"কাশ্মীরের আকাশে জঙ্গি বিমানের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে… দুই দেশই পরষ্পরের জঙ্গি বিমান ভূপাতিত করার পাল্টাপাল্টি দাবি করেছে… পাকিস্তান দাবি করেছে, বুধবার সকালে কাশ্মীরে তাদের নিয়ন্ত্রিত অংশে ভারতীয় দুটো মিগ-২১ জঙ্গি বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে তারা। আটক করা হয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক বৈমানিককে। অন্যদিকে ভারতের দাবি, তাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করা একটি পাকিস্তানি এফ-১৬ জেট ফাইটারকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে ভারতীয় বিমানবাহিনী… ওই আকাশযুদ্ধে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি মিগ-২১ এবং পাইলট নিখোঁজ হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান তাদের পুরো আকাশসীমায় বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতও তাদের উত্তরাংশের নয়টি বিমানবন্দর বন্ধ রেখেছে" ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
পরমাণু শক্তিধর দুদেশের মধ্যে টানটান উত্তেজনা বিরাজমান। দ্রুত ঘটছে ঘটনা, সারা বিশ্বের দৃষ্টি এর ওপরে নিবদ্ধ, এ নিবন্ধ ছাপা হবার আগে নিশ্চয় ঝিলাম, বিয়াস, চেনাব, রাভী ও শতলেজ দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে যাবে। এই সামরিক রাজনৈতিক ডামাডোলের পেছনে পাকিস্তানে অলক্ষ্যে শক্তিশালীভাবে দাঁড়িয়ে আছে একটি হাদিস যা প্রথম থেকেই পাকিস্তানিদের মন-মগজ সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করে রেখেছে। সেটার নাম "গাজোয়া-এ হিন্দ" অর্থাৎ হিন্দুস্তান বিজয়ের জিহাদ যাতে স্বয়ং নবীজী (স) নেতৃত্ব দেবেন (তার সশরীরে উপস্থিত থেকে যে জিহাদ তাকে গাজোয়া বলে)। পাকিস্তানিরা এমনিতেই প্রচণ্ড ভারত-বিরোধী। তার ওপরে মাওলানারা যখন ওয়াজ মাহফিলে মহা উত্তেজিতভাবে এই হাদিস জাতিকে শোনান তখন ঘৃণার সে আগুনে ঝড়ো হাওয়া বয়ে জাতি আরো বেশি ভারত-বিদ্বেষে ফেটে পড়ে।
"গাজোয়া-এ হিন্দ" হাদিসটা সহি বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ-তে পাওয়া যায়না। বিভিন্ন নিবন্ধে ওটার উল্লেখ আছে নাসাঈ (আমার নাসাঈ-তে ওটা আমি পাইনি) ও অন্যান্য বইতে ৫টি হাদিসে, একটার অনুবাদ দিচ্ছি। রসূল (স) নাকি বলেছেন –
"অবশ্যই তোমাদের একটি সৈন্যবাহিনী হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবে, আল্লাহ তাহাদিগকে বিজয় দান করিবেন এবং তাহারা উহাদের রাজাদিগকে শিকলে বাঁধিয়া টানাহ্যাঁচড়া করিয়া আনিবে…এবং সেই মুসলিমেরা ফিরিয়া আসিয়া শাম দেশে (সিরিয়া) হযরত ঈসা ইবনে মরিয়মকে দেখিতে পাইবে"।
এর ভিত্তিতেই পাকিস্তানি মওলানারা দৃঢ়ভাবে ভারত- বিজয়কে অভ্রান্ত ও অবশ্যম্ভাবী সত্য হিসেবে বিশ্বাস করেন ও জাতিকে বিশ্বাস করান, ওদের সেনাবাহিনীও দৃঢ়ভাবে এ হাদিস বিশ্বাস করে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ওয়েবসাইটে দেখলাম ইংরেজী অনুবাদের সাথে হাদিসগুলোর আরবী স্ক্যান দেয়া আছে। সেই সাথে কোরান হাদিসের সুগভীর গবেষণা ('কা'না যাহুকা' শব্দ, সূরা বনি ইসরাইল আয়াত ৮১, ইমাম মেহেদী, হযরত ঈসা আ: ইত্যাদি) ও পশ্চিমা বই "সিনারিওজ অব দ্য ফিউচার টেকনোলজি অ্যাণ্ড ইন্টারন্যাশন্যাল ডেভেলপমেন্ট" (রকফেলার ফাউণ্ডেশন)-এর উল্লেখ করে বলা আছে যে এই বিজয় হবে ২০২৭ – ২০২৮ সালে।
আরো একধাপ এগিয়ে সেখানকার এক মেগা মওলানা ইরফানুল হক বলেছেন, "আল্লাহ পাকিস্তানি মুসলিমকে ভারত ও কাফিরকে ধ্বংস করার সম্মান দিয়াছেন… পাকিস্তানিদের উচিত নিজেদেরকে সম্মানিত বোধ করা কারণ আল্লাহ তাহাদিগকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সম্মান দিয়াছেন……. ভবিষ্যদ্বাণী আছে যে মুসলিমের হাতে ভারত ও হিন্দুত্বের পরাজয়ের জন্যই পাকিস্তানের জন্ম হইয়াছে "।
