স্বপ্নের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 29 June 2012, 12:57 PM
Updated : 29 June 2012, 12:57 PM

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংকটকালে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর জনাব মোঃ জিল্লুর রহমান আমাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগদান করেন। তদনুযায়ী আমি গত ২০ মে ২০১২ তারিখে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করি এবং তারপর এটিই আমার প্রথম সিনেট অধিবেশন। আজকের অধিবেশনের অনুভূতি আমার জীবনে স্মৃতিময় হয়ে থাকবে। আপনারা জানেন, আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নই। তবে এই ক্যাম্পাসে আমি আগন্তুকও নই। আমি এখানে কখনো সিলেকশন কমিটিতে, কখনো বা সভা-সমিতি কিংবা এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে কোনো কাজ ছাড়াই বহুবার বেড়াতে এসেছি। কাজেই আমি আপনাদের সাথে একাত্ম হয়েই বলতে পারি – এটি আমারও প্রাণের ক্যাম্পাস। বর্তমানে এ ক্যাম্পাসের সাথে আমার জীবনের একটি মহৎ যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে – এটি আমার জন্য খুবই সম্মান ও গৌরবের।

আমার বক্তব্যের সূচনাতেই শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করছি, জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ এবং বিভিন্ন সময়ের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সকল শহীদসহ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। আমি তাঁদের সকলের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি তারিখে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর থেকে বর্তমান সময় অবধি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রায় সমান বয়সী হিসেবে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় চার দশকের কিছু বেশি সময় অতিক্রম করেছে। ১৯৭০-৭১ শিক্ষাবর্ষে মাত্র চারটি বিভাগ, যথা : অর্থনীতি, ভূগোল ও পরিবেশ, গণিত ও পরিসংখ্যান বিভাগে ১৫০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। আজ ২০১২ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে ৬টি অনুষদ, ১৩টি আবাসিক হল, ৩৪টি বিভাগ এবং ২টি ইনস্টিটিউট ও ১টি গবেষণা কেন্দ্র। ছাত্রছাত্রী সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার। সাভার অঞ্চলের উচু-নিচু লাল মাটির প্রান্তরে বেড়ে ওঠা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা ভূমির প্রায় ৭০০ একর জুড়ে বিস্তৃত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আদি গাছ-গাছালির সাথে ব্যাপক বনায়ণের ফলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এখন সবুজে ঢাকা। এরমধ্যে ছড়িয়ে থাকা বিস্তৃত জলাশয়, সবুজ গাছগাছালির মধ্যে লাল ইটের দৃষ্টিনন্দন বেশ কিছু ভবন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ভাবতেও ভাল লাগে যে পৃথিবীর ১০টি জায়গার মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর অন্যতম একটি স্থান করে নিয়েছে যেখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যার প্রজাতির পাখি দেখা যায়। বহুবর্ণিল প্রজাপতি এবং বিভিন্ন প্রজাতির উপস্থিতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছে সমৃদ্ধ জীব-বৈচিত্র্য। বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতিচর্চার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা নাটকের প্রবাদপুরুষ সেলিম আল দীন তাঁর প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ঠিকই অভিহিত করেছিলেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে।

বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে উচ্চশিক্ষার সেই কেন্দ্র যেখানে থাকবে মুক্তবুদ্ধি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, উদার ও প্রগতিশীল মানবিকতা চর্চার পরিপূর্ণ আবহ। তা নিশ্চিত করতে যে শান্ত-সমাহিত পরিমণ্ডলটি দরকার তার সবটুকুই প্রকৃতি দিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে। জ্ঞান-চর্চা ও জ্ঞানবিতরণ এবং নতুন জ্ঞানসৃষ্টি– এই উভয় কাজে ব্যাপৃত থাকে বিশ্ববিদ্যালয়। তার জন্য একদিকে যেমন বিভিন্ন বিষয়ে লব্ধজ্ঞানের বিতরণ চলে শ্রেণিকক্ষে এবং ল্যাবরেটরিতে, অন্যদিকে নিরবচ্ছিন্ন এবং একাগ্র গবেষণা কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে নতুন জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে থাকে দেশ এবং বিশ্বের মানবকূলকে তথা মানব সভ্যতাকে। জ্ঞানবিতরণ ও জ্ঞানসৃষ্টির নিরবচ্ছিন্ন যাত্রাকে সাবলিল, স্বতঃস্ফূর্ত ও নির্বিঘ্ন রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন হয় স্বাধীনতা। মুক্ত ও বাধাহীন পরিবেশে যাতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জ্ঞানচর্চা করতে পারেন, হয়ে উঠতে পারেন পরিপূর্ণ প্রবুদ্ধ মানুষ, তার জন্য দরকার হয় গণতান্ত্রিক বিধি-বিধানের। আমাদের সৌভাগ্য মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ফসল হিসেবে আমরা পেয়েছি গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, ১৯৭৩। এই অ্যাক্ট আমাদের দিয়েছে পরিপূর্ণ স্বায়ত্বশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয় কোনো আমলাতন্ত্র-নির্ভর প্রতিষ্ঠান নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় শীর্ষ প্রশাসন পর্যন্ত, প্রতিটি স্তরে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় গণতান্ত্রিক বিধি-বিধান অনুসরণ করে। সেজন্যে বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালনকে বেঁধে দেয়া হয়েছে তিন বৎসরে। রাখা হয়েছে ডিন, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল এবং সিনেট সদস্যদের নির্বাচনের ব্যবস্থা। একেবারে শীর্ষে উপাচার্যের পদটিকেও সিনেটে তিন জনের প্যানেল নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী সংস্থা সিনেটে সমাজের নানা আলোকিত মানুষের মতামত ব্যক্ত করবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত প্রতিনিধি রাখবার বিধানও আছে। তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সিন্ডিকেটে এবং একাডেমিক কার্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে একাডেমিক কাউন্সিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের বিদ্ব্যান ও পণ্ডিতদের অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্রের এমন সুবাতাস বইয়ে দেয়ার সুযোগ এসেছে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কারণে। সেজন্য আমাদেরকে প্রতিনিয়ত স্মরণে রাখতে হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে, সাবধান থাকতে হয় অন্ধকারের সেইসব অপশক্তি সম্পর্কে যারা ১৯৭১-এ পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী হয়ে গণহত্যায় অংশ নিয়েছে, আমাদের আলোকিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় সক্রিয় হয়েছে। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিনিয়ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ করা এবং অন্ধকারের শক্তির ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ রাখা।

স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ফসল হিসেবে জাতিকে দিয়েছিলেন '৭২-এর সংবিধান এবং বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯৭৩। আমাদের দুর্ভাগ্য মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অন্ধকারের শক্তির ষড়যন্ত্রে আমাদের হারাতে হয়েছে জাতির জনককে, সপরিবারে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়। কারাগারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে জাতীয় চার নেতাকে। নিহত হতে হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। যে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল সংবিধান, তাকে বিকলাঙ্গ করা হয়েছে। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র, ধর্মীয় গোড়ামী ও ভেদনীতির বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও উদার মানবিকতা হিসেবে ধর্ম নিরপেক্ষতা, ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে বাংলাদেশের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখবার জন্য আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং সম্পদের সমতা-ভিত্তিক বণ্টন নিশ্চিত করতে সমাজতন্ত্র – আমাদের সংবিধানের এই মূল স্তম্ভগুলোকে গুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে মুক্তিয্দ্ধু-বিরোধী শক্তি। গভীর পরিতাপের কথা, তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য তারা ব্যবহার করেছে স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে। গণতন্ত্রকে বারবার বাধাগ্রস্থ করেছে সামরিক শাসন। দেশে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অনুশীলনের পথে বড় অন্তরায় হয়েছে তারা। সামরিক স্বৈরতন্ত্র রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করার বদলে তাকে ব্যবহার করেছে ষড়যন্ত্র, হত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে। উপর থেকে সৃষ্ট ও চাপিয়ে দেয়া এই অপ-সংস্কৃতির কাছে মুখ থুবড়ে পড়েছে মানুষের সহজাত, উদার, মানবিক, সহিষ্ণু বোধসমূহ – সমাজে সৃষ্টি হয়েছে অস্থিরতার। উগ্র বলপ্রয়োগে সবকিছু আদায় করবার প্রবণতা সর্বত্র। পরমত সহিষ্ণুতা অন্তর্হিত। শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান যা গণতন্ত্রের পূর্বশত তা দেখা যাচ্ছে না। অপেক্ষা, ধৈর্য – এ শব্দগুলোর অন্তর্নিহীত শক্তি ও সম্ভাবনার কথা আমরা বিস্মৃত হয়েছি।

