প্রিয়াঙ্কা  কি ইন্দিরা হতে পারবেন?

Published : 26 Feb 2019, 11:24 AM
Updated : 26 Feb 2019, 11:24 AM

চমকের রাজনীতিতে নতুন ধামাকা প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রার আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে যোগদান। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের মাস তিনেক আগে কংগ্রেসের প্রধান প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ণ এলাকা উত্তর প্রদেশের রাজ্য কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। প্রিয়াঙ্কার দাদা মতিলাল নেহরুর কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ঠিক শতবর্ষ পরে তিনি নেহেরু পরিবারের সর্বশেষ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ১১তম সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে যোগ দিলেন।

কিন্তু , আশ্চর্যজনকভাবে, সাম্প্রতিককালে  কংগ্রেস প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে প্রিয়াঙ্কার নিয়োগের বিষয়টি এমনভাবে ঘোষণা করা হয় যেন বিষয়টি কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধীর নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে দলীয় পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের রদবদল ভিন্ন আর কিছুই নয়।  প্রশ্ন হলো – কেন এই গোপনীয়তা ? কংগ্রেস কি প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর যোগদানকে রুটিন কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেখছে? নিশ্চয় তা নয়।  তাহলে কি কংগ্রেস প্রিয়াঙ্কর নাম প্রথম কলামে উল্লেখ করতে চাইনি এটা ভেবে যে , এটা পরিবারবাদ প্রচারণার সুযোগ হয়ে সমালোচনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে ?

তাহলে, আবার প্রশ্ন আসে যে , কেন কংগ্রেস আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিল? ভারতীয় রাজনীতিতে রাজবংশ আর নোংরা বা কুৎসিত শব্দ নয়।  কংগ্রেস ছাড়াও অন্য অনেক দলে পরিবারতন্ত্র জারী রয়েছে। এমনকি, ভারতীয়  জনতা পার্টি ( বিজেপি)-ও এর বাইরে নয়।  সর্বোপরি, কংগ্রেস বেশ কটি নির্বাচনে জিতেছে।  যদিও , সমালোচকরা রাজবংশীয় শাসন এবং রাহুল ও প্রিয়াঙ্কার  মা সোনিয়া গান্ধীর বিদেশি বংশপরিচয় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেসের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন।  তাই, এসব ইস্যু নিয়ে কথা বলাটা মৃত ঘোড়াকে চাবুক মারার মতো।

প্রিয়াঙ্কার নাম তৃতীয় অনুচ্ছেদে উল্লেখ করার যে কারণই থাকুক না কেন, একটা বিষয় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার কংগ্রেস-এ যোগদান দলীয় কাজে তার অবস্থানকে সুদৃঢ় করবে এবং  সামনের সারির একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে দুই দশক ধরে দলীয় রণকৌশল ও নীতিনির্ধারণী মহল থেকে মুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করবে।  এটি কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের ভবিষ্যতের জন্য ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।  তাছাড়া এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে প্রতিষ্ঠাকালীন পরিবার ছাড়া কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পোক্ত হতে পারে না এবং বহুদিন ধরে জপে আসা শ্লোগান 'প্রিয়াঙ্কা লও, কংগ্রেস বাঁচাও' বাস্তবায়িত করতে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী তুরুপের তাস হিসেবে কাজ করবে।

সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রিয়াঙ্কা উত্তর প্রদেশের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পূর্বাঞ্চলের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন যেটি প্রাথমিকভাবে তিনটি রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে।

প্রথমত : আশিটি (৮০) সংসদীয় এলাকার প্রায় অর্ধেক আসন এই এলাকার অন্তভুক্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং গেরুয়াবসনধারী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের মতো বিজেপির হিন্দুত্ববাদী দুইজন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিসহ প্রায় এক ডজন দলীয় সহকর্মীর প্রতিনিধি আসন বরাদ্দ রয়েছে।

দ্বিতীয়ত : এখানে উপস্থিত উচ্চশ্রেণীর জনগোষ্ঠী এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই বিজেপি, সমাজবাদী দল ও বহুজন সমাজবাদী দলের পক্ষে যে সমর্থন তা কংগ্রেস ছিনিয়ে আনতে চায়।

তৃতীয়ত : এটা প্রিয়াঙ্কাকে তার ভাই রাহুল গান্ধী ও মা সোনিয়া গান্ধীর নির্বাচনী এলাকা যথাক্রমে আমেথি ও রায়বেরেলি 'র ক্ষমতা ধরে রাখতে সাহায্য করবে যা তিনি ১৯৯৯ সাল থেকে করে আসছেন।

প্রথমবারের মতো, তিনি সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করবেন, যা পূর্বেকার আমেথিও রায়বেরেলির নির্বাচনী প্রচারণা অপেক্ষা কঠিন হবে। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার দল গঠনে ভূমিকা রাখার ক্ষমতা রয়েছে এবং এমন একটি প্রদেশ যেখানে সংসদীয় ও বিধানসভা নির্বাচনে সাফল্যের হার নির্ভর করে ধর্ম এবং বর্ণের উপর।

