বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তারবরণ ও স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার সুযোগ নিয়ে অযথা বিতর্ক

মুহাম্মদ শামসুল হক
Published : 25 March 2019, 04:15 PM
Updated : 25 March 2019, 04:15 PM

একাত্তরের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের গ্রেপ্তার হওয়া নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। কেউ বলছেন, তিনি দেশের মানুষকে অসহায় অবস্থায় বিপদের দিকে ঠেলে দিয়ে শত্রুবাহিনীর কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন বা আত্মসমর্পণ করেছেন। তাই তিনি যুদ্ধে সরাসরি নেতৃত্ব দিতে পারেননি। তিনি আত্মগোপনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারলে মানুষের মনোবল আরও অনেক বেশি থাকতো এবং তার পক্ষে যুদ্ধের গতিবিধি ও বিভিন্ন জনের ভূমিকা পর্যবেক্ষণের সুযোগ বেশি হতো। এতে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে শত্রুমিত্র নির্ণয় এবং রাজনৈতিক বিষয়াদিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ তার জন্য সহজ হতো। কিন্তু ইতিহাসনির্ভর আলোচনা বা বিশ্লেষণ হলে এমন মন্তব্যের যৌক্তিকতা বা সত্যতা মেলে না।

বরং দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার অনুপ্রেরণা, ৭ মার্চের ভাষণের আহ্বান-নির্দেশনা ইত্যাদি এবং তার প্রতিকৃতি স্মরণ করেই দলীয় নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সংগঠক তার কথা মাথায় রেখে বড় ধরনের কলহে লিপ্ত হননি। সর্বোপরি তার অপ্রতিদ্বন্দ্বি নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্ব এবং পূর্ব যোগাযোগের ওপর ভিত্তি করেই যে প্রতিবেশি দেশের সরকার ও জনগণের সহায়তা পাওয়া গেছে তা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর কথায় বাংলাদেশ প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দোদুল্যমানতার অর্থই ছিল দেশটির আঁতুর ঘরে মৃত্যু। তার আত্মসমর্পণের অর্থ হচ্ছে স্বাধীনতার প্রশ্নে তার আপস করা ও সার্বভৌমত্বের দাবি পরিত্যাগ করা। এমনটা হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কখনো দিনের আলোর মুখ দেখতে পেত না। কেন না, ইংরেজিতে 'Surrender' অর্থ হচ্ছে, 'stop fighting and admited defeat' (Cambridge International Dictionary of English. Published in Great Britain, 1995)|। আর বাংলায় 'আত্মসমর্পণ' হচ্ছে, 'আপনাকে অন্যের হাতে সম্পূর্ণরূপে ছাড়িয়া দেওয়া। অস্ত্রাদি ত্যাগ করিয়া বিপক্ষের অধীনতা বা বশ্যতা স্বীকার করা' (ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি। দ্বিতীয় সংস্করণ)'।

এক্ষণে দেখা যাক যে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের কাছে 'আত্মসমর্পণ' বা 'সারেন্ডার' করেছিলেন কি না। ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানিদের হাতে বঙ্গবন্ধু যে গ্রেপ্তার বা অ্যারেস্ট হয়েছিলেন এটাই সত্য কথা। সারেন্ডার যে মুজিব করেননি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে যে, He did not admit defeat এবং ৭ মার্চে 'ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল', 'যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে' বলে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা তিনি প্রত্যাহার করে নেননি। তিনি যুদ্ধ বন্ধ করতে আদেশ করেননি, স্বপক্ষ ত্যাগ করেননি, সর্বোপরি প্রতিপক্ষের বশ্যতাও স্বীকার করেননি। তিনি 'Did not order to stop fighting'. এ ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণের প্রশ্নটাই আসছে না। যুদ্ধ বন্ধ করে (অস্ত্রাদি ত্যাগ করে) বশ্যতা স্বীকার না করলে 'আত্মসমর্পণ' যেমন হয় না, Surrender-ও হয় না।

