নেই ভাষা জরিপ, ভাষানীতি, ভাষা কমিশন- কিন্তু ভাষার শত্রুরা হচ্ছে শক্তিশালী!

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 20 Feb 2019, 01:56 PM
Updated : 20 Feb 2019, 01:56 PM

বাংলা ভাষা আজ বিভিন্ন পর্যায়ে অবহেলার শিকার হয়ে কাতরাচ্ছে! ব্যক্তি, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সরকার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পরিধিতে চোখ মেললেই তা সহজে অনুমেয় হয়। যদিও আমাদের ভাষা নিয়ে কোনো জরিপ হয়নি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর প্রায় পঞ্চাশ বছর আমরা অতিবাহিত করছি এখন। আমাদের ভাষা বিষয়ক কোনো জরিপ থাকলে আমাদের বাংলা ভাষার বর্তমান পরিস্থিতি আমরা আরও পরিষ্কারভাবে জানতে পারতাম, বাংলা ভাষা প্রচলন ও অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের সুবিধে হতো।

ভাষাবিজ্ঞানে ভাষা জরিপের বিষয়টি আছে, এই জরিপ অন্যান্য জরিপের মতই। আমরা তো জরিপ বলতে বুঝি- কোনো কিছু পরিমাপ বা ধারণা করার জন্য উপাত্ত সংগ্রহ করা। বিভিন্ন দেশে এই ভাষা জরিপ হয়ে থাকে। ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের ভাষা জরিপ ২০০২ সালে সমাপ্ত হয়, প্রায় ১০ বছরের প্রচেষ্টার ফলে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও ভাষা জরিপের কর্মকাণ্ড লক্ষ করা যায়। অথচ প্রধানত বাংলা ভাষা অধ্যুষিত ও ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন করা একটি দেশে আজ পর্যন্ত কোনও ভাষা জরিপ হয়নি! একুশে ফ্রেবুয়ারি এলে আনুষ্ঠানিকভাবে মেতে উঠলেও ভাষা বিষয়ে ভাবনা, বিবেচনা ও উদ্যোগের কথা বছরের অন্যান্য সময়ে বেমালুম ভুলে যাই। ভাষা জরিপ থাকলে রাষ্ট্র, সরকার, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে ভাষার উন্নয়নে ভূমিকা রাখা আমাদের জন্য অনেক সহজ হতো।

শুধু ভাষা জরিপ কেন? ভাষা ব্যবহারের জন্য হঠাৎ হঠাৎ করা কিছু পদক্ষেপ ও ঘোষণা এসেছে কিন্তু একটি জাতীয় ভাষানীতি আমরা ভাষা আন্দোলনের ৬৭ বছর পার হওয়ার পরও প্রণয়ন করতে পারেনি! এরফলে বাংলা ভাষা নিয়ে বেদনা-বিহ্বল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অরাজক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমাদের দেশে শিক্ষানীতি, কৃষিনীতি, খাদ্যনীতি, ক্রীড়ানীতি, বাল্যবিবাহনীতি এবং আরও কত নীতি আছে! কিন্তু ভাষানীতি নেই! একটি ভাষানীতি থাকলে- শিক্ষার মাধ্যম কী হবে, প্রশাসনের ভাষা কী হবে, বানানরীতি কী হবে, আদিবাসীদের ভাষা কী পর্যায়ে থাকবে, ইংরেজিসহ বিদেশি ভাষার অবস্থান কী হবে, কম্পিউটারে ভাষার পরিস্থিতি কী হবে, পরিভাষা কী হবে, রাষ্ট্র ও সরকারের ভূমিকা কী হবে- এগুলো নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা ও দিক-নির্দেশনা থাকত। কিন্তু সে দিকে খেয়াল নেই সংশ্লিষ্ট কারোরই! ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, রাশিয়া, চিন, জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর ভাষানীতি আমারা বিবেচনায় নিতে পারি। তারা তো জাতীয় ভাষা ত্যাগ করে ইংরেজি গ্রহণ করছে না। আমরা উল্লিখিত দেশের কথা বাদই দিলাম, পাশের দেশ নেপালের কথাই বলি, সেও দেশে একটি ভাষানীতি আছে, তারা উচ্চ আদালতে মাতৃভাষা ব্যবহারে সক্ষম হয়েছে অথচ আমরা এখনো আমাদের উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার করছি না!

