মন ভার করা এক ছবি ভাসছে মিডিয়ায়। একটি শিশু, হাতে তার পুটলি। একা পার হচ্ছিল মরুভূমি। মধ্যপ্রাচ্য এখন অগ্নিগর্ভ এক জায়গা। একদা সভ্য আর সভ্যতার উদাহরণ দেশ শহরগুলো আজ ধ্বংসস্তুপ। মেসোপটোমিয়া নামের ইরাক এখন মানুষের বসবাস অযোগ্য এক জনপদ। সেখানে নারী শিশু কেউই নিরাপদ না। ইরাক-লিবিয়ায় মিশন শেষ হবার পর মুরুব্বীরা ধরলেন সিরিয়াকে। দামেস্কাস কেমন শহর যারা ইতিহাস জানেন তাদের অজানা কিছু না। এটা মানি সেখানকার নাগরিকরা আগের মতো নাই। নাই বলতে আমি যাদের দেখেছি বা যারা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন তাদের ভেতর এক ধরণের উগ্রতা আছে। দীর্ঘ সময় ধরে একনায়ক কিংবা এককেন্দ্রিক শাসনের অধীনে থাকার কারণে হয়তো তারা এমন। শাসন শাসক আর রাজনীতির প্রভাব থাকে জন আচরণে। বিশ্ব রাজনীতির কঠিন চাপে মরুর দেশগুলো আজ তাদের চরিত্র হারিয়েছে। হারিয়েছে তাদের মূল পরিচয়।
বলছিলাম একটি ছবির কথা। যে ছবিতে শিশুটি বাঁচার জন্য কঠিন মরুভূমির একদেশ থেকে আরেক দেশে যাচ্ছিলো। যেতে পারতো, না মাঝপথেই তাকে বিদায় নিতে হতো বলা মুশকিল অতবড় মরুভূমিতে আরও কত শিশু বা মানুষ চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে কে জানে? কে তার খবর রাখে? সিরিয়া এখন বিশ্বের নিউজ আইটেম মাত্র। এমন হয়ে গেছে যে রোজ মিডিয়া খুলেই মানুষ ভাবে আর কয়জন মরলো সেখানে। যেন মৃত্যুই হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত কোনও খবর। এমন বাস্তবতায় কেউই নিরাপদ না। বিশ্ব মোড়ল নামে পরিচিত আমেরিকা সাথে তার মিত্ররা একদিকে। আরেক দিকে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ তাদের সাথে। যারা এখন যে কোনও পরিচয়ের বাইরে শুধু ভালো থাকার নামে নিজেদের ভোগ বিলাস নিরাপদ করতে ব্যস্ত।
একসময় স্নায়ুযুদ্ধের দুই প্রধান দেশ আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই ভাগে ভাগ হয়ে লড়াই করলেও তাদের চাপে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে বাধ্য হতো। এখন আর সেদিন নাই। একদল আগ্রাসন করে আরেক দল হুমকি দেয়। কিন্তু পা বাড়ায় না। ঝুঁকি নেয়না কেউ। বরং উভয়েই পরম আগ্রহে অস্ত্র ব্যবসা করে। শুধু তাদের দোষ দিয়ে লাভ নাই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও এখন বিপথাগামী। সভ্যতা সংস্কৃতি সব বাদ দিয়ে তারা যে উন্মাদনা আর ভয়াবহ খেলায় মেতে আছে তার সাথে ধর্মের সম্পর্ক যতটা না, তারচেয়ে বেশি আছে উগ্রতা। যে কারণে আজ তাদের জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় নামার পর ও তারা আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া তুলতে ব্যর্থ।
এই শিশুটি তার এক করুণ প্রতিচ্ছবি। বাচ্চাটি মুসলমান না অন্য কেউ সে পরিচয় বড় নয় বড় তার নিরাপত্তাহীনতা। কতটা অনিরাপদ আর অসহায় হলে একটি শিশু একা এমন ঝুঁকি নিতে পারে? বোঝা যাচ্ছে মা বাবা ভাই বোনদের কেউ হয়তো বেঁচে নাই। থাকলেও হারিয়ে গেছে। আর পাড়া-প্রতিবেশি বলে যাদের আমরা আপন মনে করি তাদের জীবন ও নিশ্চয় এমন এক তোপের মুখে যে কেউ কারও খবর রাখে না। বা রাখার মত অনুভূতি কিংবা সুযোগ নাই আর। এমন দেশ এমন সমাজ মানব সভ্যতার বিপরীতে দাঁড়ানো হবার পরও টনক নড়েনা কারও।
