উনিশশো একাত্তরের 'অপারেশন সার্চলাইটে'র 'আফটার শক' সয়েছেন যারা, তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বয়ান প্রামাণ্যকরণের উদ্দেশ্যে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলাম ২০১৮ এর মধ্য-এপ্রিলে। প্রথম পর্যায়ে ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন, সাংবাদিক আবেদ খান, শহীদজায়া সালমা হকসহ বেশ কয়জন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার ধারণ করি। পরবর্তীতে এ মিছিলে অংশ নিতে আহ্বান জানাই মুক্তিযোদ্ধা-যাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, মুক্তিযোদ্ধা-সুরশিল্পী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, মুক্তিযোদ্ধা-চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ, মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক ডা. এম এ হাসানসহ আরও অনেককে। ব্যক্তিগতভাবে প্রায় সবাই সহযোগিতা করতে সম্মত হন। ফলে এ বিষয়ক গবেষণা ও প্রয়োজনীয় শুটিং সমান্তরালে এগোতে থাকে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের দ্বারা সংঘটিত একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে এ যাবৎ যত গবেষণা হয়েছে এবং এতে গণহত্যার যে ব্যাপকতা ও বীভৎসতার মাত্রা উঠে এসেছে, মাঠ-পর্যায়ে কাজ করতে যেয়ে এর আঁচ উপলব্ধি করি। শুরুতে তথ্যচিত্রটির জন্য টঙ্গি থেকে বুড়িগঙ্গার পাড় পর্যন্ত পাকিস্তানী সেনাবাহিনির দ্বারা সৃষ্ট গণহত্যার একটি ভিজুয়াল আখ্যান দাঁড় করাবো বলে স্থির করেছিলাম; কিন্তু সমগ্র দেশজুড়ে গণহত্যার ব্যাপকতা ও প্রান্তিকতার দায় থেকে শেষ পর্যন্ত জেলাশহরগুলোকেও এর অর্ন্তভুক্ত করি। এর ফলে ২০১৮ এর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে গণহত্যার এসব ক্ষতচিহ্নের অস্তিত্ব খুঁজতে একটি শুটিং টিম নিয়ে রওনা হই খুলনার চুকনগরে।
এ-কথা স্বীকৃত, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিজ দেশের জনগণের ওপর গণহত্যার যে পরিকল্পিত নৃশংসতা শুরু করে, তার ধারাবাহিকতা পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। মানুষবিহীন মাটির মোহে পরিচালিত এ গণহত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে যুক্ত হয় এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি ও অবাঙ্গালি বিহারীরা। একাত্তরে এদের হাতে ছয় মাসের অবোধ শিশু থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ, বয়ঃবৃদ্ধ কেউই রেহাই পায়নি। ধর্ম ও জাতিবিদ্বেষের শিকার হয়ে এদের দ্বারা নিগৃহিত ও নির্যাতিত হয়েছে লক্ষ-কোটি মানুষ।
