শহীদ মিনারের সারা বছরের মর্যাদা

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 12 Feb 2019, 01:55 PM
Updated : 12 Feb 2019, 01:55 PM

মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পার হয়ে যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার যদি দেখতে যাই, তাহলে কী দেখবো আমরা? শহীদ মিনার অবহেলায় অবহেলায় করুণভাবে একা যেন পড়ে আছে। শহীদ দিবসের সময়ে ধোয়া-মোছার আওতায় নিয়ে এসে পরিচ্ছন্ন করে বেশভূষায় শহীদ মিনারকে সাজানো হয়ে থাকে, তখন হয়তো বেশ ভালো লাগে!

কিন্তু বছরের অন্য সময়ে ময়লা-ধূলায় আর অবহেলায় শহীদ মিনারের রূপ করুণভাবে বদলে যায়, তখন খুবই খারাপ লাগে! এই রূপ নিয়ে শহীদ মিনার সারা বছর কি মাথা উঁচু করে মর্যাদা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? পারে না! শহীদ দিবসে যেভাবে শহীদ মিনার উজ্জ্বল থাকে, সেই উজ্জ্বলতার অনেকটা সারা বছর ধরে রাখা যায় না? যায়, যদি আমরা আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হই, আমরা গভীরভাবে শহীদ মিনারকে মর্যাদার  আসনে নিয়ে ভাবি এবং তা উপলব্ধি করি, তাহলে তা সম্ভব।

শুধু শহীদ দিবসে আমরা শহীদ মিনারে যেতে চাই না। বছরের অন্য সময়েও যেতে চাই। আমরা অনেকে অবশ্য বছরের অন্য সময়ে সভা-অনুষ্ঠান ও অন্যান্য কারণে শহীদ মিনারে যাই। আমি সে-কথা বলতে চাইছি না। আমরা বছরের যেকোনো সময়ে শহীদ মিনারের সুন্দর পরিবেশে যেন সন্তানদের নিয়ে যেতে পারি, শিশু-কিশোরদের নিয়ে ইতিহাসের গৌরব অনুভব করার জন্য যেতে চাই, সেরকম কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ আমরা চাইছি সবসময়ের জন্য। শিশু-কিশোররা ও প্রজন্মের পর প্রজন্মের সন্তানরা যেন শহীদ মিনারে গিয়ে শহীদ মিনারের গৌরবে গৌরান্বিত হতে পারে, শহীদ মিনারের মর্যাদায় নিজেদের মর্যাদাবানভাবে ভাবতে পারে। শহীদ মিনার হয়ে উঠুক সারা বছরের শ্রদ্ধা জানানোর স্থান, ইতিহাস উপলব্ধি করার স্থান, শহীদদের প্রতি কর্তব্য পালনে অনুপ্রেরণার স্থান, নিজের ভাষাকে ভালোবাসার শপথের স্থান। এ-ধরনের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য চাই পরিপূরক উদ্যোগ। সে উদ্যোগের মধ্যে শহীদ মিনারকে বিশেষ সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে চিহিৃত করে এর মর্যাদা রক্ষা করতে পারি। তবে, তা সামরিক এলাকা সংরক্ষণের মতো নয়, হবে সর্বসাধারণের  শ্রদ্ধা জানানোর এলাকা ও  গৌরবের স্থান।

