উগ্রপন্থীদের আস্ফালন

মারুফ রসূল
Published : 24 Feb 2019, 01:46 PM
Updated : 24 Feb 2019, 01:46 PM

'পঞ্চগড়ে আহমদীয়া জলসা বন্ধ, বাড়িঘরে হামলা-ভাংচুর' শিরোনামে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদ ভাষ্য অনুযায়ী, আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বার্ষিক জলসা বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে পঞ্চগড় জেলার কোতওয়ালী থানার ধাক্কামারা ইউনিয়নের আহমদনগর গ্রামে ব্যাপক হামলা-ভাংচুর চালায় খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ পরিষদসহ বেশ কয়েকটি উগ্রপন্থী ধর্মভিত্তিক সংগঠন।

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আহমদীয়া মুসলিম জামাতের ওপর উগ্রপন্থীদের এই নারকীয় হামলার ঘটনা অতীতেও বহুবার ঘটেছে। একেক সময় একেক ব্যানারে এই সাম্প্রদায়িক অপগোষ্ঠীগুলো হামলা চালালেও এর পেছনের কুশীলবরা একই। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হামলার পরও বিভিন্ন গণমাধ্যমের সূত্রে আবার এই কুশীলবদের আস্ফালন শুনতে পাচ্ছি আমরা। ধর্মান্ধতাকে আশ্রয় করে গায়ের জোরে এরা আহমদীয়া মুসলিমদের 'অমুসলিম' ঘোষণার অযৌক্তিক দাবি করেই যাচ্ছে। ব্যাপারটা এমন যে, কারা 'মুসলিম' আর কারা 'অমুসলিম' তার সার্টিফিকেট প্রদানের দায়িত্ব বর্তেছে এইসব উগ্রপন্থী ধর্মীয় সংগঠনের নেতাদের ওপর।

যে বার্ষিক জলসাকে কেন্দ্র করে পঞ্চগড়ের আহমদনগরে এই বিভৎস নির্যাতন চালানো হলো, ইতিহাস পড়লে জানা যায়— ১৮৯১ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে এই জলসা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। অর্থাৎ আহমদীয়া মুসলিম জামাত প্রতিষ্ঠার দু' বছর পর থেকেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আহমদীয়া মতবাদের অনুসারীরা এই জলসার আয়োজন করে থাকেন। বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-মতের মানুষের মিলনমেলা হয় এই জলসা। বাংলাদেশের আহমদীয় মুসলিম জামাতের অনুসারীরাও তাদের নিজস্ব জায়গায় এই জলসাটি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এ বছর। যেহেতু বাংলাদেশের সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের নিজস্ব ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে সুতরাং প্রশাসনের অনুমতি না দেবারও কোনো কারণ নেই। কিন্তু প্রশাসনের যথাযথ অনুমতি সত্ত্বেও উগ্রবাদী কিছু ধর্মীয় সংগঠন এই জলসা বন্ধের দাবি তোলে। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়— প্রশাসন বারবার তাদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের দিকে যেতে চাইলেও এইসব ধর্মান্ধ অপগোষ্ঠীগুলো আহমদীয়া অনুসারীদের সাংবিধানিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। তারা বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়, নিপীড়ণ-নির্যাতন চালায় আহমদনগরের মানুষের ওপর। প্রশ্ন জাগে— রাষ্ট্র এবং প্রশাসন কি এইসব ধর্মান্ধ উগ্রগোষ্ঠীর কাছে অসহায়? ধর্মান্ধদের চালানো হামলা-নির্যাতন পর হেফাজতের আমীর শাহ আহমদ শফী সংবাদ সম্মেলন করে আহমদীয়া মুসলিমদের 'অমুসলিম' ঘোষণার মওদুদী ফতোয়া জারি করে।

আহমদীয়া মুসলিম জামাতের ওপর এ যাবৎ যতোগুলো হামলা হয়েছে, তার প্রত্যেকটির পেছনে রয়েছে ইসলামের মওদুদী অপব্যাখ্যার ধারক-বাহকরা। সাতচল্লিশের দেশভাগের পরই যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী আহমদীয়া মতবাদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে 'জিহাদ' ঘোষণা করে। তার নেতৃত্বেই লাহোরে আহমদীয়া জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা করা হয়েছিলো, হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলো কয়েক হাজার আহমদীয়া মুসলিম। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা হিসেবে মওদুদীর বিচারও হয়েছিলো এবং বিচারে তার ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। কিন্তু সৌদী আরবের হস্তক্ষেপে এই আদেশ রদ করা হয়েছিল। মওদুদী কর্তৃক সৃষ্ট এই দাঙ্গায় তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছিলো এবং কয়েক হাজার আহমদীয়া মুসলিমের রক্তের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিলো।

