রাজ্জাকের পদত্যাগ, আদর্শ ত্যাগ নয়

কবির য়াহমদ
Published : 18 Feb 2019, 11:47 AM
Updated : 18 Feb 2019, 11:47 AM

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে দলীয় সিদ্ধান্তে বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামী তাদের আরও একজন নেতা হারিয়েছে। শীর্ষ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে নেতা হারানোর পর এবার তারা হারিয়েছে তাদের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাককে। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত জ্যেষ্ঠ এই নেতা দলটি থেকে পদত্যাগ করেছেন।

সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদবিধারী এই নেতার পদত্যাগ আদতে তার জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ ত্যাগ নয়। তিনি তার পদত্যাগে একাধিক কারণ উল্লেখ করেছেন যেখানে বলেছেন জামায়াতের মধ্যে সংস্কার চেয়েছিলেন তিনি। সংস্কার সাধনে তার দেওয়া প্রস্তাবগুলো জামায়াত গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ তার। তিনি একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার কারণে দলটির দেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। একাত্তরের ভূমিকার কারণে জামায়াতে ইসলামির গত শতাব্দীর কিছু 'অসামান্য অর্জন' স্বীকৃতি পায়নি বলে দাবি তার। তার ভাষার এই 'অসামান্য অর্জনের' মধ্যে আছে- ৮০ এর দশকে ৮-দল, ৭-দল ও ৫-দলের সাথে জামায়াত যুগপৎভাবে রাজপথে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, 'আমি সবসময় বিশ্বাস করেছি এবং এখনও করি যে, ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে নেতিবাচক ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয় বরং তৎপরবর্তী প্রজন্মকে দায়মুক্ত করার জন্য অত্যন্ত জরুরি কর্তব্য'। তার দাবি, তিনি বিগত তিন দশক নিরবচ্ছিন্নভাবে জামায়াতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, ৭১-এ দলের ভূমিকা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত এবং ওই সময়ে জামায়াতের ভূমিকা ও পাকিস্তান সমর্থনের কারণ উল্লেখ করে জাতির কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত। পদত্যাগপত্রে তিনি বলেছেন তার তিন দশকের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

এবার দেখা যাক, গত তিন দশক ধরে জামায়াতের একাত্তরের ভুল ভূমিকার নিয়ে তিনি কি সত্যি দলটিকে বোঝাতে চেয়েছেন? আব্দুর রাজ্জাকের সাম্প্রতিক প্রকাশিত ইতিহাস তার এই দাবির সত্যতা প্রমাণ করে না। কারণ বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারকাজ শুরু হলে শুরু থেকেই শীর্ষ সকল যুদ্ধাপরাধীর প্রধান আইনজীবী ছিলেন এই রাজ্জাক। ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে আইনি লড়াই করেছেন তিনি। ১৯৯২ সালে পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলা থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীর মামলা, ২০০৭-৮ সালে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী,আলী আহসান মুজাহিদের মামলা লড়েছিলেন তিনি। গোলাম আযমের মামলা থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের সকল মামলার সময়ে একাত্তরে তাদের ঘৃণ্য কার্যক্রমগুলোকে জায়েজিকরণের সমূহ চেষ্টা করে গেছেন, অস্বীকার করে গেছেন তাদের সেই সব অপরাধ। তিনি যদি এখনকার দাবির মত একাত্তরের মানবতাবিরোধী এসব অপরাধীদের ভূমিকাকে ভুল মনে করতেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই সেসব মামলায় ওভাবে একাত্ম হতে পারতেন না।

'যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের মামলা সততা ও একাগ্রতার সঙ্গেই পরিচালনা করেছেন', এমনই দাবি করেছেন আব্দুর রাজ্জাক। যদি সত্যিই তিনি একাত্তরের ভূমিকার কারণে অনুশোচিত হয়ে থাকেন তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের মামলা কীভাবে 'সততা ও একাগ্রতার সঙ্গে' লড়তে পারেন? এই বক্তব্যসহ তার আরও অনেক বক্তব্য এখানে পরস্পরবিরোধী। ফলে পদত্যাগের মুহূর্তে তার একাত্তরকে টেনে নিয়ে এসে বক্তব্য প্রদানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক; এবং এই প্রশ্ন তুলছি সঙ্গত কারণেই।