২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮। স্থান- চুকনগর। পাতখোলা বিল বিধৌত চুকনগর গণহত্যা স্মৃতিসৌধে পৌঁছে গেট সংলগ্ন বাঁশের বেঞ্চে গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী অশীতিপর বৃদ্ধ এরশাদ আলী মোড়ল ও স্মৃতিসৌধের সংরক্ষণ কর্মী ফজলুর রহমান মোড়লকে পেলাম। কুশল বিনিময়ের পর তারা পুরো এলাকা ঘুরে দেখালেন। একাত্তরের ২০ মে এখানে সংঘটিত গণহত্যা প্রসঙ্গে এরশাদ মোড়ল জানালেন, তার পিতা চিকন আলী মোড়ল এ অঞ্চলের প্রথম শহীদ। পিতার লাশ সনাক্ত করতে এসে সেদিন তিনি অগণিত লাশের ভিড়ে খুঁজে পেয়েছিলেন ছ'মাসের অবুঝ এক কন্যাশিশুকে। এ শিশুটি তখন তার মৃত মায়ের দুধ পান করছিল। দুগ্ধপোষ্য শিশুটিকে উদ্ধার করে তিনি লালন-পালনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি বললেন, ওইদিন শিশুটিকে কোলে নেয়ার পর তিনি শিশুটির মায়ের কপালে সিঁদুর ও হাতে শাঁখা দেখতে পেয়েছিলেন। তাই শিশুটিকে তিনি তার নিজের কাছে না রেখে, পরিচিত এক হিন্দু পরিবারে রেখে লালনপালন করেছিলেন।
খুলনা থেকে চুকনগরে রওনা হওয়ার দিন স্থানীয় সাংবাদিক গৌরাঙ্গ নন্দী জেলা শিল্পকলার প্রাঙ্গণ থেকে সেই কন্যাশিশুটিকে আমাদের সহযাত্রী করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি আমাদের সঙ্গে। অন্যের ঘরে লালিত, শেকড়চ্যুত এই শিশুটি এখন বাংলাদেশের প্রায় সমবয়সী! 'সুন্দরী বালা' নামে তিনি সর্বত্র পরিচিত। তার কাছ থেকে শুনলাম, অসমবয়সী অস্বচ্ছল এক পাত্রের সাথে তাকে বিয়ে দেয়া হয়। দু'টি ছেলেসন্তান রেখে স্বামী মারা যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন তিনি ইটভাটায় দিনমজুরি করেন। পত্রিকায় তার মানবেতর জীবনের কথা প্রকাশ পাওয়ায় নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকি তাকে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে অস্থায়ী একটা চাকরির সুযোগ করে দেন। প্রশাসনের কাছ থেকে কিছু জমিও পেয়েছেন, কিন্তু সেখানে বাড়ি করার মতো অবস্থা না থাকায় বর্তমানে তিনি ভাড়াবাড়িতে থাকেন। আক্ষেপ করে বললেন, অর্থের অভাবে ছেলেদের লেখাপড়া করাতে পারেননি। তার এক ছেলে দর্জি আর অন্যজন চুল কাটার কাজ করে। সুন্দরী বালাকে একাত্তরে যে স্থান থেকে উদ্ধার করেছিলেন এরশাদ আলী মোড়ল, তাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সে স্থানে যাই। এরপর আনুসাঙ্গিক দৃশ্য ও ইন্টারভিউ ধারণ করে চুকনগরে শুটিং শেষ হয়। সুন্দরী বালাকে সঙ্গে নিয়ে এরপর আমরা খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক ধরে রওনা হই। আমাদের মাইক্রোবাসটি দ্রুত চলছিল। মহাসড়ক ধরে কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ রাস্তায় একটি অস্বাভাবিক দৃশ্য চোখে পড়ে। চট পরিহিত অর্ধনগ্ন ষাটোর্ধ্ব, অপ্রকৃতিস্থ এক মহিলা আমাদের গাড়ির সমান্তরালে দৌঁড়াচ্ছেন! মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত। গাড়ির গতির কারণে তিনি দ্রুত আমাদের দৃষ্টিসীমার আড়ালে হারালেন। আমাদের গাড়িটি না থেমে এগিয়ে চললো পিচঢালা সেই তপ্ত মহাসড়ক ধরে।
