি। আমি ব্যক্তিগতভাবে বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলার বিনয়কাঠী ইউনিয়নের বালকদিয়া গ্রামের তিন ভাইয়ের কথা জানি, ধীরেন্দ্র নাথ মণ্ডল, ললিত কুমার মণ্ডল ও কৃষ্ণকান্ত হালদার যারা মুক্তিযুদ্ধে স্বশস্ত্র যুদ্ধ করবে বলে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তার মধ্যে ধীরেন্দ্র নাথ মণ্ডল, ললিত কুমার মণ্ডল আপন ভাই এবং কৃষ্ণকান্ত হালদার ছিলেন তাদের মামাতো ভাই। তার বাড়ি পিরোজপুর জেলার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নে আন্ধাকুল গ্রামে। ট্রেনিং শেষে তারা যখন দেশে প্রবেশ করেন তখন দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। এই তিনজনেরই ১৯৭১ সালের সেই ট্রেনিং রেকর্ডে নাম আছে। ট্রেনিং শেষে তাদের প্রত্যেককেই আলাদা করে সনদপত্র দেয়া হয়, তা আমি দেখেছি। দুঃখজনক বিষয় হল এই তিনজনের কারোরই মুক্তিযুদ্ধের সনদপত্র নেই। অর্থাৎ এরা তিনজনের একজনও মুক্তিযোদ্ধা নন। সবার যুক্তি হচ্ছে যেহেতু তারা সশস্ত্র যুদ্ধ করেননি তাই তাদের মুক্তিযোদ্ধা বলা যায় না। যেখানে অজস্র ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা সাজিয়ে সনদপত্র সংগ্রহ করে সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন সেই জায়গায় এই তিনজনের সদিচ্ছা তো অনেক বেশিমাত্রায় সম্মানের। এই তিনজন তো সশস্ত্র যুদ্ধ করার জন্যই ট্রেনিং নিয়েছেলেন।

বাংলাদেশ স্বাধীনের এতো বছর পরও আমরা এখনো পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রকাশ করতে পারিনি। এইটা আমাদের জন্য অনেক বড় ব্যর্থতার এবং লজ্জার। আমরা এখনো পর্যন্ত মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাও প্রকাশ করতে পারিনি। যে যুদ্ধাপরাধীরা আমাদের দেশটাকে স্বাধীন হিসেবে দেখতে চাইনি আমরা তাদের কেন যেন অনেক বছর ধরে প্রশ্রয় দিয়ে আসছি। আমার ব্যক্তিগত মতামত, অনেক বেশি রাজনৈতিক কারণে যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা প্রকাশ পাচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের সরকারের কাছে এই প্রজন্মের এইটাই চাওয়া এইসব তালিকা যেন দ্রুত প্রকাশ পায়।

এই মার্চ মাসের সবচেয়ে বহুল আলোচিত এবং সমালোচিত শব্দ হল ডাকসু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ যা সংক্ষেপে ডাকসু নামে পরিচিত। এই ডাকসু প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমরা রমণী কান্ত ভট্টাচার্য, অরবিন্দ বোস, শ্যামা প্রসাদ ঘোষ, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আব্দুর রব, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহমুদুর রহমান মান্না, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, আমান উল্লাহ আমানসহ আরো অনেক শক্তিশালী নেতা উপহার পায়। সর্বোপরি এই ডাকসুর নেতারা তখন সকল আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রে ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯'র গণ অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন ডাকসুর নেতা কর্মীরা। সর্বশেষ স্বৈরাচার সরকার পতনের পিছনেও ডাকসুর নেতারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

যে ডাকসুর ইতিহাস এতো সমৃদ্ধ সেই ডাকসু নির্বাচন দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় বন্ধ থাকলেও সম্প্রতি আবার ডাকসু নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচন নিয়ে যে ধরনের প্রহসন হয় তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদের ভিত্তিতে বলা যায় ডাকসু নির্বাচন স্মরণকালের সেরা প্রহসনের নির্বাচন।

২.

