বঙ্গভবনের একশ বছর স্মারক গ্রন্থে কিছু অসঙ্গতি

এম এম আর জালাল এবং তানভীর ইসলাম
Published : 2 March 2019, 12:26 PM
Updated : 2 March 2019, 12:26 PM

বঙ্গভবনের প্রেস উইং থেকে প্রকাশিত "Hundred Years of Bangabhaban 1905-2005" শিরোনামের বইটি সম্প্রতি আমাদের হাতে এসেছে। বইটি প্রথম প্রকাশ হয়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ সালে। এতে নয়টি অধ্যায়ে বঙ্গভবন সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, এর নির্মাণ, স্থাপত্যশৈলী, অন্দরসজ্জা, পরিবেশ, স্বাধীনতা-পূর্ব (১৯০৫-১৯৭১) সময়কালে দিলকুশা গভর্নমেন্ট হাউজ থেকে বঙ্গভবনে রূপান্তরের ইতিহাস, স্বাধীনতা-উত্তর (১৯৭১-২০০৫) বঙ্গভবনের ভূমিকা ও কর্মকাণ্ডের বিবরণের পাশাপাশি এই একশ বছর সময়কালীন যে শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ এই ভবনের বাসিন্দা ছিলেন, সেই লেফটেন্যান্ট গভর্নর, গভর্নর ও প্রেসিডেন্টদের জীবনী সন্নিবেশিত হয়েছে।

নেতৃবৃন্দের জীবনী সম্বলিত অষ্টম অধ্যায়টি লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. ইফতেখার-উল-আওয়াল, যিনি বইটির অন্যতম সম্পাদক। এই অধ্যায়টিতে কিছু ভুল ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য আমাদের নজরে পড়েছে।

অষ্টম অধ্যায়ের ৩৩৭ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জীবনীর শুরুতে তার পরিচয় দেওয়া হয়েছে 'অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের প্রেসিডেন্ট' হিসেবে (চিত্র-২ক), যা একটি বড় তথ্যগত ভুল। 'মুজিবনগর সরকার ' লোকমুখে পরিচিতি লাভ করলেও, বাস্তবে এটি ছিল প্রথম 'বাংলাদেশ সরকার'- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এছাড়া শিরোনামেও শুধু 'শেখ মুজিবর রহমান ' লেখা হয়েছে যা দৃষ্টিকটূ। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল যে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলো, সে ঘোষণাপত্রেও তিনবার 'বঙ্গবন্ধু' উল্লেখ করা হয়েছে, যা আমাদের সংবিধানের অংশ (স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা- The Proclamation of Independence এর লিংক- http://www.docstrangelove.com/uploads/1971/sbbk/documents/Proclamation%201971_M_Dalil_Vol_03_MMR.pdf)। এবং  সংবিধান এর লিংক http://bdlaws.minlaw.gov.bd/pdf/367___Schedule.pdf  ( পৃষ্ঠা ৭৯ ও ৮০ ) । পক্ষান্তরে, জিয়াউর রহমানের জীবনীর শিরোনাম দেয়া হয়েছে -'Lt. General Ziaur Rahman' ।(চিত্র ৩ দ্রষ্টব্য)।

এরপর, ৩৩৯ পৃষ্ঠায় ইফতেখার-উল-আওয়াল লিখেছেন- "When talks in March 1971 between the AL and Pakistani authorities failed to bring fruitful results, genocide was launched on the midnight of 25 March 1971. Sheikh Mujibur Rahman was arrested and taken to Pakistan as a prisoner. A liberation war ensued that continued for nine months leading to the emergence of Bangladesh as a sovereign and independent state on 16 December 1971. Although Sheikh Mujibur Rahman was in Pakistan jail during the liberation war, he remained the main inspiration throughout. After release from prison, he arrived in Dhaka via London and India and assumed Presidency on 10 January 1972."

