একজন শামীমা বেগম এবং ব্রিটেনের ‘ইসলামভিত্তিক’ সন্ত্রাসবাদ

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 18 March 2019, 07:09 PM
Updated : 18 March 2019, 07:09 PM

২০১৫ সালে আরো দুইজন কিশোরীর সাথে বাড়ি থেকে পালিয়ে পনের বছর বয়সে শামীমা বেগম ইসলামিক স্টেট বা আইএসের হয়ে যুদ্ধ করবার জন্য ব্রিটেন থেকে সিরিয়ায় চলে যান। আজকে আইএস যখন সিরিয়া থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সেই সময় শামীমাকে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম খুঁজে পেয়েছে সিরিয়ার আল কায়েদা (সিরিয়াতে হায়াত তাহরির আল শাম নামে পরিচিত) নিয়ন্ত্রিত এলাকার একটি শরনার্থী শিবিরে।

শামীমার মতো ব্রিটেন থেকে নয় শরও বেশি তরুণ/তরুণী আইএসের ডাকে সাড়া দিয়ে ইরাক এবং সিরিয়া পাড়ি জমিয়েছিলেন "শরিয়া ভিত্তিক" ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবার জন্য। বিশ্বের ৮০ টি দেশ থেকে প্রায়  চল্লিশ হাজার তরুণ/তরুণীও তাদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। নিজ নিজ দেশ বাদ দিয়ে তাদের সবার কাছে "রাশিয়াপন্থী" সিরিয়ায় আর ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠ ইরাকে শরিয়া ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার  প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল।

লক্ষ্যণীয় যে,তাদের কারো পাশ্চাত্যের সাথে ঘনিষ্ঠ কোনও আরব রাষ্ট্র যেমন সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী জর্ডান, তেল সমৃদ্ধ আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব বা বাহরাইনে ইসলামিক রাষ্ট্র  প্রতিষ্ঠা করবার কথা মনে আসেনি। তাদের ন্যাটো সদস্য তুরস্কের কথায়ও মনে আসেনি যেখানে জনগণের জীবন যাত্রায় সিরিয়া বা অন্যান্য আরব দেশগুলির চেয়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব অনেক বেশি।

এখন স্বভাবতই যে প্রশ্ন অনেকের মনে জেগেছে সেটা হল এ নয় শরও বেশি ব্রিটিশ আইএস যোদ্ধা থেকে সংবাদ মাধ্যম এক শামীমা বেগমকে কেন বেছে নিল? অথবা, একজন রাজনৈতিক সন্ত্রাসীকে হঠাৎ করে তাদের পতন্মুখ সময়ে এভাবে সামনে হাজির করবার কারণটাই বা কি?

শামীমা বেড়ে উঠেছেন লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসের বেথনাল গ্রিন এলাকায়। তিনি যুক্তরাজ্য থেকে সিরিয়া গিয়েছিলেন ব্রিটিশ পাসপোর্ট নিয়ে। শামীমার বাবা মা বাংলাদেশের সিলেট থেকে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন।

শামীমা এবং তার বাবা মার জীবনাচরণ দেখে যে কারো মনে হতে পারে দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে বাস করেও (শামীমার ক্ষেত্রে সেখানে বড় হয়েও) তারা কেউ সেখানকার সেকুলার, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং উদারনৈতিক সামাজিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির সাথে নিজেদের একাত্ম করতে পারেনি। অর্থাৎ, এক ধরণের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিছিন্নতাবোধ তাদের পুরো পরিবারকে পেয়ে বসেছিল।

এ বিছিন্নতাবোধ যে শুধু শামীমা এবং তার পরিবারকে একাই পেয়ে বসেছে তা নয়। এরকম বিছিন্নতাবোধের মধ্যে বসবাস করেন বাংলাদেশসহ মুসলিম প্রধান দেশগুলি থেকে অভিবাসী হয়ে আসা জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ। বাংলাদশী অভিবাসীদের বড় অংশটি হল সিলেট অঞ্চলের। এ অঞ্চল সহ বিশ্বের অন্যান্য জায়গা থেকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সেই উপনিবেশিকতার সময় থেকেই।

শামীমার পরিবার যখন সিলেট থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন যুক্তরাজ্য সম্পর্কে কি ধারণা নিয়ে তারা সেখানে গিয়ছিলেন? তারা কি ভেবে নিয়েছিলেন বাংলাদেশ বা মধ্যপ্রাচ্যের মতো একটি রক্ষণশীল সমাজ সেখানেও তারা পাবেন? বাংলাদেশের মতো তুলনামূলক বিচারে একটি অনুদার এবং ইসলাম ধর্ম প্রভাবিত সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে যুক্তরাজ্যে তারা বসবাস করবেন?