তাপানুকূল গাড়িতে বসে খুলনার বটিয়াঘাটা-বাদামতলা গণহত্যার বিবরণী পড়ছিলাম। সাহিত্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ডের ২০৮ পৃষ্ঠায় এসে থামতে হলো। সেখানে লেখা : 'বাদামতলা বধ্যভূমির নির্মম-নৃশংসতার মধ্যে এক মানবিক দৃশ্যের অবতারণা হয়। ওখানে গুলিতে নিহত ব্রাহ্মণ দম্পতি অমূল্য ও মনোরমার শিশুকন্যা মিনু প্রাণে বেঁচে যায়। শিশু মিনু তখনো জানে না তার স্নেহময়ী মা আর বেঁচে নেই। তবু অবোধ শিশু প্রাণহীন মায়ের স্তন্য পান করছিল।' মানবহিতৈষী কবি অ্যালেন গিনসবার্গ একাত্তরে হয়তো এ দৃশ্য দেখেননি। যশোর রোড থেকে অনেক অনেক দূরে খুলনার চুকনগরে সহস্র মৃতের সাথে একটি শিশুর অস্ফুট কথপোকথন কিংবা অনুরূপ কোনও মৃত নগরীতে মায়ের লাশের ওপর হামাগুড়ি দেয়া কোনো শিশুর অসহায় কান্না তাঁকে শুনতে হয়নি।
সুন্দরী বালাকে তার গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে এরপর আমরা এগিয়ে চলি খুলনার কয়লাঘাটার দিকে। ওখানে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সমমনাদের নিয়ে কিছুদিন হলো গড়েছেন '১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর'। ২৬ সাউথ সেন্ট্রাল রোডে স্থাপিত এ জাদুঘরে একাত্তরের স্মারকের পর্যাপ্ত সমারোহ নেই। তবে যা আছে, তা অনুভূতিকে নাড়া দেবার জন্য যথেষ্ট। জাদুঘরের নিচতলায় টিন-শেডে ঘেরা যুদ্ধস্মারক 'বয়লার'টি এর যথার্থ্য প্রমাণ। বর্তমান সরকার এ প্রতিষ্ঠানটির জন্য একটি স্থায়ী বাড়ি দিয়েছে, কিন্তু এটি জীর্ণ ও ব্যবহার অনুপযোগী ছিল। এই আর্কাইভ জাদুঘরের ট্রাস্টি সম্পাদক চিকিৎসক শেখ বাহারুল আলমের সাথে খুলনার গণহত্যা ও আর্কাইভ-জাদুঘরের সার্বিক কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলি। তিনি খুলনার গণহত্যা প্রসঙ্গে জানালেন, খুলনায় প্রথম গণহত্যার শিকার হন মহাদেব চক্রবর্তী। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী খুলনায় গণহত্যার উদ্বোধন করে। মহাদেব চক্রবর্তী শহীদ হওয়ার পর এ এলাকার মানুষ খুলনা শহরকে আর নিরাপদ ভাবতে পারেনি। গণহত্যা ক্রমান্বয়ে খুলনার শিল্প-এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সবুর-ইউসুফ গংদের নেতৃত্বে ও প্রশ্রয়ে অবাঙ্গালি বিহারী ও পাকিস্তানী বাহিনী খালিশপুর শিল্প-এলাকায় নির্মম গণহত্যা চালায়। বীরাঙ্গনা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী এ শিল্প-এলাকায় নারী ধর্ষণ ও গণহত্যার একজন জীবন্ত সাক্ষী। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জবানবন্দি ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তার বক্তব্য থেকে জানা যায়, পাকিস্তান নৌবাহিনীর কমান্ডার গুলজারিনসহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্নেল খটক, মেজর বেলায়েত খান, মেজর বানোরি, মেজর ইসতিয়াক, মেজর একরাম, মেজর জাফর, মেজর আবদুল্লাহ, মেজর জুবলি, মেজর আব্বাসী, মেজর ইকবাল, মেজর আলতাফ, ক্যাপ্টেন আকরাম, ক্যাপ্টেন গনি, লে. কোরবান ও লে. রফিকসহ স্থানীয় বিহারী নেতৃস্থানীয়রা তাকে একাধিকবার ধর্ষণ করে। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী তার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন, একাত্তরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে তিনজন সেনাসদস্য তাকে ধর্ষণ করেছে!
