আল মাহমুদ: লোক থেকে লোকান্তরে প্রস্থান

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 15 Dec 2011, 05:38 PM
Updated : 16 Feb 2019, 12:32 PM

লোক থেকে লোকান্তরে চলে গেলেন বাংলা ভাষার প্রধান কবি আল মাহমুদ। জীবদ্দশায়ই তিনি রাজনৈতিক কারণে বিতর্কিত ছিলেন, কিন্তু তার কবিতার অপ্রতিরোধ্য চুম্বকীয় শক্তিকে উপেক্ষা করতে পারেননি কেউ-ই, তা সে রাজনৈতিকভাবে যে দলেরই হোক না কেন। রাজনৈতিক কারণে তাকে যখন প্রত্যাখ্যান করা হতো, তখনও তাকে 'বাংলাভাষার শক্তিশালী কবি' বলে উল্লেখ করার পরই তা করা হতো। কেউ-ই একথা বলেন না যে তিনি গৌণ কবি ছিলেন।

রাজনৈতিকভাবে লেখকরা ভুল করেন, কখনো কখনো রাজনীতির প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়ে ভুল করেন। কখনো কখনো রাজনীতি থেকে বস্তুগত সুবিধা লাভের আশায়ও কেউ কেউ ভুল করেন। কখনো কখনো স্রেফ আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেও ভুল করেন।  এমন যে করেছেন তার নজির আমাদের ভাষায় যেমন আছে, তেমনি আছে অন্য ভাষার কবিদের ক্ষেত্রেও। রাজনীতির অমোঘ শক্তি এড়াবার সাধ্য কার, যেহেতু তা শক্তি, বিত্ত ও প্রতিষ্ঠার এক রক্তিম উৎস।

রাজনীতির সাথে সাহিত্যের এই মাখামাখি নিয়ে এক চমৎকার পর্যবেক্ষণ রয়েছে মেক্সিকোর কবি অক্তাবিও পাসের। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে  তিনি বলেছিলেন,  "জার্মান ও ইংরেজ রোমান্টিসিজম থেকে শুরু করে আমাদের কাল পর্যন্ত আধুনিক সাহিত্যের  ইতিহাস হচ্ছে  রাজনীতির জন্য এক দুর্ভাগ্যজনক  দীর্ঘ আবেগের ইতিহাস। কোলরিজ থেকে মায়াকভস্কি পর্যন্ত বিপ্লব হয়ে আছে এক মহান দেবী, কবি ও ঔপন্যাসিকদের চিরন্তন প্রেয়সী ও মহান বেশ্যা। রাজনীতি মালরোর মস্তিষ্ককে ধোঁয়ায় ভরে দিয়েছে, সেসার বাইয়্যেহোর অনিদ্রাকে করেছে বিষাক্ত, গার্সিয়া লোর্কাকে করেছে খুন, পিরেনিজ-এর এক গ্রামে পরিত্যাগ করেছে বৃদ্ধ মাচাদোকে, পাউন্ডকে বন্দী করেছে এক আশ্রমে, অসম্মানিত করেছে নেরুদা ও আরাগঁকে, সার্ত্রেকে করেছে হাস্যকর, ব্রেতোঁকে বিলম্বিত করেছিল সঠিক কারণ বুঝতে… তবে রাজনীতিকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। আকাশের দিকে থুথু ছুঁড়ে মারাটা আরও বেশি খারাপ, কারণ ওটা নিজেদের দিকে থুথু ছোঁড়ারই সামিল।"

(Enrique Krauze, Octavio Paz: El poeta y la Revolucion, Debolsillo, Mexico, 2014, P- 184)

অন্যত্র পাস নেরুদার কাব্যব্যক্তিত্বের প্রতি সম্মান রেখেই একথাও বলতে ভোলেননি যে  তার  সাহিত্য দূষিত হয়েছে রাজনীতি দ্বারা আর তার রাজনীতি দূষিত হয়েছে সাহিত্যের দ্বারা…" ( Enrique Krauze, Octavio Paz: El poeta y la Revolucion, Debolsillo, Mexico, 2014, P- 94) নেরুদা সম্পর্কে এই কথাগুলো বলার কারণ ছিল তিনি রুশ সমাজতন্ত্র দ্বারা এতটাই আচ্ছন্ন ছিলেন যে স্ট্যালিনের আমলের রাজনৈতিক অন্যায় কর্মকাণ্ডগুলো সম্পর্কে ছিলেন নিরব।