নিরুৎসাহজনক কর্মকাণ্ডর অন্তর্ভূক্ত কাজ যেমন এই প্রদেশে রাজনৈতিক সমীকরণ পরিবর্তন করা ও পাঁচবছর আগের নির্বাচনে মাত্র চুয়াল্লিশটি আসন পেয়ে কংগ্রসের শোচনীয় পরাজয় কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তিনি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন এবং তাদের সমর্থনকে ভোটে পরিণত করতে পারেন। প্রিয়াঙ্কার সাথে ইন্দিরা গান্ধীর সাদৃশ্যতাকে জনগণের কাছে মোহনীয় করে তুলে নেহেরু গান্ধী পরিবারের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারেন । তার পদক্ষেপকে আরও জটিল করে তোলে প্রদেশে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকে সংখ্যালঘু দলে পরিণত হওয়া। সমাজবাদীদল, বহুজন  সমাজবাদী  দল এবং বিজেপির ধর্ম ও বর্ণভিত্তিক রাজনৈতিক আদর্শ যা ১৯৮০ সাল থেকে প্রচারিত হয়ে আসছে তার আড়ালে কংগ্রেসের দলীয় আদর্শ ঢাকা পরে।কংগ্রেস এর সাংগঠনিক কাঠামো ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে ।

যদিও, রাহুল গান্ধী তার সহোদরকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চলে নিয়োগ দিয়ে তার উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন যে এসপি ও বিএসপি কর্তৃক সংগঠিত সাম্প্রতিক নির্বাচনী জোট থেকে সরে যাওয়ার পরও তিনি প্রদেশের ক্ষমতা সহজে হাতছাড়া করতে চান না। প্রকৃতপক্ষে, রাহুল গান্ধী প্রিয়াঙ্কাকে রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করে বিএসপি প্রধান মায়াবতীর উদ্দেশ্যে একটি শক্তিশালী বার্তা প্রেরণ করেন। কেননা তিনি দলীয় সহোযোগীদের সাথে ভোট চুক্তি ও আসন বণ্টন বিষয়ে কংগ্রেসের ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। প্রিয়াঙ্কাকে রাজ্যের পূর্বাংশের সাধারণ সম্পাদক এবং অপর একজন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ তুর্কি  জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে পশ্চিমাংশে নিয়োগ দিয়ে তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করার আগ্রহের বিষয়টি কংগ্রেস সন্দেহাতীতভাবে প্রকাশ করেছে।

প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর স্বীকৃত অর্জনসমূহ তার পদমর্যাদা অনুযায়ী যথেষ্ট কিনা সে সম্পর্কে রাজনীতি মহলে বিতর্ক চলতে থাকবে। সত্যিই, তিনি ১৯৯৯ সালের রায় বেরেলি নির্বাচনী এলাকায় দলের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য নির্বাচনী প্রচারণা সফলভাবে সম্পন্ন করেছিলেন যে এলাকায় সোনিয়া গান্ধী র আত্মীয় অরুণ নেহেরু ১৯৯৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন। অপরপক্ষে ২০১৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস ও এসপি এর মধ্যে জোট গঠন করে উত্তর প্রদেশে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে প্রিয়াঙ্কা ব্যর্থ হয়েছেন।

এদিকে দায়িত্ব  পাওয়ার আনুষ্ঠানিকভাবে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রীতিমতো ঝড় তুলে উত্তর প্রদেশ অভিযান শুরু করলেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। এর মধ্য দিয়ে শুরু হলো তার নির্বাচনী প্রচার।   বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই রোড শোয়ের পর কংগ্রেস সম্পর্কে জোটবদ্ধ দুই শিবির সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টির মনোভাবের পরিবর্তন ঘটতে পারে। কংগ্রেসকে জোটে নেওয়ার ভাবনা প্রাধান্য পেতে পারে।

কংগ্রেস প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে ইন্দিরা গান্ধীর যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করে। এই ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে নেহেরু-গান্ধী পরিবার দলীয় কোন্দল ও নীতিবিভক্তির সমস্যায় জর্জরিত কংগ্রেস কে ঐক্যবদ্ধ করে দলীয় কাঠামো সুদৃঢ় করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা নেহেরু-গান্ধী  পরিবার দলের ধারাবাহিক সাফল্যের হার নিশ্চিত করতে পেরেছে কিনা? তাছাড়া কংগ্রেসকে এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে যে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে ভারতীয় রাজনীতি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়েছে।

বর্তমানে বৃহৎ জনতাত্ত্বিক পরিবর্তন তরুণ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভোটারদের কংগ্রেস মুখী করেছে যার প্রভাবে নেহেরু-গান্ধী পরিবারের উপর নির্ভরতা যথেষ্ট পরিমাণে কমে এসেছে। সেক্ষেত্রে প্রিয়াঙ্কার সাফল্যের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হবে উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সমর্থক শিবিরের ভোট অর্জনের ক্ষেত্রে সফল হয় কিনা। সম্প্রতি ভারতে কয়েকটি রাজ্য নির্বাচনে কংগ্রেস ভাল ফলও করেছে। এতে দলের অবস্থান এখন কিছুটা শক্ত। কিন্তু তারপরও বিজেপিকে ধরাশায়ী করে ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা এখনো দলটির জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। সবশেষে কী হয় এটিই দেখার বিষয়।