প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ এবং কিছু কথা

শুভংকর বিশ্বাস
Published : 5 March 2019, 10:26 AM
Updated : 5 March 2019, 10:26 AM

ছোট বেলায় আমার স্কুল, খুলনার চুকনগরের দিব্যপল্লী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের রতন স্যার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গৃহীত সরকারী সিদ্ধান্তের দৈন্য দশা বোঝাতে একটা উদাহরণ দিতেন সবসময়। বলতেন, "বাইসাইকেল শিল্পের জন্য ভারত ও বাংলাদেশ একই সময়ে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে মোটা অংকের ঋণ নিয়েছিল। বাংলাদেশ আনন্দের সাথে ঋণের সমস্ত অর্থ খরচ করে অনেকগুলি সাইকেল কিনেছিল; যেখানে ভারত কোনও সাইকেল না কিনে মাত্র একটি সাইকেল তৈরির কারখানা স্থাপন করেছিল। দুই প্রতিবেশি দেশের বিপরীতধর্মী এই সরকারী সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ আজ আমরা ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে সাইকেল আমদানি করি, পক্ষান্তরে ভারত এখন নিজেদের দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে সাইকেল রপ্তানি করে।" রতন স্যারের উদাহরণের সাথে বাস্তব ঘটনার আক্ষরিক অর্থে কোনও মিল ছিল কি-না তা বলতে পারি না, কিন্তু এর মর্মার্থ উপলব্ধি করতে সেই সময়েও আমাদের কোনও বেগ পেতে হয়নি।

কালের আবর্তে হেনরি কিসিঞ্জারের ভাষায় তলাবিহীন ঝুড়ি সেই বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিকভাবে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিক্রমায় বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে (মাথাপিছু জাতীয় আয় কমপক্ষে ১০৪৬ ডলার)। এই স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার এখন ২০২১ সালকে 'পাখির চোখ' করেছে নিম্ন-মধ্যম থেকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে (মাথাপিছু জাতীয় আয় কমপক্ষে ৪১২৬ ডলার) উন্নীত করার জন্য। কিন্তু অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এটা মোটেও সহজ কাজ নয়। তাদের মতে, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আরও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন ও মানব সম্পদ উন্নয়নসহ অনেক অনেক বিষয়ে উন্নতি করতে হবে।

সরকারও অবশ্য বসে নেই। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সরকার নানাবিধ কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় মানব সম্পদ উন্নয়নকল্পে সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট কর্তৃক "টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট অর্জনে জনপ্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ" প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় উচ্চতর শিক্ষায় (মাস্টার্স ও পিএইচডি) "প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ- ২০১৯" বৃত্তি প্রদান করা হবে। মাস্টার্সের ক্ষেত্রে প্রদেয় অর্থের পরিমান ৬০ লাখ টাকা, আর পিএইচডিতে ২ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে অনায়াসেই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ যেকোনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুব ভালোভাবেই পড়ে আসা সম্ভব। তবে এই বৃত্তির জন্য আবেদনের যোগ্যতা নেহাতই কম নয়। যেমন, আবেদনকারীকে THE অথবা QS র‍্যাংকিং (এই বিষয়ে অন্য একটি লেখায় বিষদভাবে আলোচনা করব) অনুযায়ী বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য থেকে নিঃশর্ত অ্যাডমিশন অফার থাকতে হবে এবং IELTS স্কোর কমপক্ষে ৬ বা TOEFL iBT স্কোর কমপক্ষে ৮০ হতে হবে। তাছাড়া কিছু কঠিন শর্তাবলীও সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যথা- ফেলোশিপপ্রাপ্ত ব্যক্তি অধ্যয়ন শেষে দেশে ফিরে কমপক্ষে ২ বছর কর্মজীবন অতিবাহিত করবেন মর্মে দুই জন সাক্ষীর (৫ম গ্রেডের সরকারী কর্মচারী বা তার উর্ধ্বে) সাক্ষরসহ নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে এই মর্মে বন্ড প্রদান করবেন যে, অধ্যয়ন শেষে দেশে ফেরত না আসলে ফেলোশীপ বাবদ গৃহীত সমুদয় অর্থ সরকারকে ফেরত দিতে বাধ্য থাকবেন। অন্যথায় প্রকল্প দপ্তর ফেলোশীপ প্রাপ্ত ব্যক্তি কর্তৃক গৃহীত অর্থ আদায়ের জন্য Public Demands Recovery Act 1913 বা অন্য কোনও প্রযোজ্য আইনে মামলা ঠুকে দিবে।