বাচ্চাটা ভাগ্যক্রমে জাতিসংঘের কর্তাদের হাতে পড়েছে বলে হয়তো জানে বেঁচে যাবে। এমন ও হতে পারে কয়েকদিন খুব আলোচনায় থাকবে দুনিয়া জুড়ে। এটাই সভ্যতার এক চরম উপহাস। আজকাল মিডিয়ায় কাউকে ফোকাস করতে পারলেই তারা ভাবে তাদের দায়িত্ব শেষ। পাকিস্তানের মালালার কথা মনে করুন। কী হলো শেষতক? তাকে আকাশে উঠিয়ে ছেড়ে দিলেও পাকিস্তানে কি কোন পরিবর্তন সাধন করা গেছে? বদলেছে পাকিস্তানিদের মনোভাব? সেদেশে জঙ্গি হামলায় মানুষের জান যায় পাখির মতো। তারপরও তারা সঠিক কোনও কাজ করতে আগ্রহী না। এই শিশুটি আমাদের মতো কোটি মানুষের চোখে জল আনলেও রাজনীতির চোখে অশ্রু আনতে পারবেনা।
এমন ঘটনা এখন কাউকে বিনিদ্র রাখে না। সামাজিক মাধ্যমে সাড়া তুলে কয়েক দিন পর তা হারিয়ে যায়। এতবড় একটা মানবিক কাহিনী পশ্চিমে হলে তার বিধান করতে যারা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন তারা এখন মানবিকতার পতাকা উড়িয়েই নিজেদের দায় সারবেন। অথচ এই শিশু কলম্বাস দুর্গম গিরি কান্তার মরু পার হয়ে যে শান্তিপূর্ণ জীবনের পথ খুঁজছিলো তার দিকে কেউ দৃষ্টি দেবে না। দিলে সমস্যা জিইয়ে না রেখে তারা এমন আর কোনও বাচ্চার ঝুঁকি নেয়া বন্ধের উদ্যোগ নিতো। কি যে হয়েছে এই দুনিয়ার! কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ খ্রিস্টান, কেউ ইহুদি- কিন্তু কেউ আর মানুষ না। এই কারণে মানুষ হবার জায়গাটা আজ সীমাবদ্ধ হতে হতে শূন্যে পৌঁছে গেছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ছবিটি দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। বড় বেদনার ছবি। মানুষ কবে থেকে এত অমানবিক হয়ে উঠলো যে মাসুম বাচ্চাকেেও ছাড় দিচ্ছে না। তাদের কী বুকে আসলেই কোনও দয়া-মায়া নাই আর? বাংলাদেশে যারা এর পেছনে ধর্মের উৎস খুঁজবেন তাদের জানাই আফ্রিকার নানা দেশেও এমন সমস্যা আছে। আছে দুনিয়ার বহু জাতিতে। সবার জন্য সমব্যাথী না হতে পারলে মুক্তি অসম্ভব। কয়েকদিন আগে নিউজিল্যান্ডে যা ঘটলো তার নাম কি শুধুই হত্যাকাণ্ড? নাকি এর পেছনে আছে সময়ের ইন্ধন? সময় ও অমানুষদের অশুভ প্ররোচনা? এমন ঘটনা যে কোনও সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনে নামিয়ে আনতে পারে ঘোর বিপদ। কেউ আজ নিরাপদ না । সভ্যতা নিজেও অনিরাপদ।
এভাবে চলতে থাকলে একসময় মানব শুন্য ধরণী হয়ে গেলেও কি অবাক হবো আমরা? দাপট আর বিভাজনের এই এক অপবিত্র যুগ চলছে। যেখানে আমি- 'আমি' বা আমরা- 'আমরা', ছাড়া সবার বলে কিছু নাই। সভ্যতার এমন অপমান সিরিয়া থেকে শুরু করে সব দেশেই বিরাজমান। এর প্রতিকার কোথায়? গোষ্ঠী জাতি সম্প্রদায়গত দাঙ্গা আগেও ছিল। সেগুলোকে পদানত করেই মানুষ রাষ্ট্র গড়ে তোলে যাতে ভালোভাবে নিরাপদে থাকতে পারে। সে রাষ্ট্র ধারণাই আজ প্রায় ভঙ্গুর। এমন দেশের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে যেখানে মানুষ কিছু না মূল কথা দাপট আর সিংহাসন। এভাবে চললে সব বাচ্চাই একদিন এতিম হবে। পথ হারাবে মরু বা খরা কিংবা বৃষ্টির খোলা মাঠে। তা কি আমরা চাই?