ভাষা সাম্প্রদায়িকতা ও আমাদের অসুস্থ সমাজ

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 25 Feb 2019, 10:17 AM
Updated : 25 Feb 2019, 10:17 AM

সম্প্রতি নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। সাম্প্রদায়িকতা সমাজের কোন স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে তা বোঝার জন্য এই ঘটনাই যথেষ্ট। লেখাপড়ার মতো মৌলিক জায়গায় আঘাত হানছে এই নোংরা বিষয়। যশোর বোর্ডের এসএসসি এর প্রশ্নপত্র নিয়ে তার একটি উদাহরণ টেনেছেন রামেন্দ্র মজুমদার।

কেমন ছিল সে প্রশ্ন? 

"টিনা নামের একটি মেয়ে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ে বলে কথায় কথায় ইংরেজি বলে। বাংলা বলতে জানা বন্ধুদের সে অবজ্ঞা করে। এসব দেখে তার বন্ধুরা বলে, টিনার মতো বন্ধু তাদের দরকার নাই। এবার ছেলে মেয়েদের কাছে প্রশ্নকর্তার উর্বর মস্তিস্কের প্রশ্ন,

কারা হিন্দুদের অক্ষর-কে ঘৃণা করে?"

উত্তর কোমলপ্রাণ বাচ্চারা না জানলেও আমরা জানি। জনাব প্রশ্নকর্তা আপনার মতো দিল এ পাকি, মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা বিরোধীরা-ই তাই করেন। অপকৌশলে শিশুদের মনে ঢুকিয়ে দেন, বাংলা অক্ষর হিন্দুদের। সেই একই কাহিনী, সেই জিন্নাহ-নাজিম উদ্দীন-মোনায়েম খানের পুরোনো বুলি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এটি কি উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়? একটি দেশের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কীভাবে হয়? কারা করেন? সে বিষয় কি সবার অজানা? এর নিশ্চয়ই একটা পদ্ধতি আছে। আর সে প্রক্রিয়া লুকাছাপা কিছু না। তাহলে কিভাবে এটা সম্ভব হলো? যখন আমরা ভাষার মাস একুশের গর্বে নিজেদের বুক স্ফীত করছি তখন এ ধরনের একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশ্নের মানে কী? কারা  আসলে এর পেছনে? 

এটা কি আসলে বিচ্ছিন্ন কিছু? আসুন আমরা সমাজের দিকে চোখ মেলে তাকাই। এ সমাজ কি আসলে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা বাঙালি আদর্শের কথা বলে? মুশকিল কি একটা? এখন এমন এক সময় যখন আপনি স্পর্শকাতরতার নামে কোনও যৌক্তিক বিষয়ও তুলে ধরতে পারবেন না। আপনি পোশাক নিয়ে বললে, বলা হবে অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হচ্ছে। আপনি খাবার নিয়ে বললে, শুনবেন আপনি নাস্তিক। আপনি ব্যবহার নিয়ে বললে বা শব্দ নিয়ে বললে বলা হবে , আপনি অনাধুনিক। সবার ওপরে আপনার জীবন। কাজেই হয়তো আপনাকে মুখ সামলে রাখতেই হবে। গণতন্ত্র আর মুক্ত মিডিয়া বা মুক্তমনের নামে দিনে দিনে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে আমাদের সমাজ। কেউ ভয়ে কিছু বলেনা। যেমন ধরুন যে সম্প্রদায়কে আঘাত করা হলো সেই হিন্দু সম্প্রদায়ের সাধ্য আছে প্রতিবাদ করে? 

আমি যেহেতু সেই সম্প্রদায়ের জন্মগত মানুষ আমি জানি তাদের দূর্বলতা বা ভয় কোথায়? আমরা ধরে নিয়েছিলেম একাত্তরের পর সে আশঙ্কা দূর হবে। হয়নি বরং দিনে দিনে বেড়েছে। জিয়াউর রহমান বা এরশাদের কাঁধে সকল দায় চাপিয়ে মানসিক শান্তি পেতে পারেন, কিন্তু সমাধান পাবেন না। আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের সিংহভাগ মুখে প্রগতিশীল। তাদের কাজ আর কথায় ব্যাপক অমিল। এটা তাদের দোষ না।

রাজনীতি আস্তে আস্তে সবকিছু খেয়ে ফেলেছে। আপনাদের আমি চট্টগ্রামের একটা উদাহরণ দেই। দেখবেন সেখানে যারা প্রবীণ রাজনীতিবিদ তারা সবাই এক পর্যায়ে লেবাস ধারণ করেছেন। তাদের পোশাক আচরণে তারা ক্রমেই ধার্মিক হবার চেষ্টা করেছেন। অথচ বিএনপির নেতারা তা করেননি। যা আপনি আবদুল্লাহ আল নোমান আমীর খসরু চৌধুরী বা মীর নাসিরের গেট আপ দেখলেই বুঝবেন। আমাদের দেশে এ আরেক বিপদ। যারা প্রগতিশীলতার নাম ভাঙিয়ে রাজনীতি করেন তাদের লেবাসের দরকার হয়। না হলে ভোট মেলেনা। এই যেখানে সমাজের চেহারা সেখানে আপনি কিভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ আশা করবেন?