বাংলাদেশসহ মধ্যপ্রাচ্যের একটা বড় সংখ্যক অভিবাসী পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান সেসমস্ত দেশের সামজিক, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক অভিহিত না হয়েই। মোটা দাগে দেখলে পাশ্চাত্যের  সামজিক, সাংস্কৃতিক আবহ এবং সেসমস্ত দেশের জনগোষ্ঠীর চিন্তার পরিকাঠামো মুসলিম প্রধান দেশগুলি থেকে একেবারেই ভিন্ন। এটা সে দেশগুলিতে না যাওয়া পর্যন্ত অনেকেই ঠিক ঠাওর করতে পারেন না। তাই, তাদেরকে বিমান বন্দরে অবতরণের পরেই প্রথম ধাক্কাটা খেতে হয়, যেটাকে সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন সাংস্কৃতিক ধাক্কা (Cultural shock)। এ ধাক্কাটা আরো প্রকট হয়ে উঠে যখন তারা শহরে প্রবেশ করেন এবং সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন।

প্রথম ধাক্কাটা তারা খান নারীর পোশাক থেকে। বাংলাদেশের মত মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রের অভিবাসীরা তাদের দেশে নারীদের অত্যন্ত রক্ষণশীল পোশাকে দেখতে অভ্যস্ত। নারী পুরুষ নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের ভাবনার উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে থাকে তার পরিবার এবং আশেপাশের নারীদের পোশাক। অর্থাৎ,তাদের নিজস্ব মানদণ্ডে নারীরা "শালীন" পোশাক পড়ছেন কিনা এ বিষয়টি নিয়ে ধর্মমত ব্যতিরেকে জনগণের একটি বড় অংশ উদ্বিগ্ন থাকেন।

পাশ্চাত্যের বিচারে দেশীয় নারীদের শালীন পোশাকই যেখানে অনেককে উদ্বিগ্ন করে তোলে সেখানে প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যের মতো একটি দেশে এসে যেখানে এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও উদারভাবে নারীরা পোশাক পড়তে পারেন—তা অনেক বাংলাদেশী অভিবাসীর জন্য বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়ায়।

নারীদের পাশ্চাত্যের পোশাক সেটা স্কার্ট,প্যন্ট-শার্ট বা স্যুট যেটাই হোক সেটাকে বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের কাছে নারীর স্বাধীনতার, বিশেষত যৌন স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে প্রতিভাত হয়। এসব অভিবাসীরা দেশে নারীদের অধস্তনতা দেখে মূলত অভ্যস্ত। নারীর যৌনতা পুরুষের অধীন বা পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অথবা পুরুষের ইচ্ছা/অনিচ্ছার উপর নির্ভর করবে এ মাইন্ডসেট নিয়েই বেশির ভাগ নারী/পুরুষ অভিবাসী ব্রিটেনসহ পাশ্চাত্যের নানা দেশে পাড়ি জমান। ফলে,সেখানে নারীর আপাত সামাজিক এবং যৌন স্বাধীনতা তাকে আতঙ্কিত করে তোলে।

এর প্রথামিক সমাধান হিসাবে তারা মনে করে নারী প্র্যাচ্যের (মধ্যপ্রাচ্যের) পোশাক অর্থাৎ, হিজাব, নিকাব, বোরখা ইত্যাদি পড়লে এরকম একটা "বৈরি" পরিবেশে তাদের যৌনতা নিয়ন্ত্রিত থাকবে। ফলে, দেশে থাকতে যারা এ ধরনের পোশাক পরতেন না ব্রিটেনের মতো দেশগুলিতে এসে তারা এ সমস্ত পোশাক পরা শুরু করেন। অর্থাৎ, শুরু থেকেই তারা চেষ্টা করেন যাতে মূল ধারার থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারেন। পাশাপাশি, সামাজিকভাবেও চেষ্টা করেন যতটা সম্ভব মূল স্রোতধারার সংশ্রব এড়িয়ে চলবার।