খুলনায় ওই সময়ের নির্যাতিত নারীর মূর্ত-প্রতীক হয়ে আছেন পাইকগাছা-কপিলমুনির গুরুদাসী মন্ডল। গুরুদাসীর জীবন ও জগৎ ১৯৭১-এর দাবদাহে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। তার চোখের সামনে স্বামী ও সন্তানদের একে একে হত্যা করা হয়। তার দুগ্ধপোষ্য শিশুটিকেও নিষ্কৃতি দেয়নি ঘাতকেরা। কোল থেকে কেড়ে নিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। গুরুদাসীকে ধরে নিয়ে যায় বটিয়াঘাটার বারআড়িয়া রাজাকার ক্যাম্পে। সেখানে আটকে রেখে নির্বাক-নিঃসঙ্গ গুরুদাসীর ওপর চলে পৈশাচিক যৌন নিপীড়ন। প্রিয়জনদের চোখের সামনে বিভীষিকাময় মৃত্যু আর নিজের ওপর পাশবিক নির্যাতনে গুরুদাসী একসময় মানসিক ভারসাম্য হারান। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ এ খবর পেয়ে ঈদের দিন রাজাকার ক্যাম্পটি আক্রমণ করে। স্থানীয় মুজিববাহিনীর কমান্ডার বিনয় সরকারের নেতৃত্বে এই রাজাকার ক্যাম্প আক্রমনে সেদিন খুলনার দু'জন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ বিসর্জন দেন। খুলনার সদর থানার 'আজিজ-জ্যোতিষ' সরণী আজ সে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। সন্মুখ-যুদ্ধে ওই রাজাকার ক্যাম্পের পতন হলে গুরুদাসী মুক্তি পান। কিন্তু স্বাধীন দেশে গুরুদাসী স্বস্তিতে জীবনযাপন করতে পারেনি। একটা লাঠি হাতে তাকে প্রায়ই পাইকগাছা-কপিলমুনি সড়কে উন্মাদিনীর মতো ঘুরতে দেখা গেছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা যদিও তাকে 'মা' বলে সম্বোধন ও সম্মান করতো কিন্তু হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষগুলোর অম্লান স্মৃতি তাকে আমৃত্যু তাড়িয়ে বেড়িয়েছে বিরূপ পরিবেশে। সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কেউ তার এ শূন্যতা বোঝেনি। এভাবে উন্মাদিনীর মতো বেঁচে থাকতে থাকতে ২০০৮-এ তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
সাংবাদিক গৌরাঙ্গ নন্দী খুলনার গণহত্যার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানালেন, যেহেতু খুলনায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বসবাস অন্যান্য জেলাগুলোর চেয়ে বেশী ছিল, গণহত্যার মাত্রাও এখানে সেভাবে ঘটেছে। এছাড়া খুলনায় প্রথম 'রাজাকার' সৃষ্টি হওয়ায়, স্থানীয় রাজাকারদের দ্বারা এখানে সবার আগে গণহত্যা শুরু হয় যা অন্য জেলায় এতো দ্রুত হয়নি। এছাড়া জামাত প্রভাবিত সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে নির্মম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। বাগেরহাটের কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার রজব আলী ফকিরের নৃশংসতা এখনো মানুষের অনুভূতিকে নাড়া দেয়। গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘরের উদ্যোগে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় জেলায় এ পর্যন্ত ২০০টি গণহত্যার স্থান চিহ্নিত হয়েছে। এসব স্থানে প্রতিষ্ঠানটি পর্যায়ক্রমে স্মৃতিফলক লাগাবে।
আর্কাইভ-জাদুঘরের পরিচালক শহিদুল ইসলামের সঙ্গে গণহত্যার স্থানগুলোতে স্মৃতিফলক স্থাপন নিয়ে কথা হয়। তার প্রচেষ্টায় পরদিন আমরা খুলনার তেরখাদায় যাই। সেখানে অজানা-অদেখা 'ভুতিয়ার বিল' পরিদর্শন শেষে 'আজগড়া' গণহত্যা স্মৃতিফলকের সামনে গিয়ে উপস্থিত হই। স্থানীয় বি আর বি আজগড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মেয়েরা তখন এ স্মৃতিফলকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করছিল। দুপুরের খরতাপে আমরা সবাই তৃষ্ণার্ত ছিলাম বলে দ্রুত শুটিং পর্ব শেষ হয়।
এ-সময় মাঝবয়সী এক লোক এসে বাগানের তাজা শশা খেতে দেন! শশায় তৃষ্ণা নিবারণ করে আমরা খুলনার দিকে রওনা হই। আজগড়া গণহত্যার স্মৃতিফলকের ভিডিও ও ছবি ধারণের সময় খেয়াল করেছিলাম, স্মৃতিফলকের শহীদদের অনেকেই 'শিকদার'। তবে কি শশা প্রদানকারী লোকটি শহীদ শিকদারদের কেউ? অগোচরে তিনিই কি আগলে রাখছেন আজগড়া গণহত্যার স্মৃতিফলক?
