রোহিঙ্গা ক্যাম্প: একটি নতুন নগরীর জন্ম

লাকমিনা জেসমিন সোমা
Published : 14 March 2019, 01:27 PM
Updated : 14 March 2019, 01:27 PM

ঘরের চালে তরতর করে বেড়ে উঠছে পুঁই ও লাউয়ের ডগা। কচি পাতাগুলো গায়ে রোদ মেখে হাওয়ায়-হাওয়ায় দুলছে। খাঁ খাঁ পাহাড়ে জানান দিচ্ছে প্রাণের স্পন্দন! নতুন এক উজ্জীবনী শক্তি! নতুন এক জীবন!

দেড় বছর পর সেদিন কক্সবাজার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পা রেখে এমন দৃশ্য দেখে চমকে উঠলাম। যদিও এর মাঝে আরও একবার যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এবারের মতো এতটা পরিবর্তন দেখিনি। আমার কাছে স্রেফ মনে হলো, গত ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্টের পর থেকে স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায় কিংবা যে কারণেই হোক রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দিতে গিয়ে দারুণ অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ণ- এক কথায় রোহিঙ্গাদের মতোই ধর্ষণের শিকার হয়েছে আমাদের পাহাড়ও। বিশ্ব রাজনীতির ঔরসে সেই ধর্ষিত পাহাড়ের কোলে জন্ম হয়েছে নতুন এক শিশুর। এই শিশুটিকেই আমি বলছি নতুন এক নগরী। যে শিশু বা নগরী যেন কোনওভাবেই আমাদের না। রোহিঙ্গাদের। এটি রোহিঙ্গা নগরী। এটি বাংলাদেশের বুকে কথা না রাখা এক অসভ্য দেশের অসভ্যতা থেকে জন্ম নেওয়া সভ্যতা! আমি বলবো- মানবিকতার নামে আমাদেরকে, আমাদের পাহাড়-বনভূমি-সমুদ্র-প্রকৃতিকে, আমাদের দেশ মাতৃকার আপন সন্তানদেরকে কেবল ঠকানো হয়েছে। দারুণভাবে যত্ন করে দিনের পর দিন ঠকানো হয়েছে। এখনও হচ্ছে। এবং আমি নিশ্চিত- ভবিষ্যতেও ভয়ানকভাবে ঠকানো হবে।

দেড় বছর আগে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শুরুতে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে টানা তিন সপ্তাহ মতো ছিলাম। এরপর গেল বছর জুলাইয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস ওদের দেখতে এলে তখন এক সপ্তাহ থাকা হয়েছে। সর্বশেষ হলিউড সুপারস্টার অ্যাঞ্জেলিনা জোলির খবর সংগ্রহে গেলাম।

কুতুপালং-এ দেড় বছরের পরিবর্তন আমাকে দারুণভাবে পীড়া দিলো। এই পরিবর্তনকে আপনি ইতিবাচক না-কি নেতিবাচক বলবেন তা আপনার ব্যাপার, অন্তহীন বিতর্কের ব্যাপার। সাংবাদিক হিসেবে আমি শুধু ফ্যাক্টটা তুলে ধরছি এখানে।

অগাস্টে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সময় বা তার কিছু পরে সংবাদ সংগ্রহে ক্যাম্পের ভেতরে যেতে যুদ্ধ করতে হতো আমাদের। পায়ে হাইনেক জুতা দিয়ে হাঁটু সমান কাদা ডিঙিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের খবর নিতে যেতাম। তখনও দুর্গম এলাকায় খাবার পৌঁছতো না। পানির জন্য হাহাকার করত মানুষ। এবার দেখলাম সেই পাহাড়ের বুক চিরে, ক্যাম্পের ভেতর দিয়ে সাপের মতো বিষ ছড়িয়ে এঁকে-বেঁকে চলে গেছে পাকা রাস্তা-ঘাট। যেখানে আমরা পা রাখতে ভয় পেতাম সেখানে অবলীলায় চলছে মালবাহী বিশাল ট্রাক, যাত্রীবাহী বাস, দামি জিপ, অটো রিক্সা, ভ্যানসহ অন্যান্য যানবাহন।