এড়িয়ে চলবার মূল কারণ দুটো। প্রথমত যে দেশীয় সংস্কৃতি, পোশাক  বা খাদ্যাভাস তারা ধারণ করেন তার কোনটিরই যাতে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির আবহে পরিবর্তন না ঘটে। তবে, পোশাকের বিষয়টা শুধু নারীদের ক্ষেত্রে। পুরুষের পোশাক নিয়ে তারা ততটা উদ্বিগ্ন হন না।

অভিবাসীদের সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্নের কারণ দ্বিতীয় বিষয়টি। অভিবাসীদের একটা বড় অংশের মাঝে দুশ্চিন্তা কাজ করে এ ভেবে যে তাদের পরিবারের কোনও ছেলে মেয়ের সাথে মূল জনগোষ্ঠীর কারো বৈবাহিক বা যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয় কিনা।

প্রাচ্যের বিশেষত মুসলিম প্রধান যে সমস্ত দেশ থেকে অভিবাসীরা ব্রিটেনে আসেন সে সমস্ত দেশে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের কোনও ধর্মীয়, আইনগত বা সামাজিক স্বীকৃতি নেই। কিন্তু, ব্রিটেনে এসে তারা দেখেন বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের সামাজিক স্বীকৃতি যেমন রয়েছে, তেমনি যৌনতার নানাবিধ চর্চার উপস্থিতিও সমাজে রয়েছে।

যৌনবৃত্তি,পর্নোগ্রাফি ইত্যাদির আইনগত স্বীকৃতির পাশাপাশি ২০১৩ সালে বৃটিশ সংসদ কর্তৃক সমকামী বিয়ের আইন পাশের বিষয়গুলো রক্ষণশীল দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের একটা বড় অংশকে মানসিকভাবে অসহায় করে তোলে। তাদের দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় নিজ দেশে যে পারিবারিক মূল্যবোধ তাঁরা বজায় রাখতেন সে একই মূল্যবোধ তারা সেখানে বজায় রাখতে পারবেন কিনা।

সাংস্কৃতিক এবং মূল্যবোধ সংক্রান্ত বিষয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশের মতো দেশগুলি থেকে আসা মুসলিম অভিবাসীদের বড় একটি অংশ হঠাৎ করে নিজেদেরকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে দেখতে পেয়ে মর্মপীড়ায় ভুগতে থাকেন। দেশে থাকতে তাদের অনেকেরই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের জটিলতার বিষয়গুলো চোখে পড়েনি; বরং, ক্ষেত্র বিশেষে তাদের কেউ কেউ সংখ্যালঘুদের মর্মপীড়ার কারণ হয়ে উঠেছিলেন।

যুক্তরাজ্যে এসে জনগোষ্ঠীর খৃস্টীয় ভাবধারা প্রভাবিত কারো কারো কর্তৃক সে একই রকম আচরণের মুখোমুখি যখন তারা হন তখন এর ব্যাখ্যা খুঁজে না পেয়ে প্রতিনিয়ত এক ধরণের মানসিক পীড়নের মধ্যে দিয়ে তারা যেতে থাকেন।

অভিবাসী জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশ মূল স্রোতধারার সাথে মানসিকভাবে বিছিন্নবোধ করলেও একই সাথে গর্ববোধ করেন যে তারা পৃথিবীর উন্নত একটি দেশে বাস করেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই- দুর্নীতি, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের অভাব, অনুন্নত অবকাঠাম, ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাব, অনুদার সমাজ কাঠামো, ব্যক্তি স্বাধীনতার অভাব, ব্যক্তি জীবনে সামাজিক হস্তক্ষেপ ইত্যাদি- নানা বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। সময় সুযোগ পেলে এ বিষয়গুলোকে ধরে তারা বাংলাদেশের প্রবল সমালোচনা করতে পছন্দ করেন।

