কেবল ক্ষমতাপন্থী হয়ে টিকে থাকা যায় না

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 28 March 2019, 12:48 PM
Updated : 28 March 2019, 12:48 PM

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে 'অপারেশন সার্চ লাইট' অভিযান চালায়। এই অভিযানের নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলার মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে যে বিভীষিকাময় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল, দীর্ঘ ৯ মাস মরণপণ লড়াইয়ের মাধ্যমে বাংলার দামাল সন্তানেরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সে যুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন ও একটি অসাম্প্রদায়িক, কল্যাণমুখী, মানবিক, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। মানুষের মৌলিক অধিকার ও ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা, শোষণ, বৈষম্য, অন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত একটি সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। প্রশ্ন হলো, আমরা কি স্বাধীনতার সেই মূল আকাঙ্ক্ষার পথে রয়েছি? আমরা কি গণতন্ত্রের পথে হাঁটছি? না কি সেই গতিমুখ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি?

'স্বাধীনতা' শব্দটির সঙ্গে গণতন্ত্রের ধারণা অনেকটাই অবিচ্ছেদ্য। 'একনায়কতান্ত্রিক স্বাধীনতা' বলে কোনো কিছু হয় না। একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যতই তার নাগরিকদের সম্পর্কে যত্নশীল হোক না কেন, তাকে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত মানুষ কিন্তু তার নিজস্ব মতপ্রকাশের, জীবনযাপনের অধিকার হারাতে চায় না, তার প্রচুর প্রমাণ ইতিহাসে রয়েছে। নিজস্ব জীবনযাপনের এই যে স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা, তার কারণ একটি দেশে নানা সমাজের মানুষ বাস করেন। জীবিকা বা পরিবেশগত কারণে তাদের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। তা সময়ের সঙ্গে অবশ্যই পাল্টায়, কিন্তু ওপর থেকে চাপ দিয়ে এক রকমের জীবনযাপনে বাধ্য করা, এমনকী তাদের 'কল্যাণার্থে' হলেও, মানুষ বেশি দিন মেনে নেন না। সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের একটি আবশ্যিক শর্ত তাই পরস্পরের মত ও জীবনযাপনকে সহ্য করে চলা। সেটা না হলে কারোরই নিজস্ব জীবনযাপনের অধিকার রক্ষিত হয় না।

গণতন্ত্রের আরও স্পষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর এক জন চিন্তাশীল দার্শনিক। তাঁর মত ছিল, কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতাই কখনও গণতন্ত্রের স্বরূপ হতে পারে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কল্যাণই যদি লক্ষ্য হয়, তা হলে কোনও পদক্ষেপ ঠিক কি না তা বিচারের মাপকাঠি হতে হবে সে কাজের দরুণ সমাজের সবচেয়ে নীচে থাকা মানুষটির কল্যাণ সাধিত হবে কি না। এই কথাটিই যে গণতন্ত্রের প্রকৃত মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করে তা একটু ভাবলেই স্পষ্ট হয়। অধিকাংশ মূল্যবান চিন্তার মতোই এই কথাটিও বাস্তবে পালিত হতে দেখা যায়নি। দার্শনিক মত হিসাবে থাকতে থাকতেই অব্যবহারে ঝাপসা হয়ে আসছে।

বরং গত বেশ কিছু দিন যাবৎ আমাদের দেশে এক রকম 'জবরদস্তির গণতন্ত্র' দেখা যাচ্ছে। গণতন্ত্রের প্রধান বা একমাত্র অর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে 'নির্বাচনে জেতা'। অর্থাৎ, 'ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাদখল'। ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অভীষ্ট লক্ষ্য হিসেবে চার স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেছিলেন। বাকস্বাধীনতা, আরাধনার স্বাধীনতা এবং অভাব ও ভয় থেকে স্বাধীনতা। আমরা সেসব ভয় থেকে মুক্তি লাভ করিনি। উপরন্তু, আমরা আরেকটি ভয়ে আতঙ্কিত। সে ভয় হচ্ছে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ভয়। যত দিন না আমরা এই ভয় থেকে মুক্ত হচ্ছি, তত দিন আমাদের নির্বাচন হবে কারসাজিপূর্ণ, ব্যয়বহুল, জবরদস্তিমূলক, বিদ্বিষ্ট ও পঙ্কিল। এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় গণতন্ত্রও বেপথু হতে বাধ্য।