ভাষা জরিপ ও জাতীয় ভাষানীতির কথা আমরা বাদই দিলাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর ছুঁই ছুঁই, সুবর্ণজয়ন্তী পালনও করবো কিছুদিন পর কিন্তু এত বছর পরও আমরা নিদেনপক্ষে একটি ভাষা কমিশনও গঠন করতে পারিনি! ভাষা কমিশন থাকলেও বর্তমান অবস্থায় বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশে কিছু পর্যালোচনামূলক সুপারিশ পাওয়া যেত, প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু দিক-নির্দেশনা পাওয়া যেত।

সরকারের দু'টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, একটি হলো বাংলা একাডেমি আর একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, এই দু'টি প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষা প্রচলনে কতটুকু জোরালো ভূমিকা পালন করছে, তা মূল্যায়ন করা আজ জরুরি। এদের ওপর যে অর্পিত দায়িত্ব রয়েছে, সে-বিষয়ে তারা কতটুকু ভূমিকা পালন করছে? বাংলা একাডেমির কথাই ভাবি- তারা কি ভাষানীতি প্রণয়নে কোনো বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছে? কিংবা বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলনে কোনো বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে? বা সরকারকে উদ্বুদ্ধ করেছে? না, এ-রকম কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না! এমন কি এই পর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের ১০ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও, বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষা বিষয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য সেমিনার বা কর্মশালা করার পর কোনও সুপারিশ সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছে?

ভাষার বাহন হিসেবে বাংলাভাষাকে আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি, শুধু পারিনি তো নয়, বিশেষত শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাভাষাকে আমরা পরিত্যাগ করছি। আজ বাংলাদেশে ৪২টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সমাজবিদ্যায় যতটুকু বাংলা ব্যবহার হয়ে থাকে, বিজ্ঞানে ততটুকু তো নয়, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রবেশাধিকার একদম নেই। বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিগুনের বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেগুলোর দু'একটি বাদে বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা অচ্ছুৎ শ্রেণীর ভাষা হিসেবে দূরবর্তী অবস্থানে রয়েছে।

শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা দেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকা উচিত নয়। প্রায় সব এগিয়ে থাকা দেশে প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় বা একমাত্র ভাষার মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে। উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত দেশসমূহে- বিশেষত ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানিতে প্রাথমিক স্তরে প্রথম ভাষা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয় না। অথচ আমাদের দেশে ভাষা বিষয়ে বিভিন্নমুখী বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বাংলাভাষাকে সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত না করার মানসিকতা অনেক ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করছি। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রেও বাংলাভাষাকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। এ এক বেদনা-বিহ্বল পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা।

প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষাকে গুরুত্বহীন করে কোথাও কোথাও ইংরেজি ও আরবি ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বেশি। নানা রকমের প্রাথমিক-শিক্ষা বাণিজ্যের আওতায় টেনে নিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। 'ইংরেজি মাধ্যম', 'কিন্ডারগার্টেন', 'প্রি-ক্যাডেট মাদ্রাসা' নামের তথাকথিত প্রাথমিক শিক্ষালয় নগরে-শহরে-বন্দরে ব্যবসায়ী মনোবৃত্তিতে গড়ে উঠেছে। যার বেশির ভাগই প্রাথমিক শিক্ষার মূল দর্শন থেকে বহু দূরবর্তী অবস্থানে রয়েছে। এসব শিক্ষালয়ের পাঠ্যসূচির কেনো সামঞ্জস্য নেই, নেই শিশু মনস্ততে¦র প্রতি লক্ষ রেখে শিক্ষায় গুরুত্ব প্রদান। এসব তথাকথিত শিক্ষালয়ে বাংলাভাষাকে অনেকাংশে অবজ্ঞা আর অবহেলায় টেনে নিয়ে এক কোণায় ফেলে রাখা হচ্ছে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে বাংলা ও ইংরেজির মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এক উদ্ভট পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর জন্য দায়ী আমাদের অবৈজ্ঞানিক এবং অযুক্তিপূর্ণ মন-মানসিকতা।

ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও শরীর-বিজ্ঞানীরা বহু পরীক্ষা করে অভিমত দিয়েছেন যে- প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষাই শিক্ষার একমাত্র বাহন হওয়া উচিত। জাতিসংঘের ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর অনেক গবেষণা ও সমীক্ষা করা হয়েছে। এসব গবেষণা ও সমীক্ষায় প্রাথমিক স্তরে একটি মাত্র ভাষায় শিক্ষাদানের নির্দেশনা রয়েছে। প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষা ছাড়া ভিন্ন দ্বিতীয় কোনো ভাষা শিক্ষার পক্ষে কোনো যুক্তি পাওয়া যায় না। প্রাথমিক স্তরে দু'টি ভাষায় শিক্ষা শিশুকে নিম্নমানের শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করে দেয়, শিশুর স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়, উপলব্ধির ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, শব্দ ভাণ্ডারের ওপর দখল বাড়ায় না, শিশুর বিকাশের পথ বাধাগ্রস্ত হয়। প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনো ভাষা শেখালে শিশুর অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষাার ক্ষমতা ও দক্ষতা হ্রাস পায়। যে শিশু মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করে থাকে, সে সহজেই মাতৃভাষা ছাড়া অন্য বিদেশি ভাষা শিখে নিতে পারে ।

শরীর-বিজ্ঞানীরাও তাদের গবেষণালব্ধ অভিমত দিয়ে বলেছেন যে, প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার বাহন একমাত্র মাতৃভাষা হওয়া উচিত। তারা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, শিক্ষার ওপর স্নায়ুতন্ত্রের সম্পূর্ণ আধিপত্য থাকে। স্নায়ুজগৎ ছাড়া ভাষা শিক্ষা অসম্ভব। স্নায়ুতন্ত্রের এলাকাগুলো খুব প্রণালীবদ্ধ, একের সঙ্গে অন্য পরস্পর জড়িত। মানব শিশুর শিক্ষায় যদি এ প্রণালী নষ্ট হয়, তবে তাতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। শিশু ভাষা শেখে পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে। শিশুর পরিবেশে থাকে স্বাভাবিকভাবে তার মাতৃভাষা। মা ও পরিবারের অন্যান্যরা শিশুদের আদর করে, কথা বলে, ঘুম পাড়ায়, এটা-ওটা চিনিয়ে দেয় মাতৃভাষায়। মানব শিশুর কান দিয়ে শোনার এলাকা ও কথা বলার এলাকা খুবই কাছাকাছি। মাতৃভাষায় পরিচিত ধ্বনিরাশি সংজ্ঞাবহতন্ত্র দিয়ে শ্রবণনিয়ন্ত্রণ এলাকা হয়ে কথা বলার এলাকায় অনায়াসে মুদ্রিত হয়। শিশু শুনে, বোঝে ও বলে ভাব প্রকাশের দক্ষতা অর্জন করে। এভাবে স্নায়ুতন্ত্রের সাথে মাতৃভাষাগত পরিবেশের সম্পর্ক রয়েছে। ভিন্ন ভাষা চাপিয়ে দিলে প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুর শিক্ষা শুধু বাধাপ্রাপ্ত হয় না, শিশুর বুদ্ধিমত্তার বিকাশও বিলম্বিত হতে পারে। অন্য ভাষা শিখবার আগে মাতৃভাষায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের পথ প্রশস্ত করার বিকল্প নেই। সম্প্রতি বিশেষজ্ঞদের মতামতে জানা যায় যে, মাতৃভাষায় শিশুদের পঠন-পাঠন ও শিক্ষা বিস্তৃত হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশের সংবিধানের মোট চারটি স্থানে ভাষা প্রসঙ্গটি উল্লেখিত হলেও ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা'। আর ২৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে 'রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।' সংবিধানে বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার দিক-নির্দেশনা থাকলেও চার দশকের বেশি সময় পার হওয়ার পরও বাংলা দাপ্তরিকসহ রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে আবশ্যিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে না! এই সময়ে এসেও দেখা যায় সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, নামফলক দেওয়াল লিখন হচ্ছে ইংরেজিতে, সরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন বিলের ভাষা বাংলা নয়, ইংরেজিতে। গণমাধ্যমের বিভিন্ন পর্যায়েও বাংলা ভাষার করুণ পরিস্থিতি। ঘরে ও বাইরে অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে- বাংলা ভাষার আলোটুকু গ্রাস করার জন্য।

ভাষা তো একে অপরের সাথে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। আর গণমাধ্যম পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মত বাংলাদেশেও শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে বিকশিত হচ্ছে। আনন্দের কথা। আমাদের দেশে এখন অনেক সংবাদপত্র, বেতার ও টিভি। অনলাইনেও অনেক সংবাদপত্র ও সাময়িকী প্রকাশিত হচ্ছে। আর এসব আমাদের কাছে প্রতিনিয়ত পৌঁছে দিচ্ছে তথ্য, সংবাদ, বক্তব্য, ছবি এবং আরও কত কিছু। আমাদের সকল স্তরের মানুষের ওপর গণ-মাধ্যম বিভিন্নমুখী প্রভাব বিস্তার করছে, আমাদের মনন নির্মাণে সূক্ষ্মভাবে ভূমিকা রাখছে। আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখছে। বিশেষত শিশু-কিশোরদের ওপর এসবের প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি।

আগে আমাদের গণমাধ্যমে, বিশেষত সংবাদপত্রে সাধু-চলিত ভাষা ব্যবহার ও বানান নিয়ে বির্তক হয়েছে। সেসব বিতর্ক ছাপিয়ে সংবাদপত্রে বিভিন্নভাবে বানাররীতিতে আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবহেলায় বাংলা ভাষা ব্যবহারে জটিলতা ও সমস্যা তৈরি হচ্ছে! তবে, কিছু সংবাদপত্র আবার বাংলা ভাষা ব্যবহারে সংহত ও দায়িত্বশীল ভূমিকাও পালন করছে। সংবাদপত্রের বাইরে গণমাধ্যমের আর একটি অংশ, এফএম রেডিও, যা বেশ জনপ্রিয় নতুন প্রজন্মের কাছে, কিন্তু সেই এফএম রেডিওতে বাংলা ভাষার ব্যবহার ভয়াবহ ও দুঃখজনক। ইংরেজি-বাংলা মিশ্রিত ভাষা যেন বাংলা ভাষার বিপরীতে আর এক ভাষার জন্ম দিচ্ছে! এই ভয়াবহ-প্রবণতা সংশ্লিষ্ট এফএম রেডিও-এর ব্যবস্থাপনা পর্ষদ একবারে দেখছেন না! তারা একচক্ষুবিশিষ্ট হরিণ হয়ে পক্ষান্তরে বাংলা ভাষার শত্রুতে পরিণত হচ্ছেন!

আজকাল টিভিতেও এফএম রেডিও-এর মতো ইংরেজি-বাংলা মিশ্রিত ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা অনেক বেড়েছে। টিভির অনেক অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা এই ধরনের ইংরেজি-বাংলা মিশ্রিত ভাষায় হচ্ছে। পাশাপাশি অনেক অনুষ্ঠানে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ইংরেজি-বাংলা মিশ্রিত ভাষায় প্রশ্নোত্তর ও খণ্ডিতভাবে ভাষা বাবহার হচ্ছে। অনেক টকশোতে এই হুজুগে প্রবণতা উন্নাসিকভাবে উসকে দেওয়া হচ্ছে! টিভিগুলোতে নিজেদেরই নীতিমালা ও দিক-নির্দেশনা থাকা জরুরি। বেতার এবং টিভি যদি এসব না দেখেন, না বোঝেন, তবে সরকার বা রাষ্ট্রকে তা প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে।

কিন্তু সরকার ও রাষ্ট্র যে এগিয়ে আসবে, সেই রাষ্ট্রের তো আজ পর্যন্ত একটি ভাষানীতি হলো না! আছে সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান, আছে তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, তাদেরও বাংলা ভাষা ব্যবহারে বিশেষত গণমাধ্যমে বাংলাভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কোনো ভূমিকা নেই। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা না থাকলে, এই ভাষার সংকট আরও বাড়বে। ফ্রান্স, জাপানসহ উন্নত দেশসহ অনেক দেশে তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহারে রাষ্ট্র ও সরকারের নীতি-আইন রয়েছে এবং তা বাস্তবায়নে কঠোর ভূমিকাও রয়েছে। এজন্য তদারকি সেল আছে, এমনকি এক্ষেত্রে আইন-শৃংখলা বাহিনীকেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ভাষাবিরোধী কোনোকিছু হলেই তারা সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে! আর আমরা? ভাষা আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবে নিজেদের অহং প্রকাশে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎপর হলেও- বাংলা ভাষার বিকাশে তৎপর কতটুকু, তা বিবেকতাড়িত বিবেচনায় টেনে আনা উচিত।
বাংলা ভাষার শক্তি অনেক উন্নত ভাষার চেয়েও বেশি। কিন্তু তা আমরা ভুলে যাই! আরও ভুলে যাই যে- বাংলা ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের বাঙালিত্ব, জাতীয় সত্ত্বা, মুক্তিযুদ্ধের দর্শনগত অবস্থান ও ভাষা আন্দোলনের অঙ্গীকার। আমরা শুধু আমাদের অতীত গৌরবের স্মৃতি কাতরতায় চঞ্চল না হয়ে বর্তমান সময়ের নিরিখে বাংলা ভাষার কী অবস্থা- তা বিবেচনা করা উচিত। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কী- তাও ভাবা উচিত। সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্র, সরকার, প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, বিচারালয়, গণমাধ্যম ও ব্যক্তিকে সচেতন ভূমিকায় তৎপর থাকাও একান্তভাবে জরুরি।

এ দেশে একটি লুঠেরা ধনীক ও সুবিধেভোগী শ্রেণীর বিস্তৃতি লাভ করেছে। যারা রাজনীতি, সরকার, রাষ্ট্র ও অন্যান্য পরিসরে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে। এইসব পয়সাওয়ালা লোকদের সন্তানদের ইংরেজি মিডিয়ামে পড়িয়ে, সেই সন্তানদের বিদেশে পাঠানো বা উদ্বাস্তু করে শুধু ক্ষান্ত হচ্ছে না। আরামআয়েশ ও চাকচিক্যময় জীবনের বদৌলতে 'ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা' বলে বাংলাভাষাকে সর্বক্ষেত্র থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য সবসময়ে তৎপর। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কেউ কেউ তাদের সেই পথ অনুসরণ করার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠছেন। আড়াই শতাব্দী আগে এই শ্রেণীর লোকেরা ফারসিকে আর দু'শত বছর ইংরেজিকে নিজেদের ভাষা বলে শুধু কাছে টানেনি, নিজের মাতৃভাষাকে দূরে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। দেশের সামগ্রীক উন্নয়ন, কল্যাণ ও গণতন্ত্রের প্রধান চালিকা শক্তি হচ্ছে সাধারণ জনগণ, সেই জনগণের নিবিড় সম্পৃক্ততা ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য জনগণের ভাষাকে অবজ্ঞা করে দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। 'ইংরেজি মিডিয়াম'কে আরও প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সরকার ও আমরা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ইংরেজিকে বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে 'লিডিং' অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করবো? সেটা এক বড় প্রশ্ন! প্রয়োজনে আমরা ইংরেজি শুধু নয়- ফরাসি, রুশ, জর্মান, জাপানি,চীনা, আরবিসহ অন্যান্য ভাষা শিখবো।

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে গিয়ে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করার জন্য বলেছেন অথচ তার সরকারের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা এখন কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছে, তা বিবেচনা নেওয়া জরুরি। শুধু দাপ্তরিক কাজে নয়, আইন-আদালতসহ প্রায় সর্বস্তরে আজ বাংলা ভাষার ব্যবহার কমছে, ইংরেজির ব্যবহার বাড়ছে। আমরা ভাষা আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবে নিজেদের অহং প্রকাশে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎপর হলেও- বাংলা ভাষার বিকাশে তৎপর কতটুকু, তা বিবেচনায় টেনে আনা উচিত।

কিশোর বয়সের কথা মনে পড়ছে- পাকিস্তানি আমলের কথা মনে পড়ছে, সেই সময়ে প্রভাতফেরির কথা মনে পড়ছে, মনে পড়ছে আরও সেই গানের কথা- 'ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়'। এখন আমরা সেই গানের বাস্তবতা লক্ষ করছি যেন। শহীদ দিবসের যে মূল তাৎপর্য- সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার ও তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা; তা অনেকাংশে শিথিল হয়ে পড়ছে। এই শিথিলতা আর সহ্য করা যায় না।