এবার গিয়ে একটি মাইক্রেবাসে আমরাও চললাম সে পথ ধরে। দেখলাম প্রথমবার সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে এক রাতে যে নালাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম সেই পাহাড়ি নালার উপর এখন কংক্রিটের ব্রিজ হয়েছে। শুধু ওখানটায় না, এমন ব্রিজ হয়েছে আরও অনেকখানে। মনে মনে ভাবলাম, এমন একটা ব্রিজের জন্য সংসদে আমাদের এমপিরা কতই না ফেনা তোলেন। এখনও কত যুদ্ধ করতে হয় আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের। খবরের কাগজ খুললে এখনও চোখে পড়ে গ্রামে-গঞ্জে ব্রিজ-কালভার্ট এর অভাবে শিশুদের ভোগান্তির স্কুলযাত্রার ছবি।

যাইহোক, দেখলাম ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ক্যাম্পের মোড়ে মোড়ে বাজার বসেছে। টাটকা শাক-সবজি মাছ কিনে ঘরে ফিরছে রোহিঙ্গারা। পুরান ঢাকার মতো পারিবারিক ক্ষুদ্র ব্যবসা তাদের। ইউএনএইসসিআর বা আইওএম এর তৈরি করে দেওয়া ঘরের একপাশ ব্যবহৃত হচ্ছে থাকা-খাওয়ার কাজে, অন্য পাশ দোকানদারিতে। এসব ছোটখাটো দোকান ছাড়াও ক্যাম্পের মধ্যে বেশকিছু বড় স্থায়ী বাজার গড়ে উঠেছে। গ্রামের মানুষেরা পাড়ার দোকানে প্রয়োজনীয় জিনিস না পেয়ে যেমন গঞ্জে যায়, অনেকটা তেমন। রোহিঙ্গাক্যাম্প নামক নতুন নগরীতে গড়ে ওঠা গঞ্জে খাবার হোটেল থেকে শুরু করে জুয়েলারির দোকান- সবই আছে। ইলেকট্রনিকস পণ্য, জামা-কাপড়, জুতা, ওষুধ, জ্বালানি কাঠ, গ্যাসের সিলিন্ডার, দা-বটি-কুড়াল, রড-সিমেন্ট, দৈনন্দিন জীবনের সব, সবকিছুই পাবেন এখানে। এমন কি তাদের হাটে বিভিন্ন হাতুড়ে ডাক্তাররাও বসে! কেউ কেউ আসে আয়ুর্বেদিক পণ্য নিয়ে। এক কথায় জমজমাট ব্যবসা বাণিজ্য। বাজার ঘুরে দেখলাম, এই বাজারের অন্তত ৪০ ভাগ পণ্যই আসছে মিয়ানমার থেকে, চোরাই পথে। প্যাকেটের গায়ে সে দেশের ভাষায় লেখা পণ্যের বর্ণনা অন্তত তা-ই প্রমাণ করে। বাকি পণ্যের (বিশেষ করে খাদ্যপণ্য) অর্ধেকই বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া রিলিফ বা ত্রাণসামগ্রী যা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হওয়ায় বিক্রির জন্য দোকানে তুলেছে তারা।