'জবরদস্তি'র গণতন্ত্রের পথ ধরে পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা আমাদের স্বাভাবিক অভ্যাস হয়ে উঠেছে। এটা একদিনে ঘটেনি। আমরা জানি, বিরোধী রাজনীতির স্বর স্তব্ধ করে দেওয়ার সাধনা গত কয়েক দশক ধরেই চলছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এর কুৎসিত দৃষ্টান্ত। এই ধারা আজ বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় এসেছে যে 'বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত' হওয়াটা যে একটি বহুদলীয় রাজনীতির দেশে লজ্জাজনক সেই বোধও লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষ ক্রমশ ঢুকে পড়ছেন এমন এক ভয়ের বাতাবরণে, যা এক অসুস্থ সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে। একদিকে বিপুল বেকার সমস্যা, কোটি কোটি মানুষ নিঃশব্দে নিজেদের জীবিকা থেকে উচ্ছেদ হয়ে কোনও রকমে বুকে হেঁটে বাঁচছেন, অন্য দিকে রাজনীতির নামে সমাজে কালো টাকার অবাধ চলাচল— দুইয়ে মিলে সমাজকে, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে এক বেপরোয়া, অনৈতিক জীবনযাপনের কিনারে ঠেলে দিয়েছে। ফলে সমস্ত সমাজকে ছেয়ে ফেলছে এক অনিশ্চয়তা, অকারণ প্রতিযোগিতা ও যে কোনও উপায়ে 'এগিয়ে থাকা'র মানসিকতা। পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহনশীল স্বাভাবিক সম্পর্কের বদলে প্রতি দিন সঞ্চিত হতে থাকা প্রতিযোগিতায় অসফল হওয়ার ক্রোধ, অন্যের প্রতি, নিজের চেয়ে দুর্বলের প্রতি পীড়নের মধ্যে দিয়ে এক রকম ক্ষমতার তৃপ্তি আস্বাদন, সমাজের খাঁজে খাঁজে গেড়ে বসছে। এর ফলে সাধারণভাবে শাসকের সুবিধা হয়। 'হয় তুমি আমার পেছন পেছন যাবে, অর্থাৎ বোধহীন ভাবে আমাকে মেনে নেবে যে ভাবে কোনও প্রাণী মেনে নেয় তার প্রভুকে, অথবা তুমি হয়ে যাবে আমার শত্রু। আমি তোমাকে ধ্বংস করে দেব'— এই মনোভঙ্গি ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। ফলে যার হাতে যতটুকু ক্ষমতা আছে সে ততটুকু অত্যাচারী হয়ে ওঠছে, কোনও বিকল্প মতকে সহ্য করছে না। একটি বৈচিত্রময়, স্বাভাবিকভাবে বহুবর্ণ এবং স্বাভাবিকভাবেই বহুকাল ধরে একতাবদ্ধ একটি সমাজ ক্রমশ অসহিষ্ণু, ক্ষুব্ধ, হয়ে নিজে নিজেকে আঘাত করে, নিজে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

