বিশ্বাসে আগুন!

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 27 March 2019, 12:00 PM
Updated : 27 March 2019, 12:00 PM

বেশ কয়েক বছর ধরে, সপরিবারে নিউমার্কেটে আছি বিশ্বাস বিল্ডার্সের বহুতল ভবনে। গত শুক্রবার রাত এগারোটার দিকে এক বন্ধু-সহকর্মী ফোন করে বললেন, আপনাদের ভবনে আগুন লেগেছে। দ্রুত নিরাপদ স্থানে চলে যান। ভবনে কোনও প্রকার বিপদ-সংকেত কিংবা ফায়ার অ্যালার্ম বাজানোর ব্যবস্থা নেই। আমাদের টিভি থাকলেও কখনও দেখা হয় না। টেলিভিশনে খবর দেখে উদ্বিগ্ন বন্ধুটি ফোন না করলে জানতেই পারতাম না যে মহাবিপদে আছি।

পড়ি কী মরি করে বের হলাম। বাইরে তখন ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। পাশের তিন প্রতিবেশির একজন দরজাই খোলেননি। অন্য দুই পরিবারের কর্তা বন্ধ লিফটের সামনেই ছিলেন। একজন নামতে পারবেন না, কারণ বাড়িতে শয্যাশায়ী রোগী। এত বড় ভবনে সিঁড়ি দিয়ে অশক্ত রোগী নামার কিংবা নামানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। অন্যজন নামবেনই না। তিনি বরং যারা নামছেন, তাদেরই বিদ্রুপ করছেন। 'ঈশ্বর ভরসা। আগুন শীঘ্রই নিভে যাবে!' এই দুই পরিবারের পরিজন-সন্তান সবাই  অ্যাপার্টমেন্টের ভিতরেই থেকে গেল। শ্বাসকষ্ট হলেও গৃহস্বামীর অনুমতির অভাবে নামতে পারলো না কেউ।

অপরিসর সিঁড়িতে কোনও আলোর ব্যবস্থা নেই। আমরা নেমে যাওয়ার পর সিঁড়ি নাকি অসহনীয় গ্যাসে ভরে গিয়েছিল। যারা না নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা হয়তো জানেন না যে কার্বন মনোঅক্সাইডের মতো গ্যাসে শরীর কিছুক্ষণের মধ্যে এতটাই নিস্তেজ হয়ে যায় যে নামারও উপায় থাকে না। বিশ্বাস ভবনের প্রথম পাঁচতলায় শত শত কক্ষ কাগজে-পত্রের দোকান, কার্যত গুদাম। এসব গুদামে কোন্ ধরনের পদার্থ মজুত রাখা হয়েছে, সেগুলোতে আগুন লাগলে কী ধরনের গ্যাস সৃষ্টি হতে পারে, তা কেউই জানে না, না প্রশাসন, না জনগণ।

লোকজন সুশৃঙ্খলভাবে গেটের বাইরে বের হয়ে আসছে। ভবনের নিরাপত্তা কর্মীরা সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। নিউমার্কেট লোকারণ্য। আশেপাশের কাঁচা বাজারের ভবনগুলোর বারান্দায় শত শত উৎসুক দর্শক। ভেঙে ফেলতে হবে – এই ভয়ে রঙটং দিয়ে 'মেক-আপ' করা পুরনো এই ভবনগুলোর বারান্দা অতিরিক্ত লোকের ভারে ভেঙে পড়ে নিচে অপেক্ষমান মানুষ আহত-নিহত হওয়া অসম্ভব নয়।

বাইরে বেরিয়ে আমার প্রাকযৌবনের শ্রদ্ধেয় কলেজ শিক্ষক, এলাকার দোকানদার, ধোপা, নাপিত, ফার্মাসিস্ট, পুরনো পরিচিত লোকজনের সঙ্গে ঘণ্টা দুয়েক সময় কাটালাম নিষ্প্রদীপ পরিবেশে। সবাই সহানুভূতিশীল। বন্ধুবান্ধব, ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, আত্মীয়-স্বজন ফোন করে খবর নিচ্ছেন অবিরাম ঢাকা, চট্টগ্রাম, বেইজিং, ভিয়েনা, মন্ট্রিয়ল থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক সহকর্মী সঙ্গ দিতে ছুটে এলেন। সবাই উদ্বিগ্ন, ফোনে একই কথা: 'ভালো আছি, নিরাপদে আছি!' বলতে বলতে অস্থির লাগলেও সবার ভালোবাসার উত্তাপ অনুভব করে ভালোও লাগছিল।