স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন এলো- এদের ক্রেতা কারা? টাকা-ই বা পায় কোথায়? এই প্রশ্নটি করছিলাম কুতুপালং ক্যাম্পের ডি-৫ ব্লকের এক ওষুধের দোকানদারকে। তিনি যেটি জানালেন তার সারমর্ম হলো- ইউএনএইচসিআর এর 'ক্যাশ ফর ওয়ার্ক' নামে কোনও এক প্রকল্পের আওতায় বহু আগে থেকেই রোহিঙ্গারা কাজের বিনিময়ে টাকা পায়। অন্যান্যদেরও এমন প্রকল্প আছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকের পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে থাকে। নিয়মিত টাকা পাঠায়। এছাড়া কক্সবাজারের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে (চেয়ারম্যান, মেম্বার) যৌথ বিনিয়োগে দোকানদারির মতো এই ছোট-খাট ব্যবসা বাণিজ্যও করছে তারা। সুতরাং এদের টাকার অভাব নেই। এদের ক্রেতা স্থানীয় কক্সবাজারবাসীও। আমার সহযাত্রীদের একজন জানালো তিনি নাকি এদের দোকান থেকে বিয়ারও কিনেছেন। আরেকজন জানালেন, তার স্ত্রীর পিরিয়ডের সময় এদের কাছ থেকেই স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনেন। সব মিলিয়ে আমরা পাঠ্যবইয়ে যেমন প্রাচীন অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে ওঠার ইতিহাস পড়েছি, তেমনটিই বাস্তবে দেখলাম রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হওয়ার আগেই ক্যাম্প ছাড়তে হয় এনজিও, আইএনজিওসহ বিশাল টাকার বিনিময়ে যারা রোহিঙ্গাদের সেবা দেন (চাকরি করে) তাদেরকে। তবে এই নিয়ম না মেনে অনেকে থেকেও যান। লক্ষ্য করলাম, পড়ন্ত বিকেলে রোহিঙ্গা নগরীতে কিছুটা শান্ত পরিবেশ নেমে আসে। কেউ ঘুমায়, কেউ ঘরের দাওয়ায় বসে বিশ্রাম নেয়। বাড়ির মহিলারা একে অন্যের চুলে তেল দিয়ে দেয়, বিলি কাটে, উঁকুন মারে। যুবকেরা মোবাইলে হিন্দি গান শোনে। আরো মজার ব্যাপার হলো পাড়াগাঁয়ের মতোই ক্যাম্পে গড়ে ওঠা ওইসব হাট-বাজারে সিনেমার আসরও বসে। পড়ন্ত বিকেলে ছেলেরা গঞ্জে আসে টিকেট কেটে হিন্দি সিনেমা দেখতে। এসব দৃশ্যে আমি পুরোই বিমোহিত। আসলে আমি একটা গ্রামীণ ফ্লেবার উপভোগ করছিলাম আর ভেতরে ভেতরে পুড়ছিলাম।

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নেমে এলো অবাক করা আরেক দৃশ্য! সর্পিল রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসানো বৈদ্যুতিক খুঁটিতে জ্বলে উঠলো বাতি। অন্ধকার পাহাড় আলোকিত করে জেগে উঠলো নতুন এক নগর অথবা গ্রামীণ জনপদ। দূরে তাকিয়ে দেখলাম নতুন করে বেশকিছু মোবাইল কোম্পানির টাওয়ারও বসানো হয়েছে। সেগুলোর মাথায় জোনাকির মতো জলছে লাল-নীল বাতি। হঠাৎই মনে হলো আমার ডিজিটাল বাংলাদেশে বহু মানষের ঘরে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। অথচ এখানে!

দিনভর ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত-শ্রান্ত হলেও আমার বিস্ময় কাটেনি তখনও। তাই-ই ক্যাম্পের একটি চায়ের দোকানে বসলাম। সেখানে আন্তর্জাতিক সংস্থার হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করে এমন কয়েকজন বন্ধুকে আগেই আসতে বলেছিলাম। সঙ্গে যুক্ত হলেন আরেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা (আমার পূর্ব পরিচিত বড় ভাই)। তাদের কাছ থেকে গল্পে গল্পে দারুণ কিছু তথ্য পেলাম। বিশেষ করে ক্যাম্পের ভেতরের সামাজিক নিরাপত্তা ও অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ে। জানলাম, কিছুদিন আগে একটি খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। নিরাপত্তার  অভাবে ক্যাম্পে না এসে দুইদিন বাড়িতেই কাটিয়েছেন তারা। ধর্ষণের পর এক রোহিঙ্গা নারীকে খুন নিয়ে ঘটনাটি ঘটেছিল। এ নিয়ে গণমাধ্যমেও কোন খবর চোখে পড়েনি।

আরো জানলাম, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অনেক ব্লকে ইদানিং নাকি যুবতী মেয়েরা বোরকা ছাড়া ঘুরতে পারে না। ফিটিংস বোরকা পরলে ব্লেড বা ছুরি দিয়ে তা কেটে দেয়া হয়। পোশাক-আশাক নিয়ে কম-বেশি বিব্রত দেশি-বিদেশি নারী এনজিও কর্মীরাও। এমনকি পশ্চিমা নারীরা অনেকে এখন অফিস আদেশ মেনে লম্বা সালোয়ার কামিজ এবং ওড়না পরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যায়। অবশ্য তারা কাজ শেষে সন্ধ্যায় কক্সবাজার ফিরে বারে ঢোকেন। ড্রিংকস করেন। নিজ দেশের সংস্কৃতির মতোই সেখানে তাদের চলাফেরা। তাদেরকে সঙ্গ দেয় আমাদের বাংলাদেশিরাই। কক্সবাজারকে আমূল বদলে যাওয়া এই সাংস্কৃতিক মিশ্রণ নিয়ে গল্প না হয় আরেকদিন বলব।

