বাজেট: কতটা পেলেন নারী

হান্নানা বেগম
Published : 28 Dec 2013, 07:00 PM
Updated : 3 July 2012, 01:55 PM

একসময় অর্থনীতিতে নারীকে উপকারভোগী বলেই মনে করা হত। পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত অবস্থাটা এমনই ছিল। ১৯৬০ সালের দিকে অর্থনীতিবিদরা একটি মূল্যায়ন করেন। তারা বুঝতে পারেন যে, নারীকে বাদ দিয়ে কোনও অর্থনেতিক কর্মকাণ্ড এগুনো সম্ভব নয়। কারণ তখনও পর্যন্ত খাদ্য ও জনসংখ্যা সমস্যা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলেন। এ দুটো সমস্যার সমাধানের জন্য নারীর সক্রিয় ভূমিকা দরকার, এটা তখনই তারা বুঝতে পারলেন। তাই তারা এ বিষয়ে একটি মূল্যায়ন করলেন। নারী যদি নিজের পরিবারটা ছোট রাখতে চান, তাহলে জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান সহজেই হয়ে যায়। ওদিকে খাদ্য সমস্যার সমাধানেও নারীর উদ্যোগী ভূমিকা অনেক কার্যকর। তাই বৈশ্বিক অর্থনীতির স্বার্থেই নারীকে অথনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা শুরু হল। এরপর থেকে নারী আর তাই উপকারভোগী রইলেন না, তারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অংশ হয়ে উঠলেন।

এরই পথ ধরে জাতিসংঘের নারীর মর্যাদা বিষয়ক কমিটি করা হল। ১৯৪৮ সালের মানবাধিকার সনদে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের ঘোষণা ছিল কিন্ত অধিকারের দিক থেকে নারী-পুরুষ সমান হলেও কিছু বাস্তবতা নারীকে পেছনে ঠেলে দেয়। নারী সন্তানের মা হন। তখন তার কিছু সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। তার বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়। দরকার হয় পুষ্টির। নারী যে শিশুকে ধারণ করেন সেই শিশু কিন্তু রাষ্ট্রের সম্পদ। তাই প্রাকৃতিক, অবস্থাগত ও রাষ্ট্রীয়- সব কারণেই নারীকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।

এসব দিক বিবেচনা করে নারীর মর্যাদা বিষয়ক কমিটি নারীর জন্য আলাদা সনদ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৯ সালে 'নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ' ( কনভেনশন ফর দ্য এলিমিনেশন অব অল ফর্মস অব ডিসক্রিমিনেশন অ্যাগেইনস্ট উওমেন ) সংক্ষেপে যেটিকে আমরা 'সিডও' বলি, তা পাশ করে। বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে এই সনদে স্বাক্ষর করে। অবশ্য দুটো ধারায় সংরক্ষণ রাখে বাংলাদেশ। ২ ও ১৬ ধারায়। সংরক্ষণ থাকুক চাই না থাকুক, সিডও কমিটি প্রতি চার বছর পরপর প্রতিটি দেশের কাছ থেকে নারীর অগ্রগতি সংক্রান্ত দুটি জাতীয় রিপোর্ট চায়। এ রিপোর্টের একটি সরকার দেন, অন্যটি এনজিও-দের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। এ দুটি রিপোর্টকে তুলনা করা হয়। সিডও কমিটিতে যারা রয়েছেন তারা এর মূল্যায়ন করেন। ২০১৫ সালে আমাদের এ রকম আরও একটি রিপোর্ট দিতে হবে।

নারীকে এগিয়ে দিতে হলে আমাদের দেশে যে সব পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হয় সেখানে নারীর জন্য বিশেষ সুবিধা রাখতে হয়। নারীর জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রতি বছরের জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ দেখাতে হয়। গত কয়েক বছর ধরে 'জেন্ডার-সংবেদনশীল বাজেট' শব্দটি পরিচিত হয়ে উঠেছে। দুটো কারণে আমরা এটা নিয়ে বলছি। প্রথমত, পিছিয়ে থাকা নারীকে এগিয়ে নিয়ে আসা। দ্বিতীয়ত, নারীর সঙ্গে পুরুষের কিছু মৌলিক জায়গায় পার্থক্য রয়েছে। নারীর অতিরিক্ত কিছু কাজ রয়েছে। জাতীয় বাজেটে যেসব বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, তার সবই নারী পাচ্ছেন কিন্তু আমরা বলছি নারী অতিরিক্ত কী পাচ্ছেন। মোর দ্যান দ্যাট। আর এ জন্যই বাজেটকে 'জেন্ডার সংবেদনশীল' করতে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গেই অর্থমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনার জন্য ক'জন নারী অর্থনীতিবিদের সঙ্গে বসেছিলেন। বাজেটে তৈরির বেশ আগেই সভাটি হয়েছে। সেখানে আমাদের দেওয়া কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। কিছু আগামীতে হবে বলেই আমরা আশা করছি।