আমরা ভবন থেকে বের হবার আগেই একাধিক অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপণ শকট এসে হাজির হয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। ভাগ্য ভালো, আগুন রাতে লেগেছিল। দিনের বেলা আগুন লাগলে নিউমার্কেটের মহা-অপরিকল্পিত পার্কিং ব্যবস্থা এবং নৈমিত্তিক জ্যামের কারণে দমকলের গাড়ি ভবনের নিকটে আসা কঠিন হতো। কিন্তু প্রায় দুই ঘণ্টা বাইরে থেকে বহুজনকে জিজ্ঞেস করেও আগুন ঠিক কোথায় লেগেছে, কী ধরনের দাহ্য পদার্থ ইত্যাদি কিছুই আমরা জানতে পারিনি। চকবাজার বিপর্যয়ের পর পুরনো ঢাকার কেমিকেল ব্যবসায়ীরা যে বিশ্বাস-ভবনের গুদামগুলোতে তাদের মালপত্র এনে রাখেনি তারই বা নিশ্চয়তা কী! বর্তমান পরিস্থিতিতে পাঁচশ গুদামের উপর শুয়ে থাকা মানে কার্যত কমপক্ষে দুই শ বোমার উপর শুয়ে থাকা।

বিদেশে কোনও ভবনের প্রত্যেক কক্ষে পানির ফোয়ারা থাকে। ধোঁয়া কিংবা উত্তাপ একটা বিশেষ পর্যায়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ফোয়ারা থেকে পানি বের হতে শুরু করবে চক্রাকারে। তাতেই সিংহভাগ অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এতে কাজ না হলে অগ্নিনির্বাপক দল তাদের পানির পাইপ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে দরজা, জানালা কিংবা দেয়াল ভেঙে ভবনে ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশেও এসব নিয়ম নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু কোথাও কি নির্মাণকোড মেনে ভবন তৈরি করা হয়? বাংলাদেশের শহরগুলোতে দুই ভবনের মাঝে গাড়ি চলাচলের উপযোগী কোনো রাস্তা না রাখাই দস্তুর। দুই ভবনের মাঝে অল্পস্বল্প জায়গা রাখছেন কেউ কেউ, কিন্তু তিন তলার দিকে দুই ঝুলবারান্দা এতটাই কাছে নিয়ে আসছেন যে দুই মুখোমুখি প্রতিবেশি চাইলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পরস্পরের করমর্দন করতে পারেন। দুই ভবনের মধ্যে স্থানাভাব যে বিপদের আকর সেই বিশ্বাসই নেই আমাদের।

যিনি ভবন নির্মাণ করছেন তিনি নিয়ম মানছেন না। নিয়ম না মানার জন্যে আইনের মুখোমুখি করার করার কথা যে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারীর তিনি ঘুসের লোভে কিংবা ঘুসির ভয়ে নিশ্চুপ। বিচার করে শাস্তি দেবার কথা যে বিচারকের তিনি হয় দীর্ঘসূত্রিতা করছেন, নতুবা নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে বসে আছেন। ব্যবসায়, প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, জনগণসহ রাষ্ট্রের চতুরঙ্গ দেখভাল করার কথা যে রাজনীতিকের তিনি ক্ষমতার লোভে কাউকে চটাতে চান না। সুতরাং আমরা কেউই আমাদের বিপদের দায় এড়াতে পারি না, আমি-আপনি, কেউ না।

আমার মামাকে ফোন করে অগ্নিকাণ্ডের খবর দিতে তার মন্তব্য: মানুষতো কলেরা-বসন্ত এসব মহামারী নির্মূল করেছে। ঈশ্বর তার পরিবার পরিকল্পনা করবেন কী করে! মানুষই অপরিকল্পিত নগর বানিয়ে ঈশ্বরের কাজ সহজ করে দিচ্ছে। জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্ত, চিত্ত ভাবনাহীন। মৃত্যুর পর স্বর্গে থাকা-খাওয়া-বিনোদনের সুবন্দোবস্ত আছে। নিউমার্কেটের বিশ্বাস ভবনটি ইতিমধ্যে একাধিকবার জ্বলেছে, হয়তো আবারও জ্বলবে। বিশ্বাস যত জ্বলন্ত হবে, স্বর্গবাস ততই সুনিশ্চিত।