ডাকসুর ফলাফল : নূর এর আলেয়া না সাহসের জ্যোতি?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 12 March 2019, 01:23 PM
Updated : 12 March 2019, 01:23 PM

অনিয়মের নানা অভিযোগ এবং অধিকাংশ প্যানেলের প্রার্থীদের বর্জনের মধ্যে ২৯ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত ছাত্রলীগ অন্য প্রায় সব পদে জয়ী হলেও ভিপি পদটি জিতে নিয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের নেতা নুরুল হক নূর। এবারই প্রথম সরকারি দল সমর্থিত ছাত্র সংগঠনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (ডাকসু) অধিকাংশ আসনে বিজয়ী হতে দেখা গেলেও ভিপি পদের ক্ষেত্রে আগের ধারাবাহিকতাই থাকল। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছর বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ব্যানারে জোরাল আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে পরিচিত পান এই ফোরামের যুগ্ম আহ্বায়ক নূর।

ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে এখন কিছু বলা না বলা নিরর্থক। বিশেষজ্ঞের অভাব নাই দেশে। মতামত দেয়ার লোকেরও অভাব নাই। টক শো কলামে মানুষকে বিরক্ত না করা পর্যন্ত এ কাজ চলতেই থাকবে। তাই আমি সেদিকে যাবো না। আমি বলবো একজন প্রবাসী বাংলাদেশীর মনের দুঃখ আর বেদনার কথা। আমাদের এখন পড়ন্ত বয়স। কৈশোরের উন্মাদনা যৌবনের উচ্ছ্বলতা এমনকি পৌঢ় বয়সের আশাও বিগত। প্রায় গোধুলিতে দাঁড়ানো মানুষ আমরা। কত কি দেখলাম এই দেশে। আমাদের সময় আমরা বিশ্বাস করতাম ডাকসু জন্ম দেয় ভবিষ্যত নেতৃত্বের।

বড় বিচিত্র সমাজ আমাদের। এই ডাকসু নিয়ে কত কথা কত স্বপ্ন। সবার আগে বলি বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আসলে কি ডাকসুর ইতিহাস জানেন আপনি? উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতি আশা করছেন অথচ ডাকসুর প্রথম সম্পাদক বা তাদের উত্তরাধিকারের কথা বলেন না। এখানে দুটো কারণ লুকিয়ে। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয় যখন সত্যি অক্সফোর্ড নামে পরিচিত ছিলো তখন এখানে নূরের মত ছেলেরা থাকলেও লুকোছাপায় থাকতো। তাদের আসল স্বরূপ তখনো উন্মোচিত হয়নি। যেমন গোলাম আজম। আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না যৌবনে তিনিও প্রগতিশীলই ছিলেন। ভাষা আন্দোলনেও কিছু কাজ আছে তাঁর। কিন্তু ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় পথ হারানো পাকিস্তানের দালালী করতে গিয়ে তিনি হয়েছিলেন দেশবিরোধী। এমন কি আসলেই একজন? সে কথায় পরে আসছি। তার আগে বলি এই যে অতীতের দিকে না তাকানো এবং অস্বীকার করা বা ভুলে যাবার ভান করা তার কারণ ও সাম্প্রদায়িকতা। ইতিহাসের নামগুলো দেখলেই বুঝবেন কেন আমরা তাদের কথা বলি না।

১৯২২ সালের ১লা ডিসেম্বর কার্জন হলে অনুষ্ঠিত শিক্ষকদের একটি সভায় ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ' নামে একটি ছাত্র সংসদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯২৩ সালের ১৯শে জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নির্বাহী পরিষদ পূর্বোল্লিখিত শিক্ষক সভার সিদ্ধান্তকে অনুমোদন দেয়। ১৯২৫ সালের ৩০ অক্টোবর সংসদের সাধারণ সভায় খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিষদ অনুমোদন করলে তা কার্যকর হয়। প্রথমবার ১৯২৪-২৫ সালে সম্পাদক ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, পরের বছর অবনীভূষণ রুদ্র। ১৯২৯-৩০ সালে সম্পাদক নির্বাচিত হন আতাউর রহমান খান।

পরবর্তীতে ১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে পূর্বনাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ' গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ডাকসুর সহসভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মাহবুবুর জামান।

এই  নামগুলো কেবল বিশেষ কোন ধর্মের নাম না। এখানে আতাউর রহমান থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নামও আছে। এরা রাজনীতিতে কৃতিত্ব দেখানোর পরও আজকাল তেমন ভাবে সমাদৃত নন। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা দুধ  ও পানিকে এক করে ফেলি। পরে আর দুধকে দুধ পানিকে পানি বলে চিহ্নিত করতে পারি না। কে পরে কোন দল করলো কেন করলো বা কিভাবে কার কি হলো সেটা যেমন জরুরী তেমনি ইতিহাস ও অতীতকে স্বীকার করাও জরুরী। না হলে কেউ ডাকসুর সঠিক শক্তি বা তেজ বিষয়ে ধারণা পাবে না। বলছিলাম নেতৃত্বের কথা। অতীতে  ডাকসু আমাদের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধকে পথ দেখিয়েছে বলে আমরা গর্ব করি। এটা সত্য। এখানে  অনেক বড় বড় কাজ হয়েছে। আইউব বিরোধী আন্দোলনে তোফায়েল আহমেদ বা দেশের অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীর অবদান ভোলা যাবে না। অপরাধ হবে যদি রাশেদ খান মেননদের কথা না বলি। একাত্তরে আ স ম রবের ভূমিকা চার খলিফার ভূমিকা বলতেই হবে। স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ সর্বত্র আছে তাদের ত্যাগ আর সাহসের পথ চলা। কিন্তু এখানেই শেষ না।

দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রবল বিরোধিতা আর ষড়যন্ত্রে আ স ম রব জাসদ করতে গিয়ে আজ রাজনৈতিক এতিম। তাঁর মত নেতা এরশাদের দালালী করেছে। গৃহপালিত নেতা হিসেবে এদেশের রাজনীতি ও বিরোধী দল ধ্বংসের নায়ক আ স ম রবও কিন্তু ডাকসু নেতা। আ স ম আবদুর রব ডাকসুর ডাকসাইটে নেতা। পরে কি হলো? যে বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে নেতা তাঁর দুশমন। এরশাদের মতো জান্তার দালাল আর এখন? পারলে মুক্তিযুদ্ধ চিবিয়ে খায়।

ডাকসু নেতা আখতারুজ্জামান। সমাজতন্ত্র চুলোয় তুলে আওয়ামী ধামা ধরায় ব্যস্ত। দু'বার জেতা নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। পঁচতে পঁচতে এখন গন্ধও ছড়াতে পারেন না। হেন কোন শক্তি অপশক্তি নাই যাদের সাইজ মতো ফিট হননি। মনে পড়ে জিয়াউদ্দিন বাবলুকে? সেই তেজ এখন এরশাদের কবলে এমন বন্দী যে দ্বিতীয় ধারা গ্রহণে এরশাদ আত্মীয়তায় পরিপূর্ণ। সুলতান মোহাম্মদ মনসুরও ভিপি ছিলেন। ধানের শীষে জিতে নৌকার কোলে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ ফকির হতে চায় না। সবাই হালুয়া রুটির সুলতান। এককালে পথ দেখাতো বলতে বলতে ক্লান্ত আর আত্মতুষ্ট মিডিয়া ও জাতির ইহাও জানা উচিৎ যে কলা গাছে আঙুর ফলে না।

এবার ভি পি পদে জিতে আসা যুবকটিকে আমি চিনি না।  কেউ বলছে সে নাকি ছাত্র শিবিরের নেতা, কোটা  আন্দোলনের নেতা। কোটা আন্দোলনের নামে যে উত্তেজনা যুবককে 'আমি রাজাকার' বুকে লিখে মাঠে নামিয়েছিল সে আন্দোলনের নেতার রাজনৈতিক অতীত বা ইতিহাস বিবেচনা করে ভূমিকা রাখা বা কাজকর্মের গতি ঠিক করা উচিৎ ছিলো। কিন্তু সে সময় আছে কারো? এক দলের ধারণা যেন তেন প্রকারে তাদেরকে জিতিয়ে আনা হবেই। ভোট পড়ুক আর না পড়ুক তারা জিতবে। কাজেই কষ্ট করার কি দরকার? এই সমস্যা আজকের না। ছাত্রলীগের তো কিছু হলেও আছে। আছে অতীত গৌরব, বর্তমান সরকারের সাফল্যের অংশ। নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের কি ছিলো? তারপরও এরশাদ আমলে তারাই জিততো এভাবে। ছাত্রদল তো মেয়েদের বুকের ওড়না কেড়ে নিয়েও জিতেছিল। আজ যারা মুখে বড় বড় কথা বলছে তারা ভুলে যায় ডাকসুতে বরাবর এসব হয়েছে। কিন্তু শিবির নামধারী বা স্বাধীনতা বিরোধী বলে সন্দেহজনক কেউ জেতেনি। আজ  চেতনার পরিবেশ এতটাই ভালো যে তার জয়ও মানতে হয় । ক'দিন আগে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা মোহাম্মদ নাসিম সংসদে বলেছেন চারদিকে এখন আওয়ামী লীগার। সবাই রাতারাতি আওয়ামী লীগার বনে গেছে। তাঁর মতে তাঁর মত সিনিয়র নেতাও এসব দেখে ভড়কে যান। তিনি এটিকে উদ্বেগজনক বলে মনে করেন। উদ্বেগ থাকার কারণ আছে কি নাই তার প্রমাণ সবাই দেখছে এখন।

ডাকসুর যে সব ছাত্র ছাত্রীরা নির্বাচন সঠিক হয়নি বলে বর্জন ও আবার নির্বাচন চেয়েছিল তারা কি নূরকে মেনে নেবে? মেনে নেবে বাকীদের? না তাদের ঘোষণা অটল থাকবে? তেজহীন তেজপাতা রাজনীতিতে এখন সব তেজ তেলে পড়লেই চুপসে যায়। ডাকসু কি পারবে আর কি পারবে না সেটাই দেখার বিষয়।

জিতলে কি আর হারলেই বা কি??