সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন ও ২৮ বছরে শাবিপ্রবি

জিয়া আহমেদ
Published : 12 Feb 2019, 12:59 PM
Updated : 12 Feb 2019, 12:59 PM

১৮৭৪ সালে আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হলো বৃহত্তর বাংলার তিনটি জেলা- সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া নিয়ে। খুব বেশি সময় যেতে না যেতে এই প্রদেশ পরিচিত হয়ে উঠল 'চা প্রদেশ' হিসেবে। রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি ও শিক্ষায় প্রভৃতি ক্ষেত্রে সিলেটের বাঙালিরা অনেক বেশি এগিয়ে ছিল আসামের মানুষদের চেয়ে। সিলেটের আসাম প্রদেশের সাথে যুক্ত হওয়া অনেক সিলেটি ও আসামিরা মেনে নিতে পারে নি, বিশেষ করে সিলেটি বাঙালিরা অনুভব করতে পেরেছিল আসামের সাথে সিলেট একীভূত হওয়ার পেছনে কিছু উদ্দেশ ছিল যা তাদের অর্থনীতি ও শিক্ষার বিকাশে অন্তরায় হতে পারে।

তখন পশ্চিম বাংলার অনেক প্রভাবশালী পত্রিকায় এনিয়ে নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় লেখা হতো, তার মধ্যে হিন্দু প্যাট্রিয়ট এর সম্পাদক কে দাস লিখেছিলেন, "সম্ভাবনাময় ও স্বর্ণময়ী অঞ্চল সিলেটকে আসামের সাথে সংযুক্ত করা হচ্ছে নতুন দেবীর মনোরঞ্জনের জন্য।" ১৯০৫ সিলেটকে আবার বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে যুক্ত করা হয় এবং ১৯১২ সালে পুনরায় আসামের সাথে একীভূত করা হয়। ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে অগ্রসরমান অঞ্চল হিসাবে সিলেটের বাঙালিরা আসামের চেয়ে হাজার গুণ এগিয়ে ছিল বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষায়।

১৯২০ সালের দিকে সিলেটকে বাংলায় ফিরে যাওয়া নিয়ে হিন্দু মুসলিম একীভূত হতে থাকে কারণ অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেন যে সিলেট যদি আসামের সাথে যুক্ত থাকে তবে তার শিক্ষা, অর্থনীতি প্রভৃতি মর্যাদাপূর্ণ বিষয়ে প্রভাব পড়তে পারে। তখনকার সময়ই আসামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল যা নিয়ে হিন্দু মুসলিম অনেকের মধ্যেই উদ্বেগ ছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী যিনি আসাম আইনসভার সদেশ্য ছিলেন। চৌধুরী সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, "আসামের জন্য যে অর্থ ব্যয় হবে সিলেটিরা কেন সে খরচ বহন করবে আর সিলেটিরা কোন শর্তে সিলেটের পরিবর্তে আসামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সম্মত হবে।"

সিলেট একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চল হিসাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল তারপর একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য তাদেরকে লড়াই করতে হয়েছে মোটামুটি হলেও ৭০ বছরের বেশি সময়। ১৯২১ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় সেই সময় থেকেই আসাম প্রদেশের মানুষ জন বিশেষ করে সিলেটের মানুষরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। ১৯২৫ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে ও তা সফল করা যায়নি। ১৯৪০ এর পর তখনকার শিক্ষামন্ত্রী মুনাওর আলী 'শ্রীহট্ট বিশ্ববিদ্যালয়' নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। কিন্তু কিছু অসমিয়রা প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এবং তা নাকচ করে দেয়। ১৯৪৬ সালের শেষ পর্যন্ত অনেক নাটকীয় পর্বের শেষে তা আসাম ব্যবস্থাপনা পরিষদে গৃহীত ও পাস হয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালে সিলেট গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় সিলেটি বাঙালিদের জন্য।

পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় রাজশাহীতে, তখনকার সময় খাজা নাজিম উদ্দিন তার দেওয়া আশ্বাস রাখেননি। ১৯৬২ সালের শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনের পাশাপাশি সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আন্দোলন অব্যহৃত থাকে। সিরাজুন্নেসা চৌধুরী (প্রয়াত স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর মা) এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন তরফ থেকে আশস্ত করার পর ও ১৯৬৪ সালে ফজলুল কাদের চৌধুরীর ইশারায় ও ধূর্ততায় বিশ্ববিদ্যালয়টি চট্রগ্রামে স্থাপন করা হয়।
১৯৬২ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গেছে পূর্ব পাকিস্তানের এই অংশে (সিলেট) বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের স্বপ্ন বাস্তবে আসেনি। দেশ স্বাধীন হবার পর আমরা যখন নিজস্ব ভূখণ্ড পেলাম তখন আবার ও উচ্চারিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। আশির দশকে জিয়াউর রহমান সিলেট সফরে এলে সিলেটবাসীকে আশ্বস্ত করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের। কিন্তু তা বাস্তবে রূপ নেয়নি।

শেষ পর্যন্ত ১৯৮৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ সিলেটে এক জনসভায় ঘোষণা দেন বিশ্ববিদ্যায় প্রতিষ্ঠার। ১৯৮৬ সালের ১৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা ও স্থান নির্ধারণ করে গঠিত কমিটি রির্পোট প্রদান করে। ১৯৮৬ সালের ৩০ এপ্রিল হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ সিলেট সফরে এলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তার স্থাপন করেন। ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি (১৩৯৭ বঙ্গাব্দের পহেলা ফাল্গুন) তিনটি বিভাগ, ১৩ জন শিক্ষক ও ১২০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে শুরু হয় শাবিপ্রবির শিক্ষা কার্যক্রম। সিলেটে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য যে পরিমাণ আন্দোলন ও কাঠখড় পোহাতে হয়েছে বাংলাদেশের আর অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে তা হয় নি।

২৮ বছরে শাবিপ্রবি এর অর্জন লিখে শেষ করার মতো না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার এক যুগান্তকারী রোল মডেল হিসাবে এগিয়ে যাচ্ছে শাবিপ্রবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একনিষ্ঠ গবেষকরা দেশ ও বিদেশের সুনাম কুড়িয়েছেন এবং এই অগ্রযাত্রা অব্যহৃত রয়েছে। ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগ অল্প কয়েক মিনিটে সনাক্তকরণ, মোবাইলে খুদে বার্তায় ভর্তি প্রক্রিয়া, পিপীলিকা নামক বাংলা সার্চ ইঞ্জিন, ড্রোন সহ আরো ও অনেক যুগোপযোগী গবেষণার পৃথিক্য শাবিপ্রবি।

শাবিপ্রবি ইতিহাসে সফলতম প্রশাসকের একজন বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। যিনি নিরলস পরিশ্রম করছেন বিশ্ববিদ্যালয়কে যুগের সাথে, সময়ের সাথে অত্যাধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করা। বিশ্ববিদ্যালয় অনেক সমস্যায় জর্জরিত ছিল, বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ সম্পাদিত হয়েছে কিংবা হচ্ছে তার মধ্যে ছাত্রছাত্রীরা যাতে স্বল্প সময়ের মধ্যে পরীক্ষার ফলাফল হাতে পায় তার উদ্যেগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে শাবিপ্রবিতে সেশনজটের জন্য শিক্ষার্থীরা তাদের মূল্যবান সময়গুলো হারাতো।

বর্তমান উপাচার্য ৯০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছেন যার মধ্যে একাডেমিক ভবন, ছাত্রছাত্রীদের হল, শিক্ষকদের কোয়ার্টার সহ রয়েছে আনুষঙ্গিক অনেক কিছু। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। শাবিপ্রবিতে এখনো যুগের সাথে তার মিলিয়ে অনেকগুলো বিভাগ খোলা হয়নি। তার মধ্যে- ফার্মেসি, মাইক্রোবায়োলজি, আইন, সংবাদিকতা, দর্শন, উন্নয়ন অধ্যয়ন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আশা করি এই দিকে নজর দিবেন। সর্বোপরি বর্তমান প্রশাসনের সহযোগিতায় উপাচার্য তার সুদক্ষ ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কে অত্যাধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করবেন এই প্রত্যাশা রইল।

শুভ জন্মদিন ৩২০ একরের সবুজ ভূমি শাবিপ্রবি।