স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর যখন স্ট্যালিনের দ্বারা বহু নিরীহ নাগরিক ও লেখক বুদ্ধিজীবীদের হেনস্তা, গুম, খুন ও নির্বাসনের তথ্য উন্মোচিত হচ্ছিল তখন নেরুদার পক্ষে সেসব জানা ছিল নিদারুণ বেদনার ব্যাপার, কারণ তিনি এই স্ট্যালিন সম্পর্কে প্রশস্তি জানিয়ে লিখেছিলেন কবিতা। পাস সেসব স্মরণ করেই ওই বাক্যটি লিখেছিলেন।

রাজনীতি আমাদের লেখক কবিদেরকেও রেহাই দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের অগ্রগণ্য অনেক লেখকই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যেমন কবি ফররুফ আহমেদ। পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র-বিরোধিতা করতে গিয়ে আমাদের প্রথম সারির অনেক লেখক ভুল সিদ্ধান্তের নজির রেখেছেন। আর সদ্য প্রয়াত কবি আল মাহমুদ জামায়াতের রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ঠিক একই ভুল করেছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর মতো এক গণবরেণ্য ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন জানিয়েও তিনি আরও  একটি বড় ভুল করেছেন। অথচ এই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি একসময় লিখেছিলেন 'নিশিডাক' নামে  এক অবিস্মরণীয় কবিতা :

বলো, তোমার জন্যই কি আমরা হাতে নেইনি আগুন?

নদীগুলোকে ফণা ধরতে শেখায়নি কি তোমার জন্য

শুধু তোমারই জন্যে গাছে গাছে ফুলের বদলে ফুটিয়েছিলাম ফুলকি,

আমগাছে গুচ্ছ গুচ্ছ ফলেছিল

গ্রেনেড ফল….

এই তিনি কী করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে সমর্থন করতে পারেন? এটা ভাবতেও অবাক লাগে যে এত বড় এক কবি এমন  ভুল করতে পারেন কেমন করে। কিন্তু সত্যিই তিনি ভুলটি করেছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে যে, এসব ভুল ছিল ব্যক্তি আল মাহমুদের, ব্যক্তির রাজনৈতিক বিবৃতি, মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়াজাত এক ভুল। যদিও তার কবিতায় এসব ভুলের ছিটেফোটাও নেই। তিনি আশ্চর্য সতর্কতায় কবি ও ব্যক্তি আল মাহমুদের মধ্যে একটি বিভেদের দেয়াল তুলে রেখেছিলেন যে-দেয়াল টপকে একে অপরের সাথে দেখা করার সুযোগ পেতেন খুব কমই।