উচ্চশিক্ষার পিঠস্থান বিশ্ববিদ্যালয়সমূহেও একই চিত্র। স্বায়ত্বশাসন ও মুক্তচিন্তার রক্ষাকবচ বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯৭৩-কে অকার্যকর করতে চেয়েছে সামরিক-বেসামরিক স্বৈরতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই অর্জনকে রক্ষা করতে আমরা সচেষ্ট হয়েছি। আবার এই গণতান্ত্রিক আদেশকে পরিপূর্ণভাবে অনুশীলনে আমরা যত্নবান হইনি। আমাদের শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রীদের গুরুত্বপূর্ণ অধিকার আমরা নিজেরাই হারাতে দিয়েছি। ছাত্র-সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না দুই যুগের অধিক সময় ধরে। সিনেটে নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের রীতিটি আমরা অনুসরণ করছি না। গণতান্ত্রিক অধিকারের সাথে যুক্ত থাকে যে দায়বদ্ধতার বিষয়টি তা জীবন্তভাবে চর্চা করতে ভুল হচ্ছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় অচলাবস্থা। শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দেশের যে সাধারণ নাগরিকদের অর্থে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ চলে তাদের চোখে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ আসনটি অনুজ্জ্বল হতে থাকে।
স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন চর্চা না হতে পারার কারণে সৃষ্ট নানামুখী সমস্যার মধ্যেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। সফলতাও আসছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ বিভাগে সেশনজট প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। অর্থের ও অবকাঠামোর প্রকট সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও শিক্ষকমণ্ডলী বিশ্বমানের শিক্ষাদানে সচেষ্ট আছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সাথে যৌথ গবেষণায় শিক্ষক-গবেষকরা নিয়োজিত আছেন। মানসম্পন্ন গবেষণাপত্রও নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আমি তাঁদের অভিনন্দন জানাই এবং আমাদের মেধাবী তরুণ সহকর্মীদের তাঁদের অনুসরণ করতে আহবান জানাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উজ্জ্বল সম্ভাবনাটির সাথে যোগ রয়েছে দেশের গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থার। গণতন্ত্র যত শক্তিশালী হবে, রাষ্ট্র যত বেশি হবে গণতান্ত্রিক, ততই উচ্চশিক্ষার পিঠস্থান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে আরও বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হবে। অপরদিকে গণতন্ত্রকে স্থায়ী, সর্বব্যাপী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মৌলিক চাহিদাসমূহ পূরণে সক্ষম করে তুলতে দিক-নির্দেশকারী ভূমিকা রাখতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়কে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবার মত উপাচার্য হিসেবে আমারও একটি স্বপ্ন আছে। তা হলো একটি সেশনজট ও সন্ত্রাসমুক্ত বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে শিক্ষার্থীরা শঙ্কাহীন চিত্তে বাধাহীনভাবে জ্ঞান লাভ করবে। আমরা যেন অপরিকল্পিত কোনো কর্মকাণ্ডে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অপূর্ব সম্পদ জীব-বৈচিত্র্য বিনষ্ট না করি। প্রকৃতির যে অপূর্ব নিয়ম– বৈচিত্র্যের মধ্যেও শৃঙ্খলা ও একত্ব– তা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাই অনুশীলন করবে পরিপূর্ণ সচেতনতায়। মানুষ ও প্রকৃতি পরস্পরের বৈরী না হয়ে বন্ধু হবে। 'তোমার ক্রোধ দমন করতে তুমি মাটির দিকে তোমার দৃষ্টি নিবদ্ধ কর'- মহাজ্ঞানীর এই বাণী আমরা ধারণ করবো। সহনশীলতা আয়ত্ত করবো প্রকৃতির কাছ থেকে।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় আমরা অনুসরণ করবো বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯৭৩। আজকের এই সিনেটে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ অনুপস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, ১৯৭৩ অনুযায়ী ছাত্র-ছাত্রীদের পাঁচজন নির্বাচিত প্রতিনিধি এখানে নেই। তারা নেই দুই দশকের অধিককাল ধরে। অত্যন্ত বেদনার কথা ছাত্রসমাজ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদ করে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনের পত্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের নেতা নির্বাচন করবার অধিকারটুকু স্বেচ্ছায় নির্বাসনে পাঠিয়েছে। জাতীয় রাজনীতি এবং দেশ-শাসনে তার মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে। সে কারণে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে সর্বত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পক্ষে জোরালো মত প্রকাশিত হচ্ছে। সিনেটের এই সভায় আমি সেই মতের প্রতিধ্বনি করছি আপনাদের সবার পক্ষ থেকে। সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে আমরা 'জাকসু' নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চাই। তারজন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরোধী ছাত্র সংগঠন ব্যতীত বাকি সকলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক – তা গ্রহণ করবে সকলে। 'সবে মিলে করি কাজ – হারি, জিতি নাহি লাজ'- এই হবে আসন্ন জাকসু নির্বাচনের মূল শ্লোগান।
নর্বাচিত উপাচার্য হিসেবে আজকের এই অভিভাষণ দিতে পারলে আমি খুবই খুশী হতাম। বাস্তব অবস্থার কারণে তা সম্ভব হয়নি। আমি যথাশীঘ্র বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট '৭৩ অনুসরণ করে সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে তোলা হয়েছিল, সবুজের সমারোহ এবং দৃষ্টিনন্দন প্রাণময় জলাশয় ঘিরে নির্মাণ করা হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যেসব আবাসিক হল – সেসব হলে থাকবে শুধুমাত্র বৈধ ছাত্র-ছাত্রীরা। সারা দেশ থেকে আগত পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীরা স্বাধীন, সাবলিল এবং সুশৃঙ্খল পরিবেশে তাদের হলজীবন কাটাবে। জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময় হবে এ জীবন। পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবে তারা এ সময়ে। আধিপত্যের কাছে অবমাননাকর আত্মসমর্পণ, গ্লানিকর দাসত্ব এবং নৈরাজ্যের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসবে প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা – তাদের দিকে যে তাকিয়ে আছে দেশবাসী।