সেই তারাই আবার যখন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিকসহ অবকাঠামগত উন্নয়নের বিষয়গুলো শুনেন প্রথমে তারা তা বিশ্বাস করতে চান না। আবার নিজের চোখে দেখে বা অন্য কোনও কারণে যখন বিশ্বাস জন্মে বিশেষ করে অবকাঠামগত উন্নয়নের বিষয়গুলোতে, তখন সেটা তাদের জন্য আরেক মনঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিজেদের ফেলে আসা দেশ উন্নত হয়ে গেলে  বিদেশে থাকবার যৌক্তিকতা কোথায় বা ফেলে আসা দেশবাসীর সামনে বাইরে থাকবার কোন বিষয়টা নিয়ে তারা গর্ব করতে পারবে— এ প্রশ্ন তাদেরকে ভাবিত করে।

বৃটেনের আইনের শাসন এবং সমানাধিকার এসব নিয়ে ফেলে আসা স্বজাতির সামনে গর্ব করলেও বাস্তব জীবনে চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যখন তারা দেখতে পান সমান বা কম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একজন শ্বেতাঙ্গ বৃটিশ অগ্রাধিকার পায়, তখন প্রবল হতাশা এবং চরম বিচ্ছিন্নতাবোধ তাদের পেয়ে বসে। মানসিকভাবে ব্রিটিশ বা বাংলাদেশ উভয় সমাজ থেকেই তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাদেরকে বাস করতে হয় এক ধরনের মনোজাগতিক দ্বৈততা নিয়ে; অর্থাৎ, একই সাথে তারা ব্রিটিশ সমাজকে ঘৃণা করেন এবং ভালোও বাসেন। কিন্তু,ভালোবাসলেও পোশাক থেকে সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস, ধর্ম  ইত্যাদি সব বিষয়ে বিছিন্নতাবোধ নিয়ে সমাজের প্রান্তে বসবাস করেন।

বস্তুত,এ মানসিক গঠনের অধিকারী ব্যক্তিবর্গই "ইসলাম ভিত্তিক" সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ সমূহের সদস্য সংগ্রহ করবার মূল বা সহজ টার্গেট। কেননা, ক্রমাগত বিছিন্নতাবোধ নিয়ে সমাজের প্রান্তে বসবাস এবং সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হতে তাদের অনেকের মধ্যেই একধরনের মনোজাগতিক  নৈরাজ্যবাদিতার জন্ম নেয়।আর নৈরাজ্যবাদিতাকেই আইএসের মতো গোষ্ঠীগুলো কাজে লাগায় তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য।

জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত অধিকাংশ অভিবাসীর পক্ষে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সেকুলারিজম ইত্যাদি নানা পাশ্চাত্য জাত রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মতবাদের সাথে পরিচয় লাভ ঘটবার তেমন সুযোগ ঘটে না। তেমনি, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল গতি প্রকৃতি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করবার অবকাশ বা আগ্রহ অনেকেরই থাকে না। দৈনন্দিন জীবন যাপনের বাইরে যে বিষয়টা সম্পর্কে তাদের প্রাথমিক ধারণা থাকে সেটি হলো ধর্ম। অনেকেই চেষ্টা করেন নিজ নিজ বুঝ অনুযায়ী প্রাত্যহিক জীবনে ন্যূনতম ধর্মীয় চর্চার মধ্যে থাকতে। নৈরাজ্যবাদী মনস্তত্ত্বের অভিবাসী তরুণ প্রজন্মের ধর্ম সম্পর্কে এ প্রথামিক জ্ঞানটাকেই কাজে লাগায় সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো।

আইএসের মতো গোষ্ঠীগুলো তরুণ/তরুণীদের সামনে পাশ্চাত্যজাত সমস্ত মতবাদ বা ধারণাকে নাস্তিকতার পর্যায়ে ফেলে দিয়ে তাদের সামনে উপস্থাপনা করে। পাশাপাশি, তাদের ব্যক্তিগত জীবন সংগ্রামের বিষয়গুলোকেও এ সমস্ত মতবাদের ব্যর্থতা হিসাবে তুলে ধরে। সম্যক জ্ঞানের অভাবে তরুণ/তরুণীদের এ সমস্ত যুক্তি খণ্ডন করা অসম্ভব হয়ে পরে। তাই, সমধান হিসাবে যখন গায়ের জোরে, রক্তপাতের মাধ্যমে "শরিয়া ভিত্তিক" রাষ্ট্র এবং সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয় তখন তারা তার সাথে মানসিক সাযুজ্য বোধ করেন দীর্ঘদিন ধরে মনের মধ্যে জমে থাকা রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা আর বঞ্চনার অভিপ্রকাশ হিসাবে।