তার কবিতা সম্পর্কে অনেকেই এই অভিযোগ তোলেন যে যিনি প্রথম জীবনে সাম্যের পক্ষে এত এত কবিতা লিখে পরে কী করে মুসলিম ও  ইসলামী জাগরণমূলক  না হোক, অন্তত এসবের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়ে কবিতা রচনা করতে পারলেন। এ ব্যাপারে আমার উপলব্ধি এরকম: ধর্মীয় বিষয় নিয়ে সাহিত্য রচনার অধিকার সব লেখকেরই আছে, এই অধিকার চর্চা করলেই যে সেটা দোষণীয় তা আমার কাছে মনে হয় না। ইংরেজি ভাষার অনেক আধুনিক মহান লেখকরাও তা করেছেন। যে এলিয়ট আমাদের কাছে এত বন্দিত ও পুজনীয় তিনিও ধর্মের সংক্রাম থেকে মুক্ত নন। দান্তের মতো মহৎ কবির কম্মেদিয়া দিভিনাও  ধর্মীয় রাগে সংরক্ত। কিন্তু দুজনই ধর্মীয় চেতনাকে খোলসের মতো ব্যবহার করে তাদের বক্তব্যকে সর্বজনীন আবেদনে উত্তীর্ণ করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো এই যে আল মাহমুদের ক্ষেত্রে সেই উত্তরণ ঘটেনি। তার সত্যিকারের কাব্যশক্তি নিহিত রয়েছে তার ধর্মীয় খাদে পা হড়কে পরে যাওয়ার আগের পর্বে, অর্থাৎ লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালি কাবিনমায়াবী পর্দা দুলে ওঠে পর্যন্ত। এরপর থেকে ডানপন্থী বা আরও স্পষ্ট করে বললে দাঁড়ায় এই যে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির সমর্থক হওয়ার পর থেকেই তার কবিতা –পাসের ভাষায় – রাজনীতি দ্বারা দূষিত হতে থাকে। সেই দূষণ তিনি আমৃত্যু বহন করেছেন। যদিও একথা অবশ্যই উল্লেখ করা উচিত যে এই দূষণ প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকে সমর্থন করার মধ্যে নয়, বরং বলা উচিৎ কবিতাকে সর্বজনীন আবেদনের জায়গা থেকে পতনের মধ্যে। তার প্রথম পর্বের কাব্যগ্রন্থগুলো যে বিপ্লবী ভূমিকায় উজ্জ্বল, তার পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলো তারল্যে, প্রথার দাসত্বে আর কাব্যিক অনিপুনতায় ম্লান ও স্যাঁতসেঁতে। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি তার ভেতরের বাঘটিকে খুন করে ফেলেছিল, তার লেলিহান আগুনকে নিভিয়ে দিয়েছিল। নিজের ভেতরের অন্ধাকারে তিনি ধর্মকে পথপ্রদর্শক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তার পরের পর্বের কবিতা যতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকুক না কেন তিনি আমার কাছে প্রথম পর্বের  কবিতাগুলোর জন্য আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি কোন ধরনের রাজনৈতিক  ভূমিকায় ছিলেন তা আমার কাছে তুচ্ছ, শুধু তুচ্ছই নয়, ওটার কোনো গুরুত্ব আমার কাছে নেই।  আমার কাছে নেই মানে সাহিত্যের চিরকালের বিচারের মানদণ্ডে ওটা সবসময়ই উপেক্ষিত। তাই যদি না হবে, তাহলে আজ আর কে মনে রাখে পিরানদেল্লোর নাটকগুলো পড়ার সময়  ফ্যাসিবাদীদের সমর্থনে তার ব্যক্তি-ভূমিকার কথা? পাউন্ড কি ফ্যাসিবাদের সমর্থক ছিলেন বলে বর্জনীয় হয়ে যাবেন?

কিন্তু আমি এই কথা বলার মাধ্যমে লেখক শিল্পীর রাজনৈতিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল হওয়াকে মোটেই সমর্থন করছি না। লেখককে অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সঠিক হতে হবে, কিন্তু দলীয় সম্পৃক্ততা এড়িয়ে হলেই সেটা অনেক বেশি নিরাপদ। রাজনীতি আর ক্ষমতাকাঠামো থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকাটা লেখকশিল্পীদের জন্য খুবই জরুরী। কারণ ক্ষমতা হচ্ছে এক আগুন। অক্তাবিও পাস এই আগুন সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে  এক সাংবাদিককে বলেছিলেন যে "ক্ষমতার আগুনের খুব কাছে যেও না, এটা বিশুদ্ধকারী আগুন নয়। "  No te acerques demasiado al fuego del poder, que no es fuego que purifique. ( Los presidents, Julio Sherer Garcia, Grijalbo, 1986, Mexico, P-54 )।