বাজেটের আগেই আমরা প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে শুনেছিলাম মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করা হয়েছে। বাজেটে একে দলিলগত করলেন অর্থমন্ত্রী। তবে এই ছুটি বাস্তবায়নের কৌশল নিয়ে বাজেটে কিছু উল্লেখ নেই। তাই আমরা শঙ্কিত। কারণ এমনিতেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নারীরা এই ছুটিটা পূর্ণভাবে পান না। ব্যাংকিং সেক্টরেও এটা বাস্তবায়ন হয় না। আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে তো অবস্থা ভয়াবহ। নারীরা গর্ভবতী হলে সে তথ্যই লুকিয়ে রাখেন। কারণ সেখানে মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়া তো দূরের কথা, চাকরি থেকে বিতাড়িত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকেন মেয়েরা।

এখন এই পরিস্থিতিগুলো তো বদলাতে হবে। তাই সরকার শুধু মাতৃত্বকালীন ছুটির আইন করেই দায় সারতে পারেন না। তাকে আরও অনেক কাজ করতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সঙ্গত কারণেই তাদের লাভের কথা ভাবে। এ ক্ষেত্রে তাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা কীভাবে করা যায়, কীভাবে নারীদের এই ছুটিটা পুরোপুরি দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করা যায়, যারা বাজেট বাস্তবায়ন করবেন তাদের কীভাবে জেন্ডার-সংবেদনশীল করে তোলা যায়, সবাইকে এটা বোঝানো যে একজন নারী মা হচ্ছেন মানে তিনি একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছেন- এসব নিয়ে সরকারকে পেছনে অনেক কাজ করতে হবে। পাশাপশি আইন মানার ব্যাপারে সবার মধ্যে আগ্রহ তৈরি করতে হবে।

তবে এবারের বাজেটে অনেকগুলো কাজ হয়েছে। শিল্প ক্ষেত্রে বাজেটে বড় একটা অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি। নারী শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তাছাড়া সরকার ২৫ লাখ টাকা বন্ধকবিহীন ঋণ নারী উদ্যোক্তাদের দেওয়ার কথা বলেছেন। আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ কাজ হল, মোট এসএমই ঋণের ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের দেওয়ার জন্য প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে বলা হয়েছে। কোনও ব্যাংক এতে ব্যর্থ হল কিনা এটা দেখার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এটা খুব বড় একটা কাজ হয়েছে। বাজেটকে সত্যিকারের জেন্ডার-সংবেদনশীল করে তোলার ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপটি তাৎপর্যপূর্ণ।

হ্যাঁ, দারুণ একটি সুখবর হচ্ছে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন চালু হওয়া। এতদিন হিন্দু বিয়ে ছিল সাত পাকে বাঁধা। ফলে হিন্দু নারীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা সহজ ছিল। এটা এখন আর সম্ভব হবে না। তবে আমাদের একটি প্রস্তাব ছিল, সম্পত্তিতে নারীকে সমানাধিকার দেওয়া হচ্ছে না বলে নারীর স্বার্থে হেবানামা বা দানপত্রের রেজিস্ট্রেশন ফি কমাতে হবে। যদিএ জন্য বিশ বা ত্রিশ লাখ টাকা লাগে তবে এটাও একটা বাধা। ওই ট্যাক্সটা কমিয়ে ফেললে সেটা নারীদের জন্য একটি ইনডিরেক্ট হেলপ হবে। এবার দলিত সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে সরকার এ সম্প্রদায়ের নারীদের জন্য সাহায্যের সুযোগ করে দিলেন।

আরেকটি ভালো কাজ হল ২৫ মন্ত্রণালয়ের নারী চিত্র তুলে ধরা। তবে অর্থমন্ত্রী শুধু কত শতাংশ নারী উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল তা বলেছেন, বাস্তবায়ন কতটুকু হয়েছে সেটা বলেননি। আমরা চাচ্ছি এ সংক্রান্ত রিপোর্টটাও আসুক প্রতি বছর। কারণ বলা হল, আমরা এত ভাগ রেখেছি কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল এত ভাগ কাজই হয়নি। এটা তাহলে আর হবে না।

বাজেট পেশের সময় অর্থমন্ত্রী নতুন করে জানালেন যে নারী উন্নয়ন নীতিমালা অনুমোদন করা হয়েছে। কিন্তু এটির ধারাগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোনও নির্দশনা বাজেটে নেই। তাই আমরা একটু হতাশ হয়েছি। আমরা অপেক্ষা করছিলাম এই জন্য যে অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে একটি নির্দেশনা দেবেন। এমনিতেই এই নীতিমালা ১৯৯৭ সালে প্রণীত নীতিমালা নয়। ওই নীতিমালায় সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে। আর বর্তমানের নীতিটিতে শুধু স্বোপার্জিত অর্থে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমরা বিশেষত এই সরকারের কাছে আশা করেছিলাম যে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমনাধিকারের ব্যাপারে নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হবে। আমাদের সঙ্গে আলোচনায় সরকার জানিয়েছেন এ ব্যাপারে তাদের সদিচ্ছা রয়েছে। তবে ধীরে ধীরে এ ক্ষেত্রে এগুতে চাচ্ছেন তারা।