যে রাস্তাটা শহীদ মিনারের উত্তর দিকে আছে, সে রাস্তাটা প্রয়োজনে বন্ধ করে শহীদ মিনারের চৌহদ্দি বাড়ানো যেতে পারে। এই চৌহদ্দিতে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ভাষা শহীদদের পরিচিতি তুলে ধরে উচ্চকিত করে রাখা যায়, যা থেকে নতুন প্রজন্ম তাদের পূর্বসূরীদের গৌরবের ইতিহাস জেনে নিজেদের চেতনাকে সমৃদ্ধ করতে পারে। বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও শহীদদের সম্পর্কে কবি-সাহিত্যিক ও মনীষীদের বাণী স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে সেখানে। শহীদ মিনার এলাকায় ম্যুরালও সৃষ্টি করা যেতে পারে। বছরের যেকোনো সময়ে দেশ ও বিদেশের আগ্রহী যে কেউ এসে শহীদ মিনারে পুষ্প অর্পণ করতে পারে, শ্রদ্ধা জানাতে পারে, সে-রকম পরিবেশ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকতে পারে। সর্বোপরি শহীদ মিনারকে আরও মর্যাদার স্থান হিসেবে বিবেচনা করার মতো অবস্থা যেন বাস্তবে থাকে, সেরকমভাবে পরিকল্পনা নিয়ে শহীদ মিনার চত্ত্বরকে সুবিন্যস্ত করা জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। সেই কবে শহীদ মিনারটি স্বাধীনতার পর তৈরি করা হয়েছিল, তারপর আর এর সংস্কার বা উন্নয়ন সেভাবে ঘটানো হয়নি। মূল অবয়ব ও অবস্থান ঠিক রেখেই শহীদ মিনারকে আরও কীভাবে মর্যাদাপূর্ণ করে সমৃদ্ধ করা যায়, সেজন্য ভাষাসংগ্রামী, ভাষাবিদ, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা সরকার এগিয়ে আসতে পারে।

একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে মর্যাদা লাভ করায় ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শুধু দেশের নয় বিদেশিরাও আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তাঁদের অনেকে শুধু ২১ ফেব্রুয়ারিতে শ্রদ্ধা নিবেদনে আগ্রহী হন না, বছরের অন্যান্য সময়েও শ্রদ্ধা নিবেদনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বছরের অন্যান্য সময়েও যেন ২১ ফেব্রুয়ারির মতো সুন্দর ও মর্যাদার পরিবেশে শহীদ মিনারকে আমরা দেশ-বিদেশের সকলে কাছে টেনে নিতে পারি, শ্রদ্ধা জানাতে পারি, সেরকম পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখার ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি ও জরুরি। শহীদ মিনার হয়ে উঠুক রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অন্যতম এক গৌরবের স্থান। আমরা শুধু ভাষার জন্য গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টি করিনি, ভাষার আন্দোলন করেই আমরা প্রত্যয়ী হয়ে উঠি ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আমরা অর্জন করি। আর সেই ভাষা আন্দোলনের শহীদ মিনার অবহেলায় অবহেলায় বছরের অন্যান্য সময়ে পড়ে থাকবে, তাতো ঠিক নয়!

শহীদ দিবস পালনের পর বছরের অন্য সময়ে শহীদ মিনারে অন্ধকারে ঘনীভূত হতে থাকবে, আলো জ্বলবে না, ফুল ফুটবে না, ময়লা-আবর্জনা লেপ্টে থাকবে- এরকম অবস্থা তো আমাদের কারও কাম্য হতে পারে না! আমরা দেখছি- বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে অনেক টাকা খরচ করে ফোয়ারা ও অন্যান্য জিনিস তৈরি করা হয়ে থাকে, অথচ শহীদ মিনারের জন্য মতো জাতীয় ও স্থায়ী মর্যাদাপূর্ণ স্থানের জন্য  সময়ের দাবি অনুযায়ী পরিপূরক বাজেট ও উদ্যোগ গ্রহণ আমরা করছিনে!  শুধু ২১ ফেব্রুয়ারির ক'দিন আগে অল্প কিছু টাকা বরাদ্দ দিয়ে চুনকাম ও পরিষ্কারের উদ্যোগ নিয়ে একদিনের জন্য আনুষ্ঠানিকতায় ডুবে যাই এবং আর সারা বছরের জন্য যেন রেহাই পেয়ে যাই! শুধু শহীদ দিবসে নয়, সারা বছর ধরে শহীদ মিনারের মর্যাদা যেন উজ্জ্বল হয়ে থাকে, সেই আকাঙ্ক্ষা আমরা লালন করি ও তা এই সময়ের জরুরি এক দাবিও বটে।