ভাষার কথায় আসি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল একুশের গর্ভে। সে গর্ব এখন আছে? দিনে দিনে কি চেহারা হয়েছে ভাষার? ঢাকা কেন্দ্রিক ভাষার নামে প্রমিত বাংলার বারোটা বাজানোর প্রক্রিয়ায় কারা জড়িত? অবাক ব্যাপার যে প্রজন্ম বাংলা ভাষা আর সাহিত্য নিয়ে নতুন করে কিছু করার কথা তাদের ভেতর ঢুকে গেছে ভারত বিরোধিতার নামে কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলার বিরোধিতা। তরুণ লেখকদের কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের জন্ম মৃত্যুদিনে যে ধরনের লেখা লেখেন তাতে এখন আর বিস্মিত হই না। বরং বুঝতে পারি তথাকথিত জাতীয়তাবাদ এখন আমাদের পরিচয় গিলে খেতে উদ্যত। যার হাতে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল কেউই নিরাপদ না। আমাদের এখন বড় দূর্ভাবনা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মূল জায়গাটা নিয়ে । সম্প্রীতি বা সমঝোতা কোনও আরোপিত বিষয় না। এটা চর্চার বিষয়। সামাজিক মিডিয়ায় আমার পরিচিত এক নারী একটি জরুরী বিষয়ের কথা তুলে ধরেছেন। ইনি বৈবাহিক সূত্রে মুসলিম। জন্ম তার হিন্দু ঘরে। তিনি বলছেন, তাদের বাড়িওয়ালা ছেলে-মেয়েদের নিষেধ করে দিয়েছে হিন্দু টিচারকে আদাব/সালাম/নমস্কার বলতে। তার মতে, কোনটাই প্রাপ্য না হিন্দুর। এটাও অবাক করেনি আমাকে।

ঢাকায় ফোন করলে যারা ফোন ধরেন তারা কমবেশি সংস্কৃতিবান মানুষ। তারা ধরতে ধরতে বলেন, আসসালাম আলাইকুম। শুনে আমার মনেও শান্তি আসে বৈকি। কিন্তু যেই বুঝতে পারে এটা আমার ফোন, তখন বলতে থাকে স্যরি দাদা বুঝতে পারিনি। আদাব। আমি বিস্ময়ের সাথে বলি, কেন ভাই? সালামটা তুলে নিলেন কেন? আমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক সেটা চান না আপনি? কেউ হেসে এড়িয়ে যায় কেউ চুপ থাকে। আমি বুঝতে পারি মন মানসিকতা বদলে গেছে। বলে লাভ নাই।

বাংলাদেশে এমন পরিবেশ আগে ছিল না। আমাদের শৈশব-কৈশোর-যৌবনে এমন কথা শুনিনি। কেউ তাদের সন্তানদের বলেননি হিন্দুদের সাথে মেশা অপরাধ। পাপ বলে ভয় ধরিয়ে দিত না কেউ। দেশের একজন পরিত্যক্ত রাজনীতিবিদ যিনি বাকপটু, স্বাধীনতা আন্দোলনে যার ভূমিকা অপরিসীম তিনি ভিডিওতেই বলেছেন- প্রসাদ খাওয়া না জায়েজ। খেলে পাপ হবে। ক'দিন পর এটাও বলবেন হিন্দুদের বাড়িতে জলগ্রহণও পাপ।

 

যদি এমনই হয় তবেতো ভাষা হিন্দুদের বলে সনাক্ত করা হবেই। যা পাকিস্তান আমলে হয়েছে, তাই আবার ফিরে আসছে এবং এবার তা ঠেকানোর কেউ থাকবেনা আমাদের। আস্তে আস্তে পাঠক্রম থেকে এমন সব লেখকদের ক্লাসিক লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে যাদের একমাত্র অপরাধ তারা অমুসলিম। এই ঘৃণা-এই পাপ কী বলছে? আমি মনে করি পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল সাম্প্রদায়িক আর মানুষ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। মানুষ তখন বাঙালি ছিল। বাঙালি হবার সাধনাই ছিল আমাদের পথ। এখন উল্টো। রাষ্ট্র নানা কারণে অসাম্প্রদায়িক বা তার ভান করলেও, সমাজ এখন সাম্প্রদায়িক। কিছু মানুষ অবিরল সংগ্রাম করছেন এই অপপ্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসতে। কিন্তু তাদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে। 

পাঠক্রম প্রশ্নপত্র, এগুলো অ্যাসিড টেস্ট। একদিন এগুলোই বলবে, অনেক হয়েছে আর না। এবার আমাদের চাই নয়া ভাষা। নয়া বুলি। না হিন্দি হবে না। উর্দুও না। হবে বিকৃত বাংলা। যা হিন্দু-বৌদ্ধ -খ্রিস্টানদের এড়িয়ে কেবল একটি জাতিগোষ্ঠীর মনের মতো বলে চাপিয়ে দেয়া হবে । আর বাংলাভাষা বাংলাদেশ অসহায়ের মতো দেখতে থাকবে। হায়রে চেতনা, হায় মুক্তিযুদ্ধ, হায় ডিজিটাল অসাম্প্রদায়িকতা- আসো শ্যামলকান্তির মতো কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো। এটাই তোমার প্রাপ্য।