শিশুকে চ্যালেঞ্জ গ্রহণেরও সুযোগ দিন

উপমা মাহবুবউপমা মাহবুব
Published : 5 Feb 2019, 02:02 PM
Updated : 5 Feb 2019, 02:02 PM

দ্য গার্ডিয়ানে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি আর্টিকেল `By mollycoddling our children, we're fuelling mental illness in teenagers' – পড়ছিলাম। সেখানে বলা হয়েছে অভিভাবকরা অতিরিক্ত আগলে রাখা এবং আশকারা দেওয়ার কারণে আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে শিশুদের মধ্যে সংকট বা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার দক্ষতা গড়ে উঠছে না। ফলে তারা মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে বেড়ে উঠছে। টিনএইজ বয়সে বাসার গণ্ডি ছেড়ে এই ছেলে-মেয়েরা যখন বৃহত্তর পরিবেশে নানা ধরনের মানুষের সংস্পর্শে আসছে, বিভিন্ন ধরনের আবেগে তাড়িত হচ্ছে তখন তারা সমস্যা বা সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ফলে তাদের মনের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলাফলস্বরূপ অনেকেই মানুষের সঙ্গে মিশতে পারছে না, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

আর্টিকেলটির একটি উদাহরণ খুব চমৎকার লেগেছে। সেখানে বলা হয়েছে কিছু বিশেষ জীবাণু এবং এলার্জি আছে যেগুলোর আক্রমণ একটি শিশুর শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে তার পূর্ণ কার্যক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করে। যে সব অভিভাবক তাদের শিশুদের কোনভাবেই ধুলাবালি বা পিনাটের মতো সম্ভাব্য এলার্জি সৃষ্টিকারী বস্তু বা খাবারের সংস্পর্শে আসতে দেন না, তারা প্রকৃতপক্ষে ওই শিশুদের শরীরের রোগপ্রতিরোধক সিস্টেমকে পূর্ণভাবে গতিশীল হতে হলে যে লার্নিং সিস্টেমের মধ্য দিয়ে যাওয়া দরকার তা থেকে বঞ্চিত করেন। এই কথাগুলো দিয়ে লেখক বোঝাতে চেয়েছেন যে এ ধরনের অতিসতর্ক বাবা-মায়ের শিশুরা সাময়িকভাবে ভালো থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। যার ফলে ভবিষ্যতে তারা তাদের নিজস্ব নিরাপদ বলয়ের বাইরে ভিন্ন পরিবেশের সংস্পর্শে এলে বা অপরিচিত খাবার গ্রহণ করলে দ্রুত রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। আর্টিকেলটি পড়তে পড়তে আমার এক পরিচিত তরুণের কথা মনে পড়ে গেল যে জীবনে কখনো চিংড়ি মাছ খায় নি। তার বাবা-মায়ের ধারণা চিংড়ি মাছে ছেলেটির এলার্জি আছে। এটা সত্যি যে ছেলেটি ছোটকাল থেকেই এ্যাজমা আক্রান্ত। কিন্তু তারপরও কোন খাবার না খাইয়েই সেই খাবারে এলার্জি আছে বলে ধরে নেওয়া অতিআদর-যত্নের এক মারাত্বক বহির্প্রকাশ। যা আসলে সেই তরুণটির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনে নি। তরুণ বয়েসে এসেও সে অনেক রকমের বিধি-নিষেধের মধ্যে থাকে। খাবার বা পরিবেশে একটু পরিবর্তন হলেই বেচারা অসুস্থ হয়ে যায়। অন্যদিকে আমি আরেক জনকে চিনি যার মা মেয়েটির কিছু খাবারে হালকা এলার্জি আছে তা জানার পরও সেই খাবারগুলো খাইয়ে খাইয়ে তাকে খাবারগুলোতে অভ্যস্ত করে তুলেছিলেন। মেয়েটির সমস্যা অবশ্যই হয়েছিল। কিন্তু সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করে কিভাবে এগিয়ে যেতে হয় সেটাও সে ছোটকাল থেকেই শিখে নিয়েছে। ফলে মারাত্নক রকমের অ্যাজমার সমস্যা থাকার তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থেকে সফলতার সঙ্গে পড়ালেখা শেষ করে মেয়েটি এখন বিদেশে পিএইচডি করছে।

যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আর্টিকেলটিতে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সংক্রান্ত উদাহরণটি দিয়ে মূলত বলা হয়েছে যে সব শিশুরা ছোটকাল থেকে ছোটখাট সংকট বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় না পরবর্তীতে তাদের মধ্যে সেগুলো মোকাবেলা করার দক্ষতা গড়ে উঠে না। পরবর্তী জীবনে এই শিশুরা হঠাৎ করে যখন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে – প্রেম ভেঙ্গে যায় বা বুলিং-এর শিকার হয়, তখন তারা এই পরিস্থিতিগুলো সামলাতে পারে না। ফলে খুব সহজেই তারা ভেঙ্গে পড়ে যা পরবর্তীতে মানসিক রোগের কারণ হতে পারে।

হোক বাংলাদেশ অথবা আমেরিকা, আমরা বাবা-মায়েরা সবাই সন্তানদের কল্যাণ এবং নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি। আমরা প্রত্যেকেই চাই সন্তানদের জন্য নিরাপদ পরিবেশে নিশ্চিত করতে। চেষ্টা করি যেন কোনভাবেই সে ব্যথা না পায়, কেউ যেন তাকে কষ্ট দিতে না