এই আগুনে পুড়ে অনেক প্রগতিশীল লেখক যেমন পুড়ে ছাই হয়ে গেছেন, অনেক লেখক প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে হারিয়ে গেছেন কালের গর্ভে। আল মাহমুদ রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে গিয়ে নিম্নমানের লেখার মাধ্যমে খেসারত তো দিয়েইছিলেন, এমনকি আমাদের সমসাময়িক রাজনীতির পালাবদলের কারণে উপেক্ষিতও হয়েছেন। রাজনীতির এই এক অদ্ভূত বিচার, শ্বাশতকেও সে সমকালে ক্ষমতাবলে উপেক্ষিত করে রাখতে পারে, কিন্তু তা খুবই অল্প সময়ের জন্য। রাজনীতি তার ক্ষুদ্র ও সাময়িক প্রয়োজনে গৌণকে মহৎ আর মহৎকে গৌণ করে দিতে বদ্ধপরিকর। হামেশাই তা করে যাচ্ছে। যে-রাজনৈতিক আদর্শ তাকে বীর বানাবার চেষ্টা করেছে, অন্য  এক রাজনৈতিক আদর্শ তাকে বানিয়েছে খল। আজ তিনি এসব আদর্শের ছোবল থেকে বহু দূরে। তার সাহিত্যকে কোনও রাজনীতি নয়, বরং সাহিত্যের মানদণ্ডেই বিচার করা উচিৎ। সাহিত্য কখনোই রাজনীতিকে সে কাজ করার অধিকার দেয়নি। সেই দায়িত্ব যদি দেয়া হয় তাহলে সাহিত্য তার মহত্ব হারাবে।

আল মাহমুদ আজ কিভাবে বিচার্য তা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে সাহিত্যের মানদণ্ডের উপর । তিনি রাজনৈতিক কী ভুল করেছিলেন তা এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়, এমনকি জীবদ্দশায়ও তা ধর্তব্য ছিল না, কিন্তু আমাদের নোংরা রাজনীতির অনুসারীরা তাই করেছেন। আমি তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেবো স্প্যানিশ সাহিত্যে বোর্হেসের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে বিতর্কের কথা। আল মাহমুদের মতো তিনিও রাজনৈতিক ভুল করেছিলেন, রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিক থেকে ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল। কিন্তু সাহিত্যকে তিনি সেই ভুল থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন বলেই, সাহিত্যে তার বিপ্লবী ভূমিকাকে কেউ-ই, এমনকি প্রবল বামপন্থী ধারার লেখকরাও অস্বীকার করতে পারেননি:

"আমি কেবল  এটাই মনে করি যে বোর্হেসের যা টিকে থাকবে তা রাজনীতি সম্পর্কে তার মতামতগুলো নয়, নয় কৃষ্ণাঙ্গদের উচ্ছেদ করার ব্যাপারে তার তত্ত্বগুলোও কিংবা ভিয়েতনাম যুদ্ধে তার বাহবা। জোরালো  এই দাবীগুলো ঘটনা সম্পর্কে অস্বচ্ছতার ফলে  কিংবা  চিত্তবৈকল্যের মুহূর্তেই কেবল এমনটা হওয়া সম্ভব। আমার ধারণা বোর্হেসের যা টিকে থাকবে তা সাহিত্যের বৈপ্লবিক রূপান্তরের সাথে  সম্পর্কিত বিষয়গুলোই । এবং এটা অস্বীকার করা যাবে না যে বোর্হেস ছিলেন বিপ্লবী; লাতিন আমেরিকায় তার সাহিত্যিক অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।"  (Ida y Vuelta, Elena Poniatowska, Ediciones Era, 2017, P-235) এই কথাগুলো বলেছিলেন পারাগুয়াইযের লেখক আউগুস্তো রোয়া বাস্তোস।

আল মাহমুদকে এখন থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে যদি বিচার করা যায় তাহলে এটা অস্বীকার করার কোনই উপায় নেই যে তিনি –জীবনানন্দ দাশের পর– বাংলা কবিতায় সত্যিকারের এক বিপ্লবী ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন। তার প্রয়াণে বাংলাভাষা তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারালো। রাজনৈতিক ক্ষুদ্র ও অন্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে আল মাহমুদের সাহিত্যিক  কৃতিত্ব খাটো করে দেখলে আমরা নিজেরাই হাস্যকর হবো মাত্র, আল মাহমুদ নন।

রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিক থেকে অনেকেই তো ছিলেন বামপন্থার অনুসারী, তাদের কেউ কি লিখতে পেরেছেন আল মাহমুদের মতো:

"আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ ।"