তার এই ভয়াবহ উস্কানিমূলক হিংস্র বক্তৃতাটা সম্প্রতি ইউটিউব থেকে মুছে দেয়া হয়েছে।
পাকিস্তানে এই হুংকারের বিপরীতে ঠিক পাশের দেশ ভারতের মওলানাদের অবস্থান বড়ই লবেজান। তারা জাতির সামনে এ হাদিস কখনো উল্লেখ করেন না। কারণ ভারতে পাকিস্তানের মতো কথাবার্তা বললে হিন্দুরা, বিশেষ করে উগ্র হিন্দুরা তাদেরকে পিটিয়ে তক্তা করে দেবে। ভারতীয় টিভিতে অনেকবার দেখেছি কেউ এ হাদিস নিয়ে প্রশ্ন করলে তারা স্রেফ কথা পেঁচিয়ে পিছলিয়ে যান কিংবা "হিন্দু-মুসলিমের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে" বলে গালাগালি শুরু করেন। দিল্লী জামে মসজিদের ইমাম সৈয়দ বুখারী কিংবা কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম নুরুর রহমান বরকতী এর মতো নামকরা মওলানাদের সাধারণ বক্তব্য হলো, কোনও রকম হিংস্রতা বা হিন্দুদেরকে কাফের বলাটা কোরান-সমর্থিত নয়। যখন এই হাদিসটা তাদের দেখানো হয় তখন তারা বলেন- এটা ইসলামী নয়, 'ব্যাস'। কিন্তু ভারতের কোনো মওলানাকে পাকিস্তানের মওলানাদের নাম ধরে কিংবা কোনও বিশেষ বক্তৃতা উল্লেখ করে দাবী করতে শুনিনি এটা একটা জাল হাদিস।
এই উপমহাদেশে প্রথম থেকেই অন্য সব দেশের ঘাড়ে ভারত 'বড় ভাই' হয়ে বসে আছে। এবং সেটা মোটেই স্নেহময় কোনও বড়ভাই নয়, সেটা একটা মারাত্মক স্বার্থপর এবং হিংস্র বড়ভাই। আপাতত আমাদের সেটা রাজনীতি দিয়ে সামলানো ছাড়া উপায় নেই। ওদিকে ভারতের পরাক্রান্ত সামরিক শক্তির সামনে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কিছুই নয়। দেশটা প্রায় সর্বদাই হয় আর্মির বুটের নিচে বা আর্মি সমর্থিত ছায়া সরকার দ্বারা শাসিত। তাছাড়া মুখে যত ফুটানি-ই করুক চারবার ভারতের কাছে আর একাত্তরে আমাদের কাছে পরাজয়ের কলঙ্কতিলক তাদের সেনাবাহিনীর ললাটে রক্তাক্ত হয়ে ফুটে আছে, ফলে তাদের মনোবলও ভাঙা। গরীব পাকিস্তানের বাক্যনবাব সেনাবাহিনী এ ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি:
জনতা ঘোরায় পরিশ্রমে অর্থনীতির চাকা,
ওদের শুধু লেফট-রাইট আর মুখের বুলি ফাঁকা।
প্রতিরক্ষা শিকেয় তুলে গদির লোভে ক্রমে,
নিজেরই দেশ জয় করে সে বিপুল বিক্রমে !
আহার-বিহার, পোশাক-বাড়ী খাচ্ছে মুফৎ সব,
গরীব জাতির রক্তমাংসে ওদের মহোৎসব।
খায় যত তার কোনো কিছুই দেয়না ফেরৎ তো,
নিরস্ত্র জনতার ওপর ওদের বীরত্ব !!
পাক-ভারতের বিস্ফোরক সামরিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে হুংকারী মওলানারা আবারো "গাজোয়া-এ হিন্দ" নিয়ে দাপাদাপি করছে, জনগণকে উস্কিয়ে ভারত-বিজয়ের অবাস্তব স্বপ্নে ভোলাচ্ছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাদের গায়ে এখন হাত দেবেন বলে মনে হয়না। কারণ মাত্র কিছুদিন আগে তিনি আসিয়া বিবি মামলায় "তেহরিক-এ লাব্বায়েক" দলের বিকট হিংস্র মওলানাদের জেলে ঢুকিয়েছেন, এখন তিনি আর কোনও মওলানাকে ঘাঁটাবেন বলে মনে হয়না। এই থিন রেড লাইন থেকে আমাদের রাজনীতিকদের কি শেখার আছে?
প্রবাদ থেকে শেখার আছে কারণ সব দেশের প্রবাদগুলো আমাদের পূর্বপুরুষদের অনেক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ফসল। সেটা হলো, ধর্মগুরুদেরকে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করাটা "বাঘের পিঠে সওয়ার" হবার মতো। সওয়ার হওয়াটা হয়ত সোজা ও স্বার্থসিদ্ধি করতে পারে, কিন্তু ওই বাঘের পিঠ থেকে নামা যায়না, নামলেই সেই বাঘ তোমাকেই খেয়ে ফেলবে।
ইতিহাস আমাদের কানে কানে ফিসফিস করে কিছু একটা সতর্ক সংকেত শেখাচ্ছে, আমাদের রাজনীতিকেরা কি কিছুই শিখবেন না?