মার্চ মাসের গণহত্যার কথা আমরা সকলে জানলেও বিশ্বের অনেক দেশ আমাদের এই গণহত্যার কথা জানে না। আমাদের উচিত তাদের জানানো এবং নৃশংস এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করা। এই গণহত্যার খবর প্রথম প্রচার করেছিলেন আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিজয়ী বৈদেশিক সংবাদদাতা, টেলিভিশন উপস্থাপক এবং প্রতিবেদন নির্মাতা সাইমন ড্রিং। যার সাথে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। আমি সৌভাগ্যবান তার সাথে কাজ করতে পেরে। ভদ্রলোক অনেক কিছুই জানেন এবং অসম্ভব ভালো একজন শিক্ষক। তার বন্ধুসুলভ আচরণ আমাকে মুগ্ধ করেছে সবসময়।

১৯৭১ সালের ৬ই মার্চ সাইমন ড্রিং প্রথম ঢাকায় আসেন ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদক হিসেবে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকাতে ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত্র ১২টার পর থেকে বাঙালি নিধন কার্যক্রম হিসেবে যখন 'অপারেশন সার্চ লাইট' শুরু করে, তখন সাইমন ড্রিং ঢাকাস্থ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। ২৬শে মার্চ পর্যন্ত তিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন গণহত্যার সংবাদ সংগ্রহ করেন এবং ২৭শে মার্চ তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রতিবেদন আকারে তা প্রেরণ করেন। এই প্রতিবেদনটি 'ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান' শিরোনামে ৩০শে মার্চ প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদন বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই কারণে পাকিস্তান সরকার তাঁকে বহিষ্কার করেন। পাকিস্তান থেকে বের হয়ে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান। এরপর তিনি সাংবাদিক হিসেবে নভেম্বর মাসে কলকাতা আসেন এবং এখান থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় খবরাখবর প্রেরণ করতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পুরো সময়টাতে তিনি আর ঢাকায় আসতে পারেননি পরে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ী মিত্রবাহিনীর সাথে তিনি ঢাকায় প্রবেশ করেন।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে যে গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল তার এখনো পর্যন্ত কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমরা আদায় করতে পারিনি। শুধু তাই নয়, সাইমন ড্রিং এর মতো এইরকম অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পাশে থেকেছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সময়ের ভূমিকা নেয়া এইসব বন্ধুদের একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা আমরা এখনো প্রকাশ করতে পারিনি। উচিত ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করে তাতে সকল বিদেশি বন্ধুদের কর্মকাণ্ডের সঠিক বর্ণনা থাকা, কিন্তু তা হয়নি। আশার কথা হল, বর্তমান সরকার বেশ কয়েক দফায় এইসব বিদেশী বন্ধুদের সম্মাননা প্রদান করেছে। যদিও তাদের সম্মানে যে স্বর্ণের মেডেল দেয়া হয় তা নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়নি।

৩.

মার্চ মাসকে ঘিরে থাকা অতীত এবং বর্তমানের ঘটনা উপঘটনাগুলো আমাদের সামনের দিনের অভিজ্ঞতার ঝুঁলিকে সমৃদ্ধ করবে। এইসব অভিজ্ঞতা যেন আমাদের সামনের দিনকে সমৃদ্ধ করে এইটা যেমন একদিকে চাওয়া তেমনি এইসব ঘটনা বিশ্লেষণ করে শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করাও আমাদের উচিত।

দেশটা আমাদের সকলের। দেশের সর্বাঙ্গীন মঙ্গলের লক্ষ্যে আমাদের উচিত এক হয়ে কাজ করা। দীর্ঘ সময় পরে যে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে এই ডাকসু নির্বাচনের অনেক চরিত্রই হয়তো সামনের দিনে ঘাতক বা মহানয়কের চরিত্রে রূপ নিবে। এখন অপেক্ষা সময় কি বলে, ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি আমাদের কোনদিকে নিয়ে যায়, তা দেখার।