মওদুদী ইসলামের যে রাজনৈতিক ব্যবহার প্রচলন করেছিলো, সে অপ-আদর্শের ঝণ্ডাধারী হিসেবেই জামায়াতে ইসলাম ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে ব্যাপক গণহত্যা ও নারী নির্যাতনে অংশগ্রহণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। কিন্তু পঁচাত্তরের পর থেকে যেহেতু পুনরায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি শুরু হয় এবং জামাত-শিবির যুদ্ধাপরাধ করা সত্ত্বেও স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে; সেহেতু মওদুদী ব্যাখ্যার চাষাবাদ জারি থাকে। বাংলাদেশের গত সাতচল্লিশ বছরের ইতিহাসে রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতার দরুণ এই মওদুদী ইসলামের প্রচার-প্রসার বেড়েছে এবং ইসলামকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামের নেপথ্য নেতৃত্বেই সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক উগ্রপন্থী ধর্মভিত্তিক সংগঠন। এ কারণেই 'কাদিয়ানীরা অমুসলিম'— ১৯৫৩ সালে মওদুদীর দেয়া এই ভ্রান্ত আর মূর্খতায় পরিপূর্ণ বক্তব্যের সঙ্গে ২০০৪ সালে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে দেয়া ফজলুল হক আমিনীর বক্তব্য মিলে যায়, মিলে যায় ২০১৯ সালের সংবাদ সম্মেলনে দেয়া হেফাজতের আমিরের বক্তব্য। এই প্রসঙ্গে পাঠককে মনে করিয়ে দেয়া দায়িত্ব যে, ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম যে মধ্যযুগীয় ১৩ দফা দাবি দিয়েছিল, তার একটি ছিল সরকারিভাবে কাদিয়ানীদের (আহমদীয়া) অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা বন্ধ করা।

সুতরাং যতোগুলো ব্যানার আজ পর্যন্ত আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, এদের গোড়া এক— পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের ধারক হিসেবে এরা ধর্মকে রাজনৈতিক ময়দানে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। পঞ্চগড়ে যে ব্যানারগুলো আহমদীয়া মুসলিম জামাতের জলসা বন্ধের দাবিতে হামলা-নির্যাতন চালিয়েছে এই নামগুলো আলাদা করে টুকে রেখে গত সাতচল্লিশ বছরের বাংলাদেশের ইতিহাস পড়লে দেখা যাবে— অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও বিজ্ঞানমনষ্ক বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে এরা সব সময় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। অতএব এই অনুসিদ্ধান্তে একমত হওয়া যায় যে— আজ অব্দি আহমদীয়া অনুসারীদের ওপর সংঘটিত প্রতিটি আক্রমণের কারণ রাজনৈতিক, কেবল খোলসটা ধর্মের। ধর্মের এই খোলস দিয়েই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র করেছিলো এইসব উগ্রপন্থী ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো। ধর্মের দোহাই দিয়ে এরা নারী নীতির বিরোধিতা করে আসছে। অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এরা ধর্মকেই ব্যবহার করছে বারবার। ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে এরা তথাকথিত 'জিহাদ' ঘোষণা করছে ধর্মেরই মোড়কে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে এইসব সাম্প্রদায়িক অপগোষ্ঠীগুলোই বারবার কাঁটা বিছিয়ে দিচ্ছে।

উগ্রবাদী সংগঠনগুলো আহমদীয়া মতবাদ সম্বন্ধে নানা ধরনের গল্প-গুজব প্রচার করে থাকে, যেগুলো ভিত্তিহীন। যারা ইসলামের নানা ধারা-উপধারা সম্বন্ধে জ্ঞান রাখেন, তারা সহজেই এই গাল-গপ্পোগুলো ধরতে পারবেন। ইসলামের শরিয়তপন্থীদের সঙ্গে কিছু বিষয়ে আহমদীয়া অনুসারীদের মতপার্থক্য রয়েছে। এখন এই বিষয়ে বিচারের ক্ষমতা তো একমাত্র তার, যিনি ইসলাম ধর্ম মতে স্রষ্টার আসনে আসীন। এইটুকু বলার উদ্দেশ্য এই যে, কতোগুলো কেতাবি শব্দ ব্যবহার করে বিভিন্ন গোষ্ঠী উগ্রবাদীদের এই ন্যাক্কারজনক হামলার বিষয়ে সাফাই গাওয়ার পেছনে এক ধরনের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের যে ষড়যন্ত্র— তাকে চিহ্নিত করা। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রতিটি আন্দোলনে আহমদীয়া মুসলিম জামাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বারবার তাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা শাহাবাগ আন্দোলনে তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। যখন একের পর এক মুক্তচিন্তার ব্লগার-লেখক-প্রকাশকদের হত্যা করা হচ্ছিল, তখন তারাও রাজপথে নেমে এসেছেন এই হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচারের দাবিতে। বারবার ধর্মান্ধদের আক্রমণের শিকার হয়েও তারা মুক্তচিন্তার পক্ষেই কথা বলেছেন।

বাংলাদেশে আহমদীয়া মুসলিম জামাতের ওপর বিভিন্ন সময়ে যে নির্যাতন হয়েছে, দুঃখের বিষয় হলো— তার অধিকাংশেরই কোনো বিচার হয়নি। এমনকি বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় পুলিশ প্রহরায় তাদের মসজিদগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। এইসব ধ্বংসযজ্ঞ, অগ্নি-সংযোগ আর লুটপাটের পাশাপাশি তাদের ওপর চলে নানা মানসিক নির্যাতন।

বাৎসরিক জলসা বন্ধের এমন অযৌক্তিক দাবি যে কেবল এবারই উঠেছে তা নয়; ২০১১ সালেও এইসব ধর্মান্ধদের নির্যাতনের কারণে গাজীপুরে আহমদীয়াদের সম্মেলনের অনুমতি বাতিলে বাধ্য হয়েছিলো প্রশাসন। এই যে একের পর এক নতি স্বীকারের নজির, এই যে বিচারহীনতার নজির— এগুলোই এইসব ধর্মান্ধ অপগোষ্ঠীর শক্তির উৎস।

সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। প্রত্যেক নাগরিকের ধর্ম পালনের অধিকার তার সাংবিধানিক অধিকার। কোনো উগ্রপন্থী ধর্মীয় অপগোষ্ঠীর কাছে সংবিধান নতি স্বীকার করলে তা রাষ্ট্রের জন্য লজ্জা। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের লজ্জা।