এখানে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করা হয় নি! অন্যদিকে, ৩৪৮ পৃষ্ঠায় জিয়াউর রহমানের এন্ট্রিতে আওয়াল লিখেছেন- "Following the crackdown on unarmed civilians on the midnight of 25 March 1971, he led the revolt against the Pakistan Army and later announced the historic declaration of independence first on his own behalf, and afterwards on behalf of the elected leader of the country Sheikh Mujibur Rahman from the Kalurghat radio station." অর্থাৎ জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজের নামে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন এবং পরে দেন দেশের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবর রহমানের নামে কালুরঘাট রেডিও স্টেশন থেকে। এখানে আবার কোনও তারিখ উল্লেখ করা হয় নি, যা বিভ্রান্তিমূলক।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক ও বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার নতুন কিছু নয়, যা শুরু হয়েছিলো ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালে 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র' পুনর্মুদ্রণ করে তৃতীয় খণ্ডের ১ম পৃষ্ঠায় স্বাধীনতা ঘোষণা সংক্রান্ত অসত্য  তথ্য সন্নিবেশিত করা হয় যা বাতিলের দাবিতে একটি রিট দায়ের করা হয়। জুন ২১, ২০০৯ সালে এই রীট মামলার রায়ে এই খণ্ডে উল্লিখিত " মেজর জিয়ার প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা " সংবিধান পরিপন্থী ও অবৈধ ঘোষণা করা হয়। শুধু তাই নয়, এই রায়ের আদেশে " বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র " গ্রন্থাবলী সিরিজের তৃতীয় খন্ডসহ এ ধরনের বক্তব্য যে সকল গ্রন্থে মুদ্রিত বা বিবৃত হয়েছে তা অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করার জন্যও সরকারকে নির্দেশ প্রদান করা হয়। রায়ের আদেশে বলা হয়-

"১) বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০০৪ সনে পুণর্মুদ্রিত ''বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র'' এর তৃতীয় খন্ডের ১ম পৃষ্ঠায় 'মেজর জিয়ার প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা' শিরোনামে মুদ্রিত বর্ণনা,  The Proclamation of Independence এর পরিপন্থী তথা সংবিধান পরিপন্থী বিধায় অবৈধ ঘোষণা করা হইল। তাহাছাড়া, উক্ত তৃতীয় খন্ডের প্রথম পৃষ্ঠায় পাদটীকায় ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে মেজর জিয়াউর রহমান ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ন অফিসার, জেসিও এবং জোয়ানদেরকে একত্রিত করিয়া 'স্বাধীনতার ঘোষণা দেন' ইত্যাদি বক্তব্যও সংবিধান পরিপন্থী বিধায় অবৈধ ঘোষণা করা হইল।

(২) মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছিলেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০০৪ সনে প্রকাশিত ''বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র'' গ্রন্থাবলী সিরিজের তৃতীয় খন্ডসহ এইরূপ বক্তব্য যে সকল পুস্তক পুস্তিকা, গ্রন্থে বা গ্রন্থ-খন্ডে মুদ্রিত বা বিবৃত হইয়াছে অবিলম্বে তাহা বাজেয়াপ্ত করিবার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি নির্দেশ প্রদান করা হইল।

(৩) বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সর্বপ্রকার ইতিহাস বিকৃতি দূর করতঃ সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করিবার পদক্ষেপ গ্রহণ করিবেন।" (পূর্ণাঙ্গ রায়ের লিংক- http://www.supremecourt.gov.bd/resources/documents/182028_W.P.%202577%20of%202009.pdf).

এছাড়া, গ্রন্থের শেষে Appendix বা পরিশিষ্টে উল্লেখ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামের রাষ্ট্রপতির কার্যকাল শুরু হয়েছে ১৭ এপ্রিল ১৯৭২ থেকে, যা আরেকটি বড় তথ্যগত ভুল।

বঙ্গভবনের প্রেস উইং থেকে প্রকাশিত "Hundred Years of Bangabhaban 1905-2005" গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এতে যেসব ভুল ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য আছে, সেগুলো সংশোধন করা আমাদের ইতিহাসের জন্যই জরুরী।