আজ হয়তো আমরা প্রবেশ করছি আরও সূক্ষ্ম, আরও গভীর এক বিপদের মধ্যে। আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়ার জন্য কোনও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপও আর প্রয়োজন হচ্ছে না। আমরা নিজেরাই সাবধান হচ্ছি, নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছি। কেউ ক্ষমতাবানদের বিরাগভাজন হতে চাচ্ছি না। কিছু লোক অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের ওপর পীড়ন করাকে গৌরবের বিষয় মনে করছে আর অন্য কিছু লোক, যারা নিরাপদ দূরে দাঁড়িয়ে থাকছে। এভাবে একটি গণতান্ত্রিক সমাজও ধীরে ধীরে মানসিক একনায়কতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যায়। যে কোনও অন্যায় বিনা বিরোধে ঘটতে পারে। কোনও সভ্যতা এই ভাবে কেবল ক্ষমতাপন্থী হয়ে টিঁকে থাকতে পারেনি, ইতিহাস তার নির্মম সাক্ষী। আমাদের ধনধান্য পুষ্প ভরা বাংলাদেশও পারবে না যদি আমরা এখনই আমাদের স্বাধীনতার মর্যাদা বিষয়ে যত্নবান আর নৈতিক সাহসে সাহসী না হই।

স্বাধীনতার অর্থ এটা নয় যে মানুষের দ্বারা তৈরি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সিঁড়ি বানিয়ে ক্ষমতা দখল আর সিংহাসনে বসে তার অপব্যবহার করা। এই ক্ষমতা দখলের সিংহাসনটি হতে পারে গ্রামের সালিশি সভার প্রধানের সিংহাসন অথবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সিংহাসন অথবা মন্ত্রিবর্গের সিংহাসন অথবা দেশের প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসন। তাই স্বাধীন দেশের স্বাধীন জনগণের উচিত কোনও ব্যক্তিকে ক্ষমতা দখলের সিংহাসনে বসাবার আগে সেই ব্যক্তির ন্যূনতম অন্তর্নিহিত মূল্যবোধের ও তার শিক্ষার সঠিক  মূল্যায়ন করে নেওয়া। নচেৎ স্বাধীনতার অপব্যবহার করার দায় শুধু সেই ব্যক্তি বিশেষের উপরে বর্তায় না, সাথে সাথে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের শিক্ষা, বুদ্ধি ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে একটি প্রশ্নচিহ্ন উঠে যায়। জনগণ যদি জ্ঞানত কোনও অসৎ ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসায় তাহলে অসৎ ব্যক্তি অপেক্ষা জনগণ বেশি দোষী।

স্বাধীনতা দিবসের সামনে দাঁড়িয়ে আজ আমাদের আত্মসমীক্ষা করা উচিত। আমাদের ভাবা উচিত- ''দেশের উন্নতি তখনই সম্ভব যদি সঠিক নেতৃত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। আমাদের সবার উচিত দেশের স্বার্থে ও নিজেদের স্বার্থে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকা। সবাই যদি চিন্তা করি রাজনীতি খারাপ, তার ফলস্বরূপ দেশের সমস্ত নাগরিকও খারাপ থাকতে বাধ্য। দেশের নাগরিকরা ছাড়া দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। নিজেদের স্বার্থে দেশের স্বার্থে ভালো নেতার দরকার। ব্যক্তিত্ব বিনা ভালো নেতৃত্বের জন্ম হয় না। পচা পাঁকে বাস করে পঙ্কজ সর্বদা হওয়া যায় না। তাই প্রথমে উচিত পচা পাঁক সরিয়ে ভালো সরোবর তৈরি করা তাতে নিশ্চিত পদ্ম ফুটবে। তেমনি দেশের শিক্ষিত নাগরিক সমাজের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিশুদ্ধকরণ করা। নচেৎ দেশের ও দশের উন্নতি সম্ভব নয়। ''

দেশ রাজনীতি ছাড়া নয়। অতএব সব উন্নতির, সব স্বাধীনতার, সব রাজনীতির সঠিক নেতৃত্বের দরকার, সঠিক প্রজার দরকার, শিক্ষার দরকার, ত্যাগের দরকার, আদর্শের দরকার, দায়িত্ববোধের দরকার, সচেতন মানুষের দরকার।