সন্ত্রাসের সাদা-কালো এবং মানুষ-ঊনমানুষ ধারণা

হাসান ইমাম
Published : 26 March 2019, 03:05 PM
Updated : 26 March 2019, 03:05 PM

পশ্চিমা ইন্টেলেকচুয়ালদের অনেকেই 'নাইন-ইলেভেন' দিয়ে বিশ্বকে দুই পর্বে ভাগ করতে সচেষ্ট। এই সন্ত্রাসী হামলার আগের ও পরের দুই বিশ্ব বলতে তারা যা বলতে-বোঝাতে তৎপর, বকলমে সেটি আসলে একটি বিভাজক রেখা; দুনিয়া ও দুনিয়াবির বুক বরাবর যা খোদিত। এই রেখার একপাশে মুসলিম দুনিয়া ও অন্যান্য, অন্যদিকে 'সন্ত্রাসবিরোধী' পশ্চিমা বিশ্ব।

পশ্চিমাদের মোটাদাগে সাদা ও কালোর (পড়ুন ভালো ও মন্দের!) এই ভাগবণ্টনের লজিক্যাল দিকটি যৎকিঞ্চিৎ উচ্চকিত না হলেও আড়েবহরে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়াতে অব্যর্থ! গায়ের রঙে, ধর্মের নামে, এমনকী তা ভৌগলিক অবস্থানগত বিবেচনাতেও পার্থক্য টানতে তা সমান পারঙ্গম। তাই ওকলাহামোর (১৯৯৫) হামলার ঘটনার ব্যাখ্যা মেলে না এই বর্ণবিদ্বেষী ফর্মুলায়। ২০১৫ সালে দক্ষিণ ক্যারোলাইনার চার্লসটোনে গির্জায় ছয় কৃষ্ণাঙ্গ ধর্মযাজককে হত্যা, ২০১৭ সালে কুইবেক সিটি মসজিদে ছয় মুসল্লিকে খুন, ২০১৮ সালে পেনসিলভানিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের ইহুদি উপাসনালয়ে ১২ জনকে কোতল ইত্যাদি ঘটনাও থাকে তাই সমানভাবে অব্যাখ্যাত। কেননা, সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের ধুয়া তুলে পশ্চিমা রাষ্ট্র-রাজনীতি-সমাজ-সুশীল-গণমাধ্যম যা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট, সেখানে গির্জার ভেতর কালো ধর্মযাজক, প্রার্থনারত ইহুদি, নামাজি মুসল্লি হত্যা নিয়ে তারা চোখে ঠুলি আর কানে মাফলার পরে থাকবে; সেটাই স্বাভাবিক। কথাগুলো প্রাচ্যের মাটিতে বেড়ে ওঠা প্রতীচ্যবিরোধী কোনও কালো-বাদামি-বেটে মানুষের মনগড়া হলে ভালোই হতো; কিন্তু এ কথার প্রমাণ মেলে পশ্চিমা এক গবেষণাতেই। আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষণা বলছে, কোনও অমুসলিম সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটালে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম যতটা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে, একই ঘটনার নেপথ্যে মুসলিম থাকলে তা সাড়ে তিনশ' গুণেরও বেশি ঢাকঢোল পিটিয়ে ফলাও করা হয়। পাশাপাশি 'টেররিজম' বা সন্ত্রাসবাদ শব্দটি স্রেফ হাপিস করে দেওয়া হয় অমুসলিমদের সহিংসতা-সংক্রান্ত খবরে। এর বিপরীতে, বলাই বাহুল্য, হামলাকারী মুসলিম হলে শব্দটির সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ব্যবহারে তাদের তৎপরতা অন্ধেরও চোখ এড়ায় না! সুতরাং সেই আদি ও অটুট একপেশে ব্যাখ্যায় পর্যবসিত গুরু-শিষ্য ব্রেইভিক ও ব্রেন্টনের ঘটানো যথাক্রমে ২০১১ সালের নরওয়ে ও গত ১৫ মার্চের নিউজিল্যান্ডের হত্যাযজ্ঞও।