১৯ তারিখে (মার্চ) মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে জয়দেবপুরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা পাকিস্তানি কমান্ড অস্বীকার করে বিদ্রোহের পতাকা উড্ডিন করেন। মুজিব এ বিদ্রোহকে অনুমোদন করেছিলেন এবং বিদ্রোহ পরিত্যাগ করতে কোনও আদেশ জারি করেননি। অর্থাৎ যুদ্ধ থামাতে বলেননি। সহকর্মীদেরকে তিনি নিরাপদ স্থানে গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আদেশ দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ঘোষণা কখনো প্রত্যাহার করে নেননি, বরং ২৬ এর প্রত্যুষে তিনি স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দ্বারা ৭ মার্চের ঘোষণাকে দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছিলেন এবং ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে গৃহীত The Proclamation of Independence তার গৃহীত সকল কার্যক্রমকে সাংবিধানিক ও আইনগত বৈধতা দিয়েছিল। তাই ইতিহাস তাকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্রষ্টা ও রাষ্ট্রপিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। (র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, ভোরের কাগজ, ২৬ মার্চ, ২০০৬)

আসলে বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই বুঝেছিলেন ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা সফল হবে না। শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার অথবা হত্যা করা হবে। আর তাকে না পেলে তার সন্ধান করার জন্য ঘরে ঘরে তল্লাশির নামে নিরীহ লোকজনকে হত্যা করা হবে। তার গ্রেপ্তার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর নিজের এবং পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল টিক্কা খানের বক্তব্যসহ বিভিন্ন প্রতিবেদনের ভাষ্য থেকে জানা যাবে তার গ্রেপ্তার হওয়ার আসল কারণ।

২৫ মার্চে তার গ্রেপ্তার হওয়া সম্পর্কে মার্কিন সাংবাদিক ডেভিডি ফ্রস্টের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন ৭২ সালের জানুয়ারিতে। সাক্ষাৎকারটি ১৮ জানুয়ারি নিউ ইয়র্কের টিভিতে সম্প্রচার করা হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর কাছে ফ্রস্টের প্রশ্ন ছিল: সেই রাতের কথা আপনি বলুন। আপনি গ্রেপ্তার হলেন। কেন আপনি নিজের বাড়ি ছেড়ে অপর কোথাও গেলেন না এবং গ্রেপ্তারবরণ করলেন?

উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সে-সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, ওরা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপসের আলোচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ি থেকে বেরোনো, না বেরোনো নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তানি বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি স্থির করলাম, আমি মরি তাও ভালো, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।

ফ্রস্ট: আপনি হয়তো কলকাতা চলে যেতে পারতেন।

শেখ মুজিবুর: আমি ইচ্ছা করলে যে কোনও জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেমন করে যাব? আমি তাদের নেতা। আমি সংগ্রাম করব। মৃত্যুবরণ করব। পালিয়ে কেন যাব? দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান ছিল; তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোলো। (সরদার ফজলুল করিম অনূদিত রুমীর আম্মা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, পৃ-৭২)

স্বাধীনতা ঘোষণার কারণে মুজিব গ্রেপ্তার- টিক্কা খান

বঙ্গবন্ধুকে খোঁজার জন্য ঢাকা শহরে বাড়ি বাড়ি তল্লাশির পরিকল্পনার কথা গোপন রাখেননি পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খান। সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা মুসা সাদিক টিক্কা খানকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'আপনি শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করেছিলেন কেন?' টিক্কা খান জবাব দিয়েছিলেন, 'আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার একটি তিন ব্যান্ড রেডিও নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলেছিল, 'স্যার শুনুন! শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন। এবং আমি নিজে রেডিওর এক বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে সেই স্বাধীনতার ঘোষণা শুনি। … তাই তাকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া আর কোনও বিকল্প ছিল না।'

মুসা সাদিক জানতে চাইলেন, 'তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে শেখ মুজিবও যদি ভারতে যেতেন তবে সেক্ষেত্রে আপনি কি করতেন স্যার?'

