ভাষা সংরক্ষণের মাধ্যমেই ভাষা টিকিয়ে রাখা সম্ভব

মুহাম্মাদ জাকারিয়া
Published : 19 Feb 2019, 04:19 PM
Updated : 19 Feb 2019, 04:19 PM

কিছুদিন আগে দেখলাম একটি বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বলেছেন, "ভাষা সংরক্ষণ করে ভাষা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।" এমন একটি মন্তব্য দেখে আমি বেশ হতবাক হয়েছিলাম। কারণ, ভাষা খুব স্পর্শকাতর একটি বিষয়, এর সাথে মানুষের অনেক ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও আবেগ জড়িয়ে থাকে। কাজেই, এ ধরনের মন্তব্য করার আগে  সবারই একটু সচেতন বা দায়িত্ববান হওয়া উচিত।

চলুন বোঝার চেষ্টা করি ভাষা সংরক্ষণ বলতে আসলে কী বোঝায়। ওই অধ্যাপকের কথা শুনে আমার মনে হয়েছে, ভাষা সংরক্ষণ মানে হচ্ছে ভাষার ব্যাকরণ ও অভিধান আর্কাইভ করে রাখা, যেমনটা জাদুঘরে ঐতিহাসিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র বা বস্তু রাখা হয়। ভাষা সংরক্ষণ এর মূল অর্থ কী তাই? মোটেও তা নয়। ঠিক কোন ভাষাটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন, কেন সেই ভাষা সংরক্ষণের প্রয়োজন, ভাষা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যগুলো কী –  এই প্রশ্নগুলো খুবই মৌলিক এবং উত্তরগুলো জানতে ভাষাবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই, গুগল করলেই জানা যায় খুব সহজে।

ভাষা সংরক্ষণ বলতে কোন ভাষার উপকরণ আর্কাইভ করাকে বোঝায় না। বরং, একটি মৃতপ্রায় অথবা বিপদাপন্ন ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, সেগুলোর সামগ্রিক ফলাফল হচ্ছে ভাষা সংরক্ষণ। অর্থাৎ, কোনও ভাষা যেন বিলীন হয়ে না যায় সেটার জন্য ওই ভাষার লিখিত টেক্সট বা মৌখিক টেক্সট (যদি সে ভাষার লিপি না থাকে) সংগ্রহ করে সেই টেক্সটসমূহ, টেক্সট থেকে নির্মিত কর্পাস, ব্যাকরণ, অভিধান, গল্পের বই, ইত্যাদি ওই ভাষার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিতরণ করে ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করে দেয়াই হচ্ছে ভাষা সংরক্ষণ। গবেষণা থেকে প্রাপ্ত এই ফলাফলগুলো কোনও নিরাপদ জায়গায় ডিজিটালি মজুদ করা, যাতে গবেষক এবং ভাষী খুব সহজে প্রযুক্তির সহায়তায় এগুলোতে প্রবেশ করতে পারেন- এসব প্রক্রিয়াও ভাষা সংরক্ষণের উপায়।

এখানে টেক্সট বলতে একটি ভাষার গল্প, মানুষের কথোপকথন, গান, কোনও কিছুর প্রক্রিয়া বর্ণনা (ঘর বানানো, মাছ ধরা, ইত্যাদি), ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা, প্রভৃতিকে  বোঝানো হয়েছে। ভাষা সংরক্ষণের এই বিষয়গুলো সহজে বোঝার জন্য সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানী রাসেল বারনার্ডের লেখা পড়া যেতে পারে। তার মতে, ভাষা সংরক্ষণ ভালোভাবে ব্যখ্যা করার জন্য একটি ভাষার বিভিন্ন প্রকারের টেক্সট আর্কাইভ করা এবং সেই ভাষাকে সঞ্জীবনের জন্য নেয়া পদক্ষেপ উভয়ই গুরত্বপূর্ণ। ভাষীর কাছ থেকে রেকর্ড করা টেক্সট, এর সাহায্যে তৈরি করা ব্যাকরণ, অভিধান, প্রভৃতি ভাষা আর্কাইভে রেখে এবং সেগুলোর ব্যবহার করে শিশুদের ভাষা শেখানোর মাধ্যমে ভাষা সঞ্জীবন বা বাঁচানো সম্ভব। ভাষা সংরক্ষণের এই বিশাল কর্মজজ্ঞের প্রায়োগিক উদাহরণ জানার জন্য অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের সরকার অ্যাবরিজিনাল এবং টরেস স্ট্রেইট দ্বীপবাসীদের ভাষা সংরক্ষণে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে সেগুলোর দিকে অনলাইনে একটু চোখ বোলালেই হবে (www.qld.gov.au/atsi/cultural-awareness-heritage-arts/culture-arts/preserving-aboriginal-languages )।