যে একাত্তরের প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জামায়াতে ইসলামির ভুল ভূমিকার কথা বলছেন সেই একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টাকারীদের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে দেশত্যাগের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রকাশ্যে লড়েছেন তিনি যুদ্ধাপরাধীদের হয়ে। এই সময়ে দেশেবিদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) কার্যক্রম নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে গেছেন। কেবল তাই নয় পদত্যাগের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বিদেশে বসেও এর বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে গেছেন। বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছেন জামায়াতের হয়ে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি তিনি ডিপ্লোম্যাটিক কাজও করেছেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পাড়ের ইউনাইটেড স্টেটস, ইউনাইটেড নেশন্স, ফ্রান্স, জার্মানিতে কাজ করেছেন তিনি। এই কাজের ধরন খোলাসা না করলেও সেটা কী ধরনের কাজ সে গত ক'বছরের বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনেই পরিষ্কার। এই সময়ে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার বৈশ্বিক নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছে। এগুলো যে আব্দুর রাজ্জাকদের জোটবদ্ধ কাজ ছিল তা অস্বীকার কীভাবে করবেন তিনি?

মজার বিষয় হচ্ছে দীর্ঘ তিন দশক ধরে টানা বাংলাদেশবিরোধী কাজ করে আব্দুর রাজ্জাক দলের পদ ছেড়ে দিয়ে নিজেকে ধোয়া তুলসিপাতা প্রমাণে বসেছেন। বছর পাঁচেক আগেও যিনি একাত্তরের গণহত্যাকারীদের পক্ষে প্রকাশ্য আদালতে এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে সোচ্চার ছিলেন ক'বছরের বিদেশ যাপন শেষে নিজের ঘৃণ্য সেই অবস্থান আড়াল করতে দেশবাসীর আবেগের জায়গা একাত্তরকে সামনে এনে নিজেকে সহীহ বলতে চাইছেন। এখানে তিনি কৌঁসুলী ভূমিকায়, কারণ এটা ভালো করেই জানেন তার সমূহ অপরাধ মানুষ ভুলে যেতে সময় নেবে না কেবল একাত্তরের ভূমিকার কারণে জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া উচিত এমন অভিমতে।

আদতে হয়েছেও তাই! এমনই লক্ষণ ইতোমধ্যে প্রকাশিত। অনেককে দেখছি ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পক্ষাবলম্বনকে সেভাবে আমলে নিচ্ছেন না। এখানে কারও যুক্তি থাকতে পারে তার ওই ভূমিকার কারণ পেশাগত। কিন্তু আব্দুর রাজ্জাক বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নিজেই বলছেন এই কাজগুলো তিনি 'সততা ও একাগ্রতার সঙ্গে' করেছেন। কাজগুলোকে দেখছেন তিনি দলীয় কাজ হিসেবে। সুতরাং এখানে এটাকে পেশাগত দিক হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নাই। এগুলো ছিল তার জন্যে দলীয় কর্মসূচি, এবং গত তিন দশক ধরে কাজগুলো দলের জন্যেই করে গেছেন। পদত্যাগের মুহূর্তেও এগুলোকে তার দলীয় আনুগত্যের নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছেনও।

পদত্যাগপত্রে আব্দুর রাজ্জাক গত দশ বছরে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে দলের ঐক্য বজায় রেখেছেন এমন দাবি করে এর প্রশংসা করেছেন। পদত্যাগের চিঠির শেষাংশের এই প্রশংসাবাক্য প্রকৃত অর্থে তার রাজনৈতিক ও আদর্শিক অবস্থানের প্রমাণ। এই পদত্যাগ তাই স্রেফ দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের পদবি ত্যাগ ছাড়া কিছুই নয়। আব্দুর রাজ্জাক দলের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি এবং দলটির রাজনীতি ছাড়ার কথা বললেও জামায়াতে ইসলামির আদর্শ ত্যাগ করেননি।

তিনি বলেছেন, 'এখন থেকে আমি নিজস্ব পেশায় আত্মনিয়োগ করতে চাই'। নিজস্ব পেশা বলতে দেশে আইনজীবী হিসেবে কাজ করা। গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিদেশে থাকা সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী দেশে ফিরতে চান- চিঠির একটা মাত্র বাক্যেই সে ইঙ্গিত। মূলত এটাই তার জামায়াতে ইসলামি ঠেকে পদত্যাগের মূল উদ্দেশ্য; বাকিটা ভূমিকা মাত্র।

এখন দেখার বিষয় কবে তিনি দেশে ফেরেন!