সাফ কথা, এসব ঘটনাই সাদাদের শ্রেষ্ঠত্ব, আধিপত্যবাদ তথা বর্ণবাদের ফসল। এক কেকেকে সংগঠনের হামলায় ১৯ ও ২০ শতকে নিহত হন লাখ লাখ আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ। পশ্চিমা উপনিবেশ কত লাখ কালো-বাদামি-আদিবাসীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, তার সঠিক হিসাব কোথাও কি আছে? দিন বদলালে রক্তের রঙ কালো হয় বটে, তবে তা শেষাবধি রক্তই।

এক হিসাবে, আমেরিকায় প্রতিবছর গড়ে আড়াই লাখ মানুষ হেট-ক্রাইমের শিকার হন। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যত সন্ত্রাসী হামলা হয়, সেসবের দুই–তৃতীয়াংশের পেছনে রয়েছে উগ্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মার্কিন মুলুকে সংঘটিত ১৩৬টি সন্ত্রাসী হামলার মধ্যে মাত্র সাড়ে ১২ শতাংশের সঙ্গে মুসলিম যোগ ছিল।

The Southern Poverty Law Center-এর বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস (২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯) বলছে, আমেরিকায় এখন হাজারের বেশি হেট-গ্রুপ সক্রিয়। সংস্থাটির হিসাবে, ২০১৭ সালের তুলনায় গত বছর শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী সংগঠনের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। আমেরিকা প্রতিবছর পুলিশের গুলিতে কত কালা আদমি বেঘোরে প্রাণ হারান, ভাবলে গা শিউরে ওঠে।

শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ আমেরিকার মতো ইউরোপের মূলধারার সমাজ-রাজনীতিতেও শেকড় গেড়ে বসা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই শেকড় আরও একটু ছড়িয়েছে মাত্র। যুক্তরাজ্যের বেক্সিট ভোটের ফল দেশটির অবস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছে। অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, সুইডেন, স্পেন প্রভৃতি দেশে বর্ণবাদী প্রবণতা মাথা চাড়া দিচ্ছে, মায় পুরো ইউরোপে রাজনীতির মাঠে ক্রমশ শক্ত অবস্থান করে নিচ্ছে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীরা তথা উগ্র ডানপন্থীরা। পপুলিস্ট বা লোকরঞ্জনবাদী এই ধারার বিপরীতে তথাকথিত নন্দিত রাষ্ট্রনায়কদের অনেকের মুখেও তাই শোনা যাচ্ছে 'বহুসংস্কৃতির কুফলে'র কথা। অভিবাসনবিরোধী নীতি প্রণয়নের কথাও বলছেন কেউ কেউ। গত বছরের মার্চে ইতালিতে উগ্র ডানপন্থীদের বিপুল বিজয় ইউরোপে বর্ণবাদী জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে পড়ার, বলা চলে, সর্বশেষ দালিলিক প্রমাণ।

'নাইন-ইলেভেন'কে বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, এই সন্ত্রাসী হামলাপরবর্তী সময়ে পশ্চিমা সমাজে হেট-ক্রাইম লাগামছুট বেড়েছে। এই হেট-ক্রাইম আসলে কী? এফবিআইয়ের সংজ্ঞায় হেট ক্রাইম হলো— "those motivated by biases based on race, gender, gender identity, religion, disability, sexual orientation, and ethnicity."