'আমি খুব ভালো করে জানি মুজিবের মতো একজন নেতা তার জনগণকে পরিত্যাগ করবে না। আমি গোটা ঢাকা শহরে তাকে খুঁজে বেড়াতাম এবং একটি বাড়িও তল্লাশির বাইরে রাখতাম না। তাজউদ্দীন অথবা তার মতো অন্য নেতাদের গ্রেপ্তারের কোনও অভিপ্রায় আমার ছিল না। সে কারণেই তারা এত সহজে ঢাকা ছেড়ে যেতে পেরেছিল।' (মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম : জনকণ্ঠ, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯৩)

নিউ ইয়র্ক টাইমসের তৎকালীন দিল্লি ব্যুরো প্রধান সিডনি শ্যানবার্গকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও প্রায় একই কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। ৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি ওই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়।

আসগর খান

বঙ্গবন্ধু যে গ্রেপ্তার হবেন তা বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছিলেন, ইয়াহিয়া-ভুট্টো ঢাকা আসার আগেই 'পাকিস্তান তেহরিকে ইশতেকলাল' পাটির নেতা এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আসগর খানকে । আসগর খান তার 'উই হ্যাভ লার্ন নাথিং ফ্রম হিস্ট্রি' গ্রন্থে লিখেছেন, 'আমি মুজিবকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি কি ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন? চলমান অচলাবস্থা কীভাবে অবসান করা যায়? মুজিব জবাবে বললেন, 'পরিস্থিতি খুবই স্পষ্ট, প্রথমে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসবেন, তারপর আসবেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তারপর ইয়াহিয়া সামরিক অভিযানের আদেশ দেবেন এবং সেটাই হবে পাকিস্তানের শেষ।'

তার নিজের সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেছিলেন, তার ধারণা তাকে গ্রেপ্তার করা অথবা মেরে ফেলা হবে।

আসগর খান লিখছেন, 'একাত্তরের মার্চের ঘটনার ক্রম মুজিবের পূর্বাভাসের সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়, যেটা বিস্ময়কর।' (ঢাকায় পাকিস্তানি আগ্রাসন, যুগান্তর, ২৬ মার্চ, ২০০৬)

ইয়াহিয়া, টিক্কার অভিযোগ শুধু বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে

পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেই অভিযোগ এনেছেন- মেজর জিয়াউর রহমান বা অন্য কারও বিরুদ্ধে নয়। ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউনে ১৯৭১ সালের ১ নভেম্বর প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া বলেন, 'তিনি (মুজিব) দুই বছর অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করেছেন কিন্তু ফিরে গেছেন নিজের বক্তব্যে। তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটিত করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং সেনাবাহিনীর আনুগত্য বিনষ্টের অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।' (যুদ্ধে আমরা হারব না : ইয়াহিয়া খান, প্রথম আলো, ২৬ মার্চ, ২০১০)

গ্রেপ্তারের আগে ঘোষণা দেওয়ার সময় ও সুযোগ

কেউ কেউ এমনও বলেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি বলে স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো প্রস্তুতিও তার ছিল না। এ ছাড়া, বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১১টার মধ্যেই গ্রেপ্তার হয়ে যান। কাজেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার সুযোগও তার ছিল না। এ অবস্থায় কেউ জেনে আবার কেউ না জেনে স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদান এবং তার স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেন। এমনকি স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর নানা অবদানের কথা স্বীকার করার পরও স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন তারা।

বঙ্গবন্ধু, রাত ১১টা সাড়ে ১১টার মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়ার প্রচারণাটি সঠিক নয়। বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রাত ১টা ২০ মিনিট থেকে ১টা ৩০ মিনিটের মধ্যে। আর রাত ১২ টা ৩০ মিনিটেও বঙ্গবন্ধুর বাসায় হাজি মোর্শেদের সাথে কথা বলেন রাজনীতিবিদ (পরবর্তী সময়ে জিয়া সরকারের উপপ্রধান মন্ত্রী, এরশাদ সরকারের উপরাষ্ট্রপতি ও খালেদা জিয়া সরকারের আইনমন্ত্রী) ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।