রোহিঙ্গারা নাকি ধর্মভীরু! অথচ, এবার গিয়ে আমার বেশ ক'জন সোর্সের মারফতে জানলাম, ক্যাম্পে দিব্বি বেড়ে চলেছে সেক্স ওয়ার্কারের সংখ্যা। চলছে মাদক বেচা-কেনা। স্থানীয় ভাষা শিখে শহরে-শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা। স্থানীয় এক চেয়ারম্যান নাকি এরইমধ্যে একাধিক রোহিঙ্গা মেয়েকে বিয়ে করেছেন। অনেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নিজের ছেলে মেয়ে পরিচয় দিয়ে রোহিঙ্গাদের ন্যাশনাল আইডি কার্ড করিয়ে দিচ্ছে। স্থানীয় স্কুল কলেজে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে তারা। এমন একটি ছেলের সাথে কথাও হলো। অন্যদিকে আরাকান সোসাইটি ব্যানারে রোহিঙ্গা নেতা তৈরি হয়েছে আরো আগেই। গত জুলাইয়ে ওদের সাথে কথা হয়েছিল। এবার গিয়ে দেখলাম, তারা ভার্চুয়ালি দেশে বিদেশে স্যোশাল মিডিয়ায় গণহারে যুক্ত হচ্ছে।

একটি ওয়াটসআপ গ্রুপ পেলাম, যেখানে প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গা সদস্য যুক্ত। তবে কি ওরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে? কেন হচ্ছে? নিজ দেশে ফিরে যেতে? নাকি আমাদের জন্য নতুন কোন বিপদ ডেকে আনতে? এখানে আমার একটি প্রশ্ন আছে- আমাদের  সেন্টমার্টিনসকে নিজেদের দাবি করার সাহস পায় কীভাবে মিয়ানমার?

ইউএনডিপির তথ্য বলছে, রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দিতে গিয়ে কক্সবাজারে কেবল বনভূমিই নষ্ট হয়েছে অন্তত ২৬ হাজার হেক্টর। প্রাকৃতিক ও সামাজিকভাবে কতটা বিপর্যস্ত কক্সবাজার তা সবারই জানা। কিন্তু কী অপরাধ এই স্থানীয় জনগোষ্ঠির? বিদেশ থেকে কত নামিদামি লোকেরাই তো রোহিঙ্গাদের দেখতে আসেন, কেউ কি স্থানীয়দের কাছে একবারও জানাতে চান-তারা কতটা ভুক্তভোগী?

'স্বেচ্ছা, নিরাপত্তা ও মর্যাদাপূর্ণ' পুনর্বাসন- এই তিনটি শব্দের বেড়াজালে বন্দি হয়ে কাঁদছে বাংলাদেশ। কাঁদছে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন। চুক্তি সইয়ে উল্লিখিত এই তিনটি শব্দ ব্যবহার করে জমিয়ে রাজনীতি করছে মিয়ানমারসহ বাকি সবাই। গোটা বিশ্ব, বিশ্বের নেতা কিংবা সেলিব্রেটিরা। জাতিসংঘ মহাসচিব থেকে শুরু করে নামি দামি যারা-ই আসছেন তারা বাংলাদেশকে 'মহান' আখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এই আখ্যা শুনে আনন্দে যখন আত্মহারা আমরা, ঠিক তখনই আরেক মহান বাণীতে তারা বলছেন- 'রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে প্রস্তুত না।' আমরা এই বাক্যের অর্থ বুঝেও বুঝতে পারছি না। নিরব দর্শক হয়ে শুধু দেখছি আর প্রশংসিত হয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি।

