জিতলে শুধু তারাই জেতার পুরানো সংস্কৃতি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 10 Feb 2019, 11:44 AM
Updated : 10 Feb 2019, 11:44 AM

আহমদ ছফার একটা অবিস্মরণীয় উক্তি আছে। রাজনীতি নিয়ে খুব কম লিখলেও যখন যা লিখছেন তাই তীরের মতো। লিখেছিলেন- আওয়ামী লীগ যখন জেতে তখন শুধু তারাই জেতে। আর যখন হেরে যায় তখন আমরা সবাই হেরে যাই। এ বাস্তবতা এখনো চলমান। তাই আমরা সমর্থন করি। করতে বাধ্য হই।

এবার সমর্থন করেছি শেখ হাসিনার কারণে। বঙ্গবন্ধু কন্যা না জিতলে দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে যেত। সাথে ফিরে আসতো প্রতিশোধের রাজনীতি। লন্ডনে থাকা যুবরাজের অপকর্ম মানুষকে ভয় পাইয়ে দিতে যথেষ্ট। দেশের মূলধারার মানুষগুলোর অকল্যাণ মিডিয়ার দমবন্ধ করার পুরনো বাতিক আর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের চরম ঘৃণা ও ইতিহাস বিকৃতির কারণেই মানুষ আওয়ামী লীগকে চেয়েছে। দেশের মানুষের কাছে আরেক বিষয় ছিল উন্নয়ন। তারা ভালো আছেন। অন্তত আর্থিকভাবে ভালো বোধ করেন। এটা মানুষ হারাতে চায়নি। আমরাতো আমরা, পাকিস্তানি মিডিয়াও তা স্বীকার করেছে। তাদের ভাষায়, কারচুপি হোক আর যাই হোক , যেভাবেই হতো ইলেকশনে শেখ হাসিনার দল জিততো।

এখন কথা হচ্ছে তার মানে কি এই, সব বিষয়ে আমরা নীরব থাকবো? অন্যায় অপমান সংস্কৃতি রাজনীতির বারোটা বাজতে দেখলেও কথা বলবোনা? তা হলে তো আমরা শেখ হাসিনার সরকারের মঙ্গল চাই না। মা যেমন সন্তানের ভুল ধরিয়ে দেয়, ভাই যেমন ভাইকে বিপথগামী হতে দেয়না, পিতা যেমন নজর রাখেন তেমনি মানুষের দায়িত্ব মঙ্গল অমঙ্গলের দেখভাল করা। সেটা কে  যারা নিন্দা বা বিরোধিতা মনে করেন তারাই স্তাবক। তারাই দালাল। তাদের ভেতরই লুকিয়ে আছে আগামী দিনের খন্দকার মোশতাক। আওয়ামী লীগের ভেতর ভুরি ভুরি এসব মানুষ। এরাই সরকারের ভাবমূর্তি আর সম্মান বিনষ্টে যথেষ্ট।

কী সব কাণ্ড দেখছি শুরুতেই। পদক-অপদকে আওয়ামী সংস্কৃতি বরাবর কানা। তারা মনে করেন তাদের সমর্থক বা তাদের হয়ে যারা বলেন বা লেখেন বা ছবি আঁকেন শিল্প চর্চা করেন তাদের কোনও বিকল্প পথ নাই আর কোথাও যাবার। এটা নেতাদের কথা এবং আচরণেও স্পষ্ট। আমার মনে আছে মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর কথা। অনেক মেহনত করে তাকে মেয়র পদে নির্বাচিত করা হয়েছিল। তিনি আবদুল্লাহ আল নোমানের কাছে এমপি পদে পরাজিত হবার পর মেয়র পদে দাঁড়িয়েছিলেন। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে তখন বিএনপি হাওয়া বইছে। তাদের রমরমা সময়। বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতি কর্মীরা মিলে তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে নাগরিক পরিষদের প্রার্থী করে বৈতরণী পার হতে সাহায্য করেন।

নাটকের ছেলে মেয়েরা যেভাবে খেটেছিল তা তুলনাবিরল। কিন্তু জেতার পরপর আঞ্চলিক ভাষায় কটূ কথা বলে তাদের তিরষ্কার করতে পিছ পা হননি তিনি। এই অপ্রত্যাশিত আচরণে বিস্মিত নাটকের বন্ধুদের মুখগুলো আমি কখনো ভুলবোনা। যা বিএনপির নেতারা মনে থাকলেও আচরণে কোনওদিন প্রকাশ করতেন না।

আমি সবসময় বলি বিএনপিতে এলিট মুসলিম শ্রেণির মানুষ বেশি। কারণও ঐতিহাসিক। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের রাজনীতিতে বিভক্ত উপমহাদেশে বাঙাল মুসলমানের অভিজাত শ্রেণি ছিলেন মুসলিম লীগে। তাদের অনেকেই পরে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছিলেন। অনেকে বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমা আর প্রতিভায় মুগ্ধ হলেও বেশির ভাগ ছিলেন সুযোগ কাতর। পরে যখন বিএনপি হলো তখন তারা অকূলে কূল পাবার মতো সেখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। যে কারণে বাংলাদেশে মুসলিম লীগ বলে কোনও দল থাকলোনা। আর ভারতে কংগ্রেস আজো টিকে আছে বহাল তবিয়তে।