২৪ সেপ্টেম্বর সকালে আমরা খুলনার সোনাঙাঙ্গা থেকে আড়ংঘাটার দিকে রওনা হই। আমাদের সঙ্গে ছিলেন ডাক্তার বাহার। তিনি রোগীর চাপ সামলে আমাদের প্রতিদিন সময় দিচ্ছেন। যদিও খুলনায় এসে গণহত্যার শেকড় সন্ধানে আমাদের এ যাত্রায় অনেকেই নিরবে সহায়তা করছিলেন। যাহোক, আড়ংঘাটায় পৌঁচ্ছে আর্কাইভ-জাদুঘর স্থাপিত গণহত্যার স্মৃতিফলকটি দেখলাম। বাহার জানালেন, এরকম আরো স্মৃতিফলক তারা গড়বেন। স্থানীয় স্বজন হারানো অশোক চট্টোপ্যাধায় ও অনিমেষ সরদারের সাথে এলাকার গণহত্যা নিয়ে কথা হয়। অশোক, একাত্তরে নবম শ্রেণীতে পড়তেন।
পাকিস্তানী সেনারা তার এ গাঁয়ে যেদিন হামলা চালিয়েছিল সেদিনের কথা বলতেই তার চোখ ভিজে ওঠে। তার বাবা-জ্যাঠা-জ্যাঠাতো ভাইদের একইদিন হারিয়েছেন তিনি। তার জ্যাঠাতো ভাইকে পাকসেনারা লাইনে দাঁড় করিয়ে রাইফেলের বাট দিয়ে মাথায় আঘাত করেছিল সেদিন। সে আঘাতে তার কান মাটিতে পড়ে যায় মূহুর্তে। এ দৃশ্য তিনি দূর থেকে দেখেছিলেন। আজও এ দৃশ্য তিনি ভুলতে পারেন না। স্বজন হারানো অনিমেষ সরদার বললেন, নিহত স্বজনদের মৃতদেহ সৎকারের কিংবা আহতদের শুশ্রূষা করার মতো সময় সেদিন তারা পাননি। কেবল খালি হাতে উর্ধ্বশ্বাসে প্রাণ নিয়ে দৌঁড়ে পালাতে পেরেছিলেন!
আড়ংঘাটা থেকে ফিরে পরদিন খালিশপুরের প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলের বয়লার সংলগ্ন গণহত্যার স্মৃতিফলক দেখতে যাই। জুট মিলে আমরা যখন পৌঁছালাম, তখন দুপুরে কর্মবিরতি চলছিল। শ্রমিকরা দলবেঁধে বের হচ্ছিলেন। গণহত্যার স্মৃতিফলকের সামনে ক্যামেরা দেখে শ্রমিকদের অনেকেই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলেন। বয়লারে নিক্ষিপ্ত শহীদদের কয়েকজনের নাম ও এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস স্মৃতিফলকে লেখা ছিল। এ-সময় একজন শ্রমিককে মিলের বর্তমান বয়লারের ভেতর বেলচা দিয়ে ধানের তুষ নিক্ষেপ করতে দেখলাম। এতে বয়লারের আগুনের শিখা লাল থেকে লালচে কালো দেখাচ্ছিল। বয়লারের একটু কাছে যেতেই এর তীব্র আঁচ গায়ে এসে লাগে। কল্পনা করে শিউরে উঠলাম, হতভাগ্য ওইসব নাম না জানা মৃত্যু পথযাত্রী মানুষগুলো সেদিন কীভাবে এ তীব্র তাপ সয়েছেন ? কতটা তীব্র দহনের ভেতর দিয়ে তাঁদের সেদিন পৃথিবীর সব হিসাব চুকাতে হয়েছিল?