দেখলাম, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের স্থায়ী ঘর তুলছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। নিত্য-নতুন প্রকল্প সাজাচ্ছে। কিন্তু ক'জন জানেন যে এই দাতাগোষ্ঠিরা একেকটি প্রকল্পে রোহিঙ্গাদের জন্য যে পরিমাণ টাকা ঢালছে তার ৪০ থেকে ৬০ শতাংশই ব্যয় (অপব্যায়) হচ্ছে 'অ্যাডমিন কস্ট'এর নামে চুরি-চামারি করে। রোহিঙ্গাদের সেবা-শুশ্রূষা এবছর আবার ৯২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লাগবে বলে দাবি তুলেছে ইউএনএইচসিআর ও আইওএম। গেল বছর তারা ৯৫০ মিলিয়ন ডলার চেয়ে পেয়েছে ৬৫৫ ডলার। বাকিটা কি তবে তারা নিজেদের পকেট থেকেই দিলো! ঢাকায় ফিরে এক অনুষ্ঠানে আইওএম এর বাংলাদেশ প্রধান গিওরগি গিগৌরির কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বললেন- 'গতবছর পুরোটা না পেলেও যা পেয়েছি তা যথেষ্ট ছিলো।' এবার বছর আরো ভালো রেসপন্স পাওয়া যাচ্ছে বলেও জানালেন তিনি। একই অনুষ্ঠানে হেসে হেসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বললেন, 'রোহিঙ্গারা যেতে চায় না। তারা ভাসানচরেও যেতে চায় না। অথচ, ওরা জানেনা ওখানে গেলে ওরা আরো সুখে থাকবে। ওখানে ওদের জন্য আমরা সুন্দর-সুন্দর বাড়ি-ঘর বানিয়েছি। ওদের জন্য কৃষিকাজের ব্যবস্থা করেছি। ওরা ওখানে মাছ ধরবে, গরু-ছাগল লালন-পালন করবে।' জিজ্ঞেস করলাম- তাহলে কেন যেতে চায় না? মাননীয় মন্ত্রী হেসে হেসেই বললেন- 'কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেসব এনজিও সংস্থা কাজ করে তারাই হয়ত চায় না রোহিঙ্গারা ফিরে যাক, হয়ত তারাই ওদের বোঝাচ্ছে ভাসানচরে না যাওয়ার জন্য।' আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম- তাহলে কী এই এনজিও সংস্থাগুলোর উপর আপনাদের কোনও নজরদারি নেই? উত্তরে তিনি আরেক গাল হেসে বললেন, 'এটা দেখার দায়িত্ব ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের।'

যাইহোক, অনেকটা বিরক্তি আর মন খারাপ নিয়েই সেদিন রাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বের হয়েছিলাম। উখিয়া বাজারে পা রেখে মনে হয়েছিল হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। উহফ্ দিনভর যেন তারকাটা পেরিয়ে অন্য কোন দেশ চষে বেড়িয়েছি। ওই পাহাড়, ওই অরণ্য ধ্বংস করে গড়ে ওঠা হাজার হাজার খুপড়ি ঘর, ঘরের চালায় স্বাস্থ্যবান পুঁই-লাউয়ের ডগা- ওগুলো কোনও কিছুই আমাদের না। মেশিন চালিয়ে পাহাড়ের বুক রক্তাক্ত করে তার উপর বানানো হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট আমাদের সেই কুমারি পাহাড়ের বুক হতে পারে না। ও অন্য কোনও নগরী, অন্য কোনও অশনিসংকেতে ভাসা সভ্যতা যা ক্রমান্বয়ে গ্রাস করেছে আমাদের চিরচেনা কক্সবাজারকে। চিরচেনা প্রকৃতিকে।

বৈশ্বিক জঙলি রাজনীতি আমার দেশের মানুষের কথা একটিবারও ভাবেনি। ভেবেছে শুধু ক্ষমতা, আধিপত্য আর সম্পদের মালিকানা নিয়ে! এই যে প্রতিনিয়ত আমাদের এমপি-মন্ত্রীরা মুখে ফেনা তুলছেন- প্রাণপ্রিয় ভারত, দুঃসম্পর্কের আত্মীয় চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র সবাই নাকি আমাদের পাশে আছে। সত্যিই কি পাশে আছে?