তবে শর্তাবলীতে লখিন্দরের বাসর ঘরের মত কিছু ফাঁক-ফোকরও আছে। যেমন, যদি কেউ ডিগ্রি শেষ করে দেশে ফিরে এসে দুই বছর কর্মজীবন অতিবাহিত করতে না চায়, তবে মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকায় দফারফা করা যাবে (ধরি, এই টাকার পরিমাণ শিক্ষাছুটিতে থাকাকালীন পৃথকভাবে গৃহীত মুল বেতনের চেয়েও কম!)। এক্ষেত্রে ফেলোশিপ প্রাপ্ত ব্যক্তি সাক্ষীদ্বয়কে মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকা দিলেই (যেটা সাক্ষীদ্বয় পরে সরকারকে প্রদান করবেন) মামলা শেষ! অর্থাৎ, মাস্টার্সের বৃত্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি কোর্স শেষে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোথাও পিএইচডির সুযোগ পেলে, বা পিএইচডির বৃত্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি কোর্স শেষে কোথাও পোস্ট-ডক্টরেট ফেলোশিপ বা শিক্ষক হিসেবে চাকরির সুযোগ পেলে দেশে ফিরে আসার বাধ্য-বাধকতা সারার পর মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ২ বছরের অধ্যয়নোত্তোর কর্মজীবনের শর্তটি  হিসেব চুকাতে পারছেন। কিছুদিন পর আবার অনায়াসেই চলে যেতে পারবেন। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে সরকার তথা দেশবাসী আম ও ছালা দু'টিই হারাবেন।

এবার আমাদের রতন স্যারের পাঠ সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। আমরা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবো, সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত সকল অর্থই কিন্তু বিদেশে ব্যয় হবে যেহেতু বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আমাদের দেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় নেই। বিনিময়ে অবশ্য আমাদের জনপ্রশাসনের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আরও একটু সুদূরপ্রসারী চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাবো, এই অর্থ বিদেশে বৈধভাবে পাচার না করেও (আমি এটাকে পাচারই বলব) আমাদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ আছে। শুধু দরকার সরকারের সামান্য আন্তরিকতা এবং একটু উদ্যোগ। কিভাবে? দেখুন, প্রায় দশ বছর প্রবাস জীবনের প্রায় পুরোভাগে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা আর চাকরির সুবাদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীদের সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। অধিকাংশই আজ ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও আমেরিয়কাসহ বেশ কয়েকটি দেশে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। আবার এমন অনেককেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি যারা অত্যন্ত সফলতার সাথে পিএইচডি সম্পন্ন করে সুযোগের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ভুলে গেলে চলবে না, ইনারা কিন্তু সবাই বাংলাদেশি। এই দক্ষ জনগোষ্ঠী কিন্তু রেডিমেড। এদেরকে যদি যোগ্যতা অনুযায়ী সরকার সম্মান দেয়, সরকার তথা দেশ প্রধানত দুইভাবে লাভবান হতে পারে।

এক. এদের উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারের ঘট থেকে কোনও টাকা গচ্চা যাবে না, তারা নিজ যোগ্যতাবলে ইতিমধ্যে তা কৃতিত্বের সাথে শেষ করেছেন। তাছাড়া উচ্চশিক্ষাকালীন ছুটির সময়টুকুও সরকারের জন্য সাশ্রয়ী হবে।

দুই. এই রেডিমেড দক্ষ জনগোষ্ঠীকে যদি দেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে বা গবেষণা করা যায় এমন কোনও স্থানে সংকুলান করা যায়, তাহলে তারা নিজেরাই জ্যামিতিক হারে আন্তর্জাতিক মানের গবেষক তথা বিষয়ভিত্তিক দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।

সার্বিকভাবে বলতে গেলে, রতন স্যারের গল্পের ওই সাইকেল শিল্পের মতো ঋণের টাকা দিয়ে আমরা আর সাইকেল কিনতে চাই না (পড়ুন জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বৃত্তি দিয়ে কাউকে বিদেশে পাঠাতে চাই না), বরং আমরা এবার সাইকেল তৈরির কারখানা স্থাপন করতে চাই ( পড়ুন নিজ দেশেই আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে চাই), যে কারখানা থেকে বের হবে দক্ষ মানব সম্পদের অবারিত স্রোতধারা!