তিনি বলেন, 'রাত প্রায় ১২ টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৬০ খানা আর্মড কার, ভারী মেশিনগান সজ্জিত জিপ, ট্যাংকের একটি বহর, প্রেসিডেন্ট হাউস (পুরানো গণভবন) থেকে বের হয়ে হোটেলের সামনে দিয়ে বাঁ দিকে মোড় নেয় এবং শাহবাগ এভেনিউ থেকে পশ্চিম দিকে যেতে থাকে। প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে আমি হোটেল কক্ষ থেকে জননেতার (বঙ্গবন্ধুর) বাসায় টেলিফোন করি। হাজি মোর্শেদ টেলিফোনটি রিসিভ করেন। আমি তাকে আমার আশঙ্কার কথা বলি যে, সামরিক বাহিনী তার বাসভবনে হামলা চালাতে পারে, তাই তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে বলি। ১২টা ৩০ মিনিটে আবারো ফোন করলে এবারও হাজি মোর্শেদ ফোন ধরলেন। শেখ মুজিবকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে, হাজি মোর্শেদ প্রায় একটি শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে বলেন, "আমরা তার পায়ে ধরে বার বার বাড়ি থেকে সরে যেতে বলেছি। কিন্তু তিনি যাবেন না। তাকে নিয়ে কি করা হয় তা তিনি দেখতে চান।" ১টা ৩০ মিনিটে আবার যখন টেলিফোন করি তখন ফোন আর কেউ ধরেনি, বুঝতে পারলাম যে ফোনের সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে। আন্দাজ করলাম যে, রাত ১ টা থেকে ১-৩০ মি. এর মধ্যে তারা শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করেছে নিশ্চয়ই।' (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ: মওদুদ আহমদ, ইত্তেফাক-১০ ডিসেম্বর, ১৯৯৫)।

সাইমন ড্রিং

লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিষ্ঠাতা সাইমন ড্রিং সেদিন রাত প্রায় একটার দিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ৩০ মার্চ সংখ্যায় এক প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, 'এই অবস্থায় অন্য ইউনিটগুলো শেখ মুজিবের বাসভবন ঘিরে ফেলে। রাত একটার ঠিক আগে তার সাথে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি অনেক আগেই এ ধরনের হামলার আশঙ্কা করেছিলেন এবং কয়েকজন কাজের লোক ও দেহরক্ষী বাদে অন্যদের সরিয়ে দিয়েছিলেন। মুজিবের এক প্রতিবেশী পরে জানান, রাত একটা ১০ মিনিটে একটি ট্যাঙ্ক, একটি সাজোয়া গাড়ি, এবং ট্রাক বোঝাই সৈন্যরা গুলি করতে করতে মুজিবের বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। বাড়ির সামনে এসে একজন অফিসার রাস্তা থেকেই চেঁচিয়ে বলে, "শেখ, আপনি বাইরে বেরিয়ে আসুন"। বেলকোনিতে বেরিয়ে এসে মুজিব বলেন, "হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত, এতো গোলাগুলির দরকার ছিলো না। আমাকে ফোন করে দিলে আমি নিজেই হাজির হতাম।" অফিসারটি এবার বাড়ির বাগানে ঢুকে বললেন, "আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো।" তিনজন কাজের লোক, একজন সহকারী আর দেহরক্ষীসহ মুজিবকে নিয়ে গেলো তারা।' (ট্যাংকস ক্রাশ রিবল্ট ইন পাকিস্তান: ভোরের কাগজ, ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৬)

সাংবাদিক শ্যানবার্গ

বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তার বেতার ঘোষণা সম্পর্কে বিবরণ দিয়েছেন শ্যানবার্গ। এতে তিনি বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার হওয়ার সময় উল্লেখ করে বলেছেন, মুজিবের অনুরোধে তাকে বিদায় নেওয়ার জন্য (রাত একটার পর) কয়েক মিনিট সময় দেওয়া হয়। পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে তিনি চুম্বন করে বলেন, "শোনো, ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। তোমাদের সঙ্গে আমার হয়তো আর দেখা হবে না। কিন্তু (মনে রেখো) আমার দেশের মানুষ মুক্ত হবে, আমার আত্মা তা দেখে শান্তি পাবে।" (হাসান ফেরদৌস: বঙ্গবন্ধু যেভাবে গ্রেপ্তার হলেন, প্রথম আলো-২৫ ডিসেম্বর, ২০০৯)

হাজি মোরশেদ, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী, ২০১৬) শেখ হাসিনা, বিএনপি নেতা (সাবেক জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী) একেএম মোশাররফ হোসেনসহ অনেকের বক্তব্য ও তথ্যে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, বঙ্গবন্ধু রাত ১ টা ২০ মিনিট থেকে ১ টা ৩০ মিনিটের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং রাত প্রায় ১টা পর্যন্ত তার বাসার টেলিফোন সচল ছিল। কাজেই তার পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের জন্য কোনও না কোনও মাধ্যমে পাঠানো বা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া সম্ভব ছিল।