আওয়ামী লীগ মনে করে সংস্কৃতি যারা করেন বা করতে আসেন তাদের জায়গা একটাই। তারা নৌকার কথা বলবে। নৌকায় ভোট দিবে। আর ভোটে জেতার পর আওয়ামী নেতাদের অপমান ও মেজাজ হজম করবে। যা সংখ্যালঘু নামে পরিচিত হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টানদের বেলায়ও প্রযোজ্য। সবচেয়ে যেটা মজার বিষয় রাস্তায় থাকা আওয়ামী লীগ হাহাকার বা রাগ করলেও গদিতে আসার পর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বা ছদ্মবেশি দালালদের ও পুরস্কৃত করে। যত দিন যাচ্ছে আমরা ভেবেছিলাম তাদের অভিজ্ঞতা আর সময়, তা হতে দেবেনা। মনে হচ্ছে সেটা হবার নয়। তা না হলে এবার ও 'আবদুল জলিল যেভাবে মারা গেলেন' নামের উপন্যাস লেখা কাউকে পুরস্কৃত করা হতো না। নামটাই বলে দেয় লেখকের মনে কী ছিলো। ধরুন, যদি আপনি কোনদিনও একটা গদ্য লিখে শিরোনাম দেন 'আবদুল মান্নান ভূঁইয়া যেভাবে মারা গেলেন' আপনাকে বিএনপি কখনো পদক দেবে? এদিক থেকে বিএনপি এগিয়ে।

যেহেতু আমাদের দেশের সবকিছুই রাজনীতি নির্ভর তারা তাই ছাড় দিতোনা। তারা তাদের কোনও গৃহপালিত দুশমন বা ছদ্মবেশিকেও কাছে  ভিড়তে দেয়নি। এটা তাদের দিক থেকে সঠিক কাজ। কে না জানে আমাদের সবকিছু গিলে খেয়েছে রাজনীতি। এমনতো না যে আমরা খুব উদার আর মনখোলা জাতি। আমাদের সববিষয়ে কোনও সংকীর্ণতা নাই বা দীনতা নাই। জীবনের সবদিকে যখন আপনারা দল ও দলের বাইরের কাউকে ছাড় দেন না এ ব্যাপারে কেন দেন? নিশ্চয়ই কারণ আছে।

আওয়ামী লীগ আমলে আরেকটা বিষয় খুব হয়। যারা কাছের যারা খাটে যারা তৃণমূলের তারা আস্তে আস্তে পর হয়ে যায়। তাদের সাথে দলের নেতাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। ঊঠে আসে অন্যসব মানুষ।  এমন সব মানুষ যারা গতকাল তরী ভিড়িয়েছে ঘাটে। তাদের লোকবল অর্থবল আর দাপটের কাছে মার খেতে খেতে ত্যাগীরা একসময় নাই হয়ে যায়। একা শেখ হাসিনা কি সব খবর রাখতে পারেন? পারলে তার জান বাঁচানো মানুষকে তিনি সম্মান জানতে কুড়ি বছর সময় লাগতো? এখানেই বোঝা যায় কিভাবে আমরা নেতাকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলি।

এবার শুরু থেকেই অপপ্রক্রিয়া চোখে পড়ছে। তাই এই লেখাটি লিখতে বাধ্য হলাম। কেউ বলছেনা তোষামোদী আর স্তাবকতাকে কাছে রাখতে। বরং সেটা হচ্ছে বলেই সত্য জানতে পারা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। সত্য না জানলে যে কী বিপদ তার একটা গল্প বলি। বঙ্গবন্ধুর মতো অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনকের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়ে মেজর জলিল কোতায়ালী এলাকায় কত ভোট পেয়েছিল জানেন? না জানলে ইতিহাস থেকে জেনে নিন। বঙ্গবন্ধু বিরক্ত হয়ে তার সেক্রেটারিকে ডেকে বলেছিলেন তোমরাতো আমাকে একবারও বলোনি, টের পেতে দাওনি এসব। কারণ তিনি জানলে ওই এলাকায় দু একবার গেলেই পরিবেশ ভিন্ন হয়ে যেত। এইতো স্তাবকদের কাণ্ড।

তোষামোদকারীরাই বিভ্রান্তি ছড়ায়। তারাই আশেপাশে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর সিডনি সফরের পর আমি স্পষ্ট বুঝেছি আওয়ামী রাজনীতি কতটা আত্মঘাতী হতে পারে। তিনি জানতেও পারবেন না তা। কী হয়েছিল, কারা কী কিভাবে দখল করে নিয়েছিল? একটি বড় দলের জন্য এগুলো স্বাভাবিক। আর এই প্রবণতাগুলো বোঝা ও জানানোর জন্য বা ঠেকানোর জন্য তাজউদ্দিন আহমদ কিংবা সৈয়দ আশরাফের মতো নেতা চাই। তাদের কী আমরা দেখছি কোথাও? সুদিনের কোকিলরা লিস্ট করে দিচ্ছে আর ঘাপটি মেরে থাকা মাউষরা মজা লুটছে।

আহমদ ছফা আবারো মুখ লুকিয়ে বলছেন: বলছিলাম না? দেখলেন ত। জিতলে খালি তারাই জিতে। আর হারলে যে আমরা হেরে যাই? যাবে কোথায় সাধারণ-অসাধারণ তেলহীন তৈলাক্ত মেধাহীন মানুষেরা?

যিনি জানলে কাজ হয় বা হবে তার কাছে যাবার পথটা সুগম হলে হয়তো সমস্যা কিছুটা লাঘব হতে পারে। আর কোনও পথ নাই আপাতত।