ঘমার্ক্ত কলেবরে ঘেমে নেয়ে শ্রমিকদের সাথে বের হয়ে এলেন এই মিলের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. শাহজাহান। তিনি সংক্ষেপে জানালেন, ইতিহাসের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এখানে তিনি গণহত্যার এ স্মৃতিফলক স্থাপনের উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলের বয়লারে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া একজন শ্রমিকের সন্তানের সন্ধান পাওয়া গেলো। তার নাম মো. ইদ্রিস পাটোয়ারি। তিনি জানালেন, তার পিতা মো. আবুল খায়েরকে এই বয়লারে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার জন্য বয়লারের সামনেই বেঁধে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তার পিতা সেদিন প্রাণে বেঁচে যান এবং বেঁচে যাওয়ার ঘটনাটি পরে তিনি তার পিতার মুখ থেকে শুনেছেন। ক্যামেরার সামনে ইদ্রিস পাটোয়ারি বললেন, সেদিন তার পিতাকে জ্বলন্ত বয়লারে নিক্ষেপের অপেক্ষায় রাখা হয়েছিল প্রায় ১৫/১৬ জনের পেছনে। একই সাথে এই ১৫/১৬ জনকে বয়লারে নিক্ষেপ করা হয় তার পিতার সামনে। এ দৃশ্য দেখে তার পিতা ক্রন্দনরত অবস্থায় দোয়া পড়তে থাকেন। দাঁড়ি ও টুপি থাকায় একজন লোক হঠাৎ তার পিতাকে ভালো লোক হিসেবে সনাক্ত করে তাকে মুক্ত করে পার্শ্ববর্তী রপ্তানি-ঘাটের জেটিতে পৌঁছে দেয়।
একাত্তরে খুলনার এই মিলের যে বয়লারে মানুষকে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়েছিল, আর্কাইভ-জাদুঘরের উদ্যোগে সেই বয়লারের পুরাতন অংশবিশেষ বর্তমানে জাদুঘরের নিচতলায় সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হচ্ছে। একাত্তরে নাৎসি কায়দায় বাঙ্গালিদের অবাঙ্গালি কর্তৃক জীবন্ত পুড়িয়ে মারার উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য এটি। এদিন বিকেলে আর্কাইভ ও জাদুঘরের সোনাডাঙ্গাস্থ লিয়াজোঁ অফিসে জাদুঘরের ট্রাস্টি সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সাথে কথা হয়। তিনি জানালেন, গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও মিউজিয়ামের প্রয়োজনীয়তার কথা। খুলনার এই আর্কাইভ-মিউজিয়াম শুধু বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়াতেও এ ধরনের প্রতিষ্ঠান এই প্রথম! ইতিহাসের এ অধ্যাপকের মতে, গণহত্যার ওপর জোর দিলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বেঁচে থাকবে। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হলোকাস্টের ওপর জোর দেয়ায় ইউরোপ পরবর্তীতে গণহত্যার দিকে আর সেভাবে এগোয়নি বা ফ্যাসিজমকে কেউ সমর্থন করেনি। তিনি মনে করিয়ে দেন, যখন আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা করি, তখন বিজয়ের কাহিনীটাই গুরুত্ব পায়। কারণ, এতো বড় 'বিজয়' বাঙ্গালির আগে হয়নি। কিন্তু এটাও সত্য, বিজয়ের কথা মানুষ দীর্ঘদিন মনে রাখে না। মানুষ মনে রাখে দুঃখ, অপমান আর কষ্টের কথা। সে অর্থে আমরা যদি একাত্তরের গণহত্যা ও নির্যাতনকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্ব না দিই, তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পূর্ণতা পায় না।
আর্কাইভ-জাদুঘরের প্রধান নির্বাহী কাজল আবদুল্লাহ একাত্তরে গণহত্যা ও নির্যাতনের দায়ে পাকিস্তান সরকার, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের যোগসাজসকারীদের বিচারের প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের একটি বক্তব্যের উদ্ধৃতি টেনে বলেন, "Injustice anywhere is a threat to justice everywhere". অর্থাৎ 'বিশ্বের যে কোন একটা প্রান্তে সংঘটিত অবিচারের বিচার না হওয়া যে কোনও দেশের জন্যই হুমকিস্বরূপ। তার মতে, মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষেরও অধিক মানুষের জীবনের অধিকার কেড়ে নেয়া এবং পাঁচ লক্ষের