নীতিমালাটি যা আছে সেটিও কম নয়। এখন একে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবাযনের জন্য দরকার বাজেটে বরাদ্দ রাখা। নীতিমালায় আছে, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত নারীদের কাজ করার জন্য বাজেটে বরাদ্দ থাকবে। শহরে-গ্রামে যেখানেই নারী নির্যাতিত হচ্ছেন, সেটা প্রতিরোধের জন্য স্থানীয় নারী প্রতিনিধিরাই সবচেয়ে উপযুক্ত লোক। এখন এদের দিয়ে কাজটা করাতে হলে ওদের জন্য বরাদ্দ রেখে নারী নির্যাতন বন্ধের কাজটি করতে হবে। এবারের বাজেটে সেটা পাইনি আমরা।

আরেকটা প্রস্তাব ছিল বাল্যবিয়ে রোধ সংক্রান্ত। কোনও পরিবার মেয়েকে ১৮-র পর দিলে তাদের কোনও একটা ইনসেনটিভ দেওয়া হোক। হতে পারে সেটা একটা চাকরি। বাবা বা মেয়েকে দেওয়া হল। এ জন্যও একটি বাজেট লাগবে। অর্থমন্ত্রী আমাদের সেই সভায় প্রস্তাবটা গুরুত্ব দিয়ে শুনেছেন। তাই আশা করছি সেটাও সামনে হবে।

আমরা নারী কৃষকদের কথা বলেছিলাম। এখন কিন্তু দেশে নারী কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে। অনেক স্বামী বিদেশে গেলে নারী কৃষিকাজে যুক্ত হচ্ছেন। আবার ভূমিহীন নারীরা সরাসরি কৃষিকাজ করছেন। সমস্যা হল নারী কৃষিজমির মালিক নন বলে কৃষিকার্ড পান না। আর এটা না পেলে তিনি কিন্ত বীজ, স্যার, ভর্তুকিতে বিদ্যুৎ বা বীজ কিছুই পান না। এরা যদি কার্ড না পান তাহলে প্রকারান্তরে জাতীয় অর্থনীতিরই ক্ষতি হয়।

আমাদের চরাঞ্চলের নারীরা চরম আশংকার মধ্যে দিন কাটান। তারা শিক্ষাবঞ্চিত। সাধারণ স্বাস্থ্য বা প্রজনন স্বাস্থ্য কোনওটির জন্যই তারা আধুনিক চিকিৎসা পান না। ওদের জন্য আলাদাভাবে বরাদ্দ দিতে বলেছি আমরা। সেটাও এবার পাইনি।

নারীর আনপেইড লেবারের স্বীকৃতি দরকার ছিল। মানে, নারীর গৃহশ্রম। বিশ্বের অনেক দেশে এ কাজের অর্থনৈতিক মূল্যের কথা চিন্তা করে একে চিহ্নিত করার কাজ চলছে। আমাদের এখানেও এ দাবি রয়েছে আমাদের।

আমি বলব, একটি দারুণ শিক্ষানীতি পেয়েছি আমরা। কিন্তু কারিকুলাম যারা তৈরি করছেন তারা কতটা জেন্ডার-সংবেদনশীল? এ বিষয়ে তারা তো প্রশিক্ষণ পাননি। তাই এই কারিকুলাম যারা তৈরি করবেন তাদের জেন্ডার-সংবেদনশীল করে তুলতে হবে। বাজেট লাগবে এ জন্য।

বাজেটে উল্লেখ নেই পারিবারিক সহিংসতা আইন বাস্তবায়নের কৌশলের কথা বা এ নিয়ে কোনও বরাদ্দ নেই।

আমরা মনে করি, নারীকে স্বাস্থ্যগতভাবে সবল করতে পারলে ইভটিজিং দমন করা সহজ হত। তাই দীর্ঘকালে স্কুল-কলেজে মেয়েদের প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে হবে। এটা আমরা এবার পাইনি কিন্তু এর বিকল্প নেই। এটা করতেই হবে।

এখন দেশে নারী-প্রধান পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের নানা সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আমরা চেয়েছি তাদের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখতে। বিশেষ করে দরিদ্র নারীদের পরিবারগুলোর জন্য। সরকার এখন ওদের সাহায্য দিচ্ছেন নানাভাবে। তবে আমরা মনে করি প্রকল্প হিসেবে দিলে এরা বেশি উপকৃত হবেন।

সবচেয়ে বড় কথা, নারীর জন্য যে বাজেটগুলো করা হচ্ছে তা বাস্তবায়নের জন্য সমাজের সব পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দিয়ে পর্যবেক্ষণ কমিটি করতে হবে। এ বিষয়েও আমাদের প্রস্তাবনা রয়েছে। সরকার নারীর জন্য অনেক কিছু করেছেন বা করবেন বলেছেন। বাকি কাজগুলো করতে থাকলে আমাদের জাতীয় বাজেট পুরোপুরি একটি 'জেন্ডার-সংবেদনশীল বাজেট' হয়ে উঠবে।

হান্নানা বেগম : অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অন্যতম পরিচালক।