শামীমা বেগমদের মতো তরুণ/তরুণীদেরকে যখন বলা হয় ইতিমধ্যে সিরিয়া এবং ইরাকে "শরিয়াভিত্তিক প্যারাডাইজ" কায়েম করা হয়েছে, তোমরা এসে সে কাজকে আরো সামনে  এগিয়ে নিয়ে যাও, তখন তারা লন্ডনের কঠিন জীবন থেকে মুক্তির নতুন দিগন্ত হিসাবে সিরিয়া, ইরাকে চলে যাওয়াকে শ্রেয় মনে করে— আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল সমীকরণ বুঝতে না পারবার কারণে।

অপরদিকে, গণতন্ত্র, সেকুলারিজম, মানবাধিকার, উদারনৈতিক সমাজের কথা বললেও এবং দেশের অভ্যন্তরে কম বেশি এসবের চর্চা থাকলেও শীতল যুদ্ধকালীন সময় থেকেই ব্রিটিশ সরকার উপরোক্ত ধারণা সমূহের বিরোধীতাকারী "ইসলামপন্থী" দল ও গোষ্ঠী সমূহকে আশ্রয়, প্রশ্রয় এবং পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। এর মূল কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ক্রীড়ানক হিসাবে তাদের ব্যবহার করা।

বাংলাদেশের গোলাম আযমসহ সারা বিশ্বের "ইসলামপন্থীরা" বিপদে আপদে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজেছে ব্রিটেনে। জামায়াতসহ অন্যান্য "ইসলাম ভিত্তিক" দল এবং গোষ্ঠীসমূহ সেখানে গড়ে তুলেছে তাদের সংগঠন এবং সুবিস্তৃত নেটওয়ার্ক। সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীসমূহের মত তাদেরও মূল লক্ষ্য হচ্ছে অভিবাসী মুসলিম কমিউনিটী থেকে সদস্য সংগ্রহ করা।

লক্ষ্যণীয় যে,মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশের চেয়ে "ইসলামপন্থীরা" নিরাপদ ভেবে আসছে এমন একটি দেশকে যে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, জীবন যাপন প্রক্রিয়া সব কিছুরই তারা ঘোর বিরোধী এবং নিজ নিজ দেশে তার কোনও কিছুরই যাতে বিকাশ ঘটে সে ব্যাপারে অত্যন্ত সক্রিয়।

৯/১১তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসবাদী হামলা এবং খোদ ব্রিটিনের অভ্যন্তরে একাধিকবার হামলা হলেও "ইসলামপন্থীদের" সাথে তাদের সম্পর্কে যে চিড় ধরেনি এটা স্পষ্ট। বরং, ৯/১১ পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে ব্রিটেনকে দেখা গেছে এ "ইসলামপন্থীদের" বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে।

একথা নিশ্চয় কারও বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়, যেখানে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কোনও সদস্যের পক্ষে ইমিগ্রেশন চ্যানেল পার হয়ে দেশের বাইরে যাওয়া মুশকিল, সেখানে সরকারের "নীরব" সমর্থন ছাড়া নয় শরও বেশি আইএস সদস্য বিভিন্ন ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন চ্যানেল দিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অংশ নিতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কীভাবে যেতে পারবে!

শীতল যুদ্ধের অবসান হলেও ব্রিটেন এখনো মনে করে "ইসলামপন্থার" রাজনীতিকে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিৎ পুনুরুত্থিত রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবার জন্য। একই সাথে এ রাজনীতি মুসলিম প্রধান দেশগুলিকে চাপে রাখবারও একটা কার্যকর হাতিয়ার ব্রিটেনের কাছে।

ব্রিটেন যতদিন "ইসলামপন্থী" দল এবং গোষ্ঠীগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাবে ততদিন শামীমা বেগমের মতো মূলধারা থেকে বিছিন্নতার চেতনায় আক্রান্ত আরো অনেককেই আমরা "ইসলাম ভিত্তিক" সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত হতে দেখব।