অধিক নারীর সম্ভ্রম হারানোর বিচার না হলে, পৃথিবীতে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ও এরূপ নির্যাতনের আশংকা বারবার দেখা দেবে। এ বিচারের বিষয়টি দিনের পর দিন অমীমাংসিতও থাকতে পারে না। একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্য, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তৎকালীন কমান্ডলাইনসহ পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিচার আয়োজন করা এখন সময়ের দাবি। কেননা, রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান একাত্তরের গণহত্যা ও নির্যাতনের দায় থেকে কখনো পার পেতে পারে না। এর বিচার-নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীর কাছে আমাদের এ দাবী উচ্চকণ্ঠে জানাতে হবে।
খুলনায় চার দিন অবস্থানের পর আমরা ঢাকায় ফেরার প্রস্তুতি নিই। বিকেলে জাদুঘরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম তার একটি ব্যক্তিগত ঘটনার কথা শোনালেন। ঘটনাটা এ রকম : ঈদের আগে এবার উত্তরাঞ্চলের বন্যায় তারা কয়েকজন মিলে রিলিফ-ওয়ার্ক করতে গেছেন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্ব হারানো কয়েকজন বীরাঙ্গনাকে রিলিফ দেয়ার জন্য খুঁজে বের করে যৎসামান্য ত্রাণসামগ্রী তাদের হাতে তুলে দেন। এগুলো পাবার পর ওই বীরাঙ্গনারা হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। তারা বারবার বলছিলেন, তাদেরকে এভাবে কেউ কখনো ডাকে না। তারা পরিবার থেকে, সমাজ থেকে পরিত্যক্ত হয়ে এখন রাস্তায়-রাস্তায় ভিক্ষা করেন!
এভাবে চার দিন ধরে আমরা খুলনায় একাত্তরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলোতে ঘুরছি। যদিও সময়ের বাধ্যবাধকতায় অনেকগুলো স্থানে যাওয়া হয় না। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান হচ্ছে গল্লামারি। একাত্তরে রেডিও পাকিস্তানের খুলনা কেন্দ্র ছিল এখানে। বর্তমানে এখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত। এ বধ্যভূমিতে প্রথম দিকে রাতে বাঙ্গালীদের ধরে এনে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে গুলি করে হত্যা করা হতো। পরবর্তীতে দিনের বেলায় গুলির পরিবর্তে জবাই করে প্রকাশ্যে হত্যা সম্পন্ন হতো। খুলনা মুক্ত হওয়ার পর শুধু গল্লামারি এলাকা থেকেই দুই ট্রাক মানুষের খুলি উদ্ধার হয়। এছাড়া খুলনা সার্কিট হাউস ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসনিক ভবন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিশেষ নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
খুলনার রয়্যালের মোড়ে ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকাগামী কোচের অপেক্ষায় বসেছিলাম। সময় বাঁচাতে ট্রাভেল ব্যাগ থেকে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : ১০ম খণ্ড' বের করে তাতে খুলনার শিরোমনি যুদ্ধের বিবরণ খুঁজতে থাকি। খুলনার শিরোমনির যুদ্ধ একটি কিংবদন্তিতুল্য ঘটনা। ট্যাংক 'ব্যাটেল অব শিরোমনি' এখন বিশ্ব সামরিক বিদ্যার অপরিহার্য্য অংশ। আনমনে সেই দুরন্ত লে. কর্নেল মনজুরের চেহারাটি একবার কল্পনা করতে থাকি, যিনি দু'হাতে দু'টো এসএলআর নিয়ে একাই সেদিন শিরোমনির সময়কে থামিয়ে দিয়েছিলেন! নদীপথে এ অঞ্চলে বীরত্বের সাথে লড়াই করে নিজ প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীন। সেও আমাদের বীরত্বগাঁথার অংশ।
সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বৃক্ষগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য আছে। সাগরের লোনা জলে সেসব বৃক্ষের শেকড়গুলোর একাংশ মাটির নিচে না যেয়ে, ক্রমশ উত্থিত হয় ওপরে। আমাদেরও ত্রিশ লক্ষের অধিক শহীদ শুয়ে আছেন এ মাটির গহীনে, নিঃশব্দে! ম্যানগ্রোভের মত আমরা কী তাদের মূর্ত করবো না স্মারকে-স্মারকে, দেশজুড়ে?