২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর বা সুবর্ণ জয়ন্তি পালন করবে। সামনের এই দশকে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার সকল সম্ভাবনা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। একটি দক্ষ জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজই কেবল তা বাস্তবায়ন সম্ভব করে তুলতে পারে। শিক্ষায় ও গবেষণায় বিনিয়োগ সবচেয়ে দ্রুত ফলাফল এনে দেয়– এই সত্যটি শুধুমাত্র উন্নত দেশ নয়, পিছিয়ে পড়া উন্নয়নশীল দেশসমূহও অনুধাবন করে সে অনুযায়ী বাজেট প্রণয়ন করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষায় বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির আড়াই ভাগেরও কম। বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের শতকরা ১৩ ভাগ শিক্ষার জন্য বরাদ্দ আছে। এসব অর্থ বরাদ্দের অতি সামান্য অংশ নির্ধারিত আছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। উন্নয়নশীল দেশের সাথে তুলনায়ও এইসব বরাদ্দ নিতান্ত অপ্রতুল। অবিলম্বে তা দ্বিগুণ করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের যৌক্তিকতা বর্তমান সরকার নীতিগতভাবে গ্রহণ করেছে। প্রয়োজন যথাশীঘ্র তা বাস্তবায়ন করা।

প্রায় ৭০০ একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা অপার সম্ভাবনার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের আরও নানা শাখায় সমৃদ্ধ হয়ে একটি জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ পুনর্গঠনে এবং আধুনিক বাংলাদেশ গড়বার অভিযাত্রায় ভূমিকা রাখবে। বঙ্গবন্ধু ও লাখো শহীদের স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়বার এই প্রত্যাশায় আসুন আমরা গড়ে তুলি স্বপ্নের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

(২৯ জুন ২০১২ অনুষ্ঠিত ৩১তম বার্ষিক সিনেট অধিবেশনে)

অধ্যাপক মোঃ আনোয়ার হোসেন : উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।