সাদারাই শ্রেষ্ঠ বা হোয়াইট সুপ্রিমেসি ধারণার নেপথ্যের কারণ আসলে যতটা না 'ব্যবহারিক', তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি মনস্তাত্ত্বিক। শরণার্থী-অভিবাসীদের চাপে পশ্চিমা সুস্থিত সমাজ নড়বড়ে হয়ে পড়ার যে 'ভয়ের' কথা বলা হচ্ছে, সেই ভয় থেকেই মানুষ কোতলকে নিজেদের 'দায়িত্ব' বলছেন ব্রেইভিক-ব্রেন্টনরা। এ কথাটা ওপর-ভাসা সত্যি হলে এর সারবত্তা হলো সাদাদের দৃষ্টিতে বাদবাকি বিশ্বের সব মানুষই কিন্তু ঊনমানুষ (সাব হিউম্যান)। তাদের মগজে জেঁকে বসে থাকা এই বিদ্বেষমূলক ধারণার বহিঃপ্রকাশই হেট-ক্রাইম; উপনিবেশিক যুগে যার এস্তেমাল ছিল নির্বিচার অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে যখন-তখন হত্যায়, ব্রেইভিক-ব্রেন্টনরা তারই উত্তরাধিকার বহন করছেন।

'ইসলামোফোবিয়া' বলে পশ্চিমা সমাজে এখন যা চালু, তা আসলে বর্ণবাদের গায়ে আরেকটি আধুনিক লেবেল মাত্র। বর্ণবাদকে জায়েজ করতে এই জিগির একটা অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।

গুগল করলে দেখা যাবে, পশ্চিমা দেশগুলোতে হেট-ক্রাইম কী পরিমাণই না বেড়েছে; কোথাও কোথাও কয়েকশ গুণ পর্যন্ত। 'নাইন-ইলেভেন'কে যারা এর কারণ হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেন, তার সত্যকে দেখতে চান না। ওই সন্ত্রাসী হামলার ভূরাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ও মনোজাগতিক কারণ খুঁজে দেখায় পশ্চিমারা যত অনাগ্রহী, ততটাই অনাগ্রহী তারা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইউরোপ-আমেরিকামুখী শরণার্থীদের ঢলের কার্যকারণ খতিয়ে দেখার বেলায়ও। সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, আফগানিস্তান ইত্যাদি যে কেবল মানচিত্রে চিত্রিত ভূখণ্ড মাত্র, দেশ বলে আজ চেনা দায়, এর জন্য কারা দায়ী? এসব দেশ থেকে কেন কেবল প্রাণের ধুকধুকানিটুকু নিয়ে ছুটছে মানুষ? পেছনে পড়ে থাকছে নিজের পরিচয়, শেকড়।

'ইমানশিপেশন প্রক্লেমেশন' জারির দেশ শতক পেরিয়ে গেলেও দাসব্যবস্থা তথা কুৎসিততম বর্ণবাদের ভূত এখনও আমেরিকানদের ঘাড়ে দিব্যি বসে আছে। অসাম্য ও বঞ্চনাই কেবল নয়, মার্কিন সমাজে অশ্বেতাঙ্গদের এখনও সামনা করতে হয় নানা প্রতিকূলতার। এই কথাটিই বলা হয়েছিল ১৯৬৫ সালে কয়েক ডজন শহরে ছড়িয়ে পড়া দাঙ্গার তদন্ত প্রতিবেদনে। একই কথার পুনরাবৃত্তি দেখি আমরা ১৯৯২ সালে লস অ্যাঞ্জেলসের দাঙ্গার প্রতিবেদনেও।

'বর্ণসাম্য' আমেরিকার একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট পেতে সময় লেগেছে ২২০ বছর। একে কালো, তায় আবার বাবার পরিচয় মুসলিম, সুতরাং 'অচ্ছুৎ' ওবামাকেও হজম করতে হয় 'গো ব্যাক টু কেনিয়া' শ্লোগান। ট্রাম্পের জবানিতে আফ্রিকার দেশগুলো 'শিটহোল কান্ট্রিজ'।

তবু সাম্যের গানই বাজবে পৃথিবীতে, একদিন যেভাবে বাজত অনবরত। অস্ট্রেলিয়ায় মুসলিমবিদ্বেষী সিনেটরের মাথায় ডিম ভাঙল যে সাহসী কিশোর, নিউজিল্যান্ডে মসজিদে পাহারা বসিয়েছেন দায়িত্বশীল যে তরুণেরা, তারাই ঢেকে দিচ্ছেন বর্ণবাদের বদসুরত, বোধন হচ্ছে মানবিক বিশ্বের…