কোনও ভাষাগুলোকে আমরা সংরক্ষণ করব? আদিবাসীদের ভাষা হলেই কী সেটা সংরক্ষণ করতে হবে? বিপদাপন্ন ভাষা নির্ণয়ের জন্য ইউনেস্কোর একটি স্কেল আছে, যার নাম হচ্ছে ইন্টারজেনারেশনাল ডিজরাপশনাল স্কেল, সংক্ষেপে ইজ়িআইডিএস। আর এই ইজ়িআইডিএস তৈরি করা হয়েছে ১৩টি অবস্থার উপর ভিত্তি করে। এই স্কেল অনুযায়ী যদি কোন ভাষা তরুণ প্রজন্ম ব্যবহার না করে তাহলে সেই ভাষাকে বিপদাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। লক্ষ্য রাখতে হবে এখানে শুধুমাত্র ভাষী সংখ্যা মুখ্য বিষয় নয়। অল্পসংখ্যক ভাষী নিয়েও একটি ভাষা বেশ প্রাণবন্ত হতে পারে। যেই ভাষার লিপি নেই সেই ভাষা দ্রুত হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কারণ সেটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখানোর সুযোগ নেই। আমাদের দেশে বেশিরভাগ ভাষারই লিপি নেই, তাই এগুলোর বেশিরভাগই হুমকির মুখে, কিন্তু এর সবগুলোই যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে তা নয়। এইসব ভাষা এবং এর সাথে সংস্কৃতি যেন ভবিষ্যতে বিলীন হয়ে না যায় সেজন্য এগুলোকে ডকুমেন্ট করা হচ্ছে আমাদের প্রথম কাজ। এরপরের কাজটা হচ্ছে ডকুমেন্টেশন এর মাধ্যমে পাওয়া টেক্সট এবং অন্যান্য ফলাফল থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা-উপাদান প্রস্তুত করা, যাতে করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেই ভাষায় শিক্ষা দেয়া যায়। যেই ভাষাগুলো ইতোমধ্যে বিপদাপন্ন, সেগুলোর ক্ষেত্রে ডকুমেন্টেশনের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত ব্যাকরণ বই, অভিধান, গল্পের বই, ইত্যাদির সাহায্যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তরুণ প্রজন্মকে বিপদাপন্ন ভাষাগুলো শেখাতে হবে।

ভাষা সংরক্ষণ করা কেন প্রয়োজন? একটি ভাষা মরে গেলে তাতে ক্ষতি কী? বারনার্ড খুব চমৎকার একটি উদাহরণ দিয়েছেন এই প্রসঙ্গে। জীববিজ্ঞানীরা খুব সহজেই প্রমাণ করতে পারেন পৃথিবীর জন্য জীববৈচিত্র্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, মানবসভ্যতার জন্য ভাষাবৈচিত্র্যের আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কী এর উত্তরে বারনার্ড বলেন, ৪০০০০ বছর আগে শুরু হওয়া আধুনিক হোমো স্যাপিয়েনসের যাত্রায়, মানুষ হচ্ছে বিবর্তনের সবচেয়ে সফল উদাহরণ। কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকে এখন পৃথিবীর আনাচে-কানাচে, বিভিন্ন আবহাওয়ায়, বিভিন্ন ভূমিতে মানুষের বসবাস। আর এগুলো সম্ভব হয়েছে বিভিন্ন পরিবেশে বেঁচে থাকার জ্ঞান বিস্তারের মাধ্যমে, যেটি হয়েছে ভাষার সাহায্যে। ১৫ শতকে ইউরোপিয়ানদের উপনিবেশ শুরুর আগে পৃথীবিতে জীবিত ভাষার সংখ্যা ছিল ৭ হাজার। সেই সংখ্যা এখন ৬ হাজারেরও নিচে। বারনার্ডের হিসাব অনুযায়ী এই ৬ হাজার ভাষার মধ্যে ২৭৬ টি ভাষার মোট ভাষী সংখ্যা ৫ বিলিয়ন। অর্থাৎ, বাকি ৯৫ শতাংশ ভাষার-ভাষী সংখ্যা হচ্ছে মাত্র ৩০০ মিলিয়ন, যার অর্থ দাঁড়ায় এই পৃথিবীকে ৯৫% ভিন্ন ভঙ্গিতে দেখার মানুষের সংখ্যা মাত্র ৫ শতাংশ। এই ৫ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন পরিবেশে (৯৫%) কীভাবে বেঁচে থাকতে হয় সেই জ্ঞানের অধিকারী। এই ৫ শতাংশ মানুষের ভাষা বিলীন হয়ে যাওয়া মানে তাদের সংস্কৃতি এবং বেঁচে থাকার বিভিন্ন কৌশলগত জ্ঞান হারিয়ে যাওয়া। এই তথ্য থেকে পাঠক ভাষা বৈচিত্র্যের গুরুত্ব নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।

ভাষা সংরক্ষণের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে পৃথিবীতে যেন ভাষা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র টিকে থাকে, তার সাথে সাথে যেন টিকে থাকে মাত্র ৫ শতাংশ। মানুষের কাছে ন্যস্ত থাকা বিভিন্ন অনুকূল এবং প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জ্ঞান। আর, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন এই জ্ঞান উপলব্ধির মাধ্যমে পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে। সুতরাং, ভাষা ডকুমেন্টেশন এবং সঞ্জীবনীয় কার্যকলাপের মাধ্যমে ভাষা সংরক্ষণ করে ভাষা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিশ্চিত করে পৃথিবীতে মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য জীববৈচিত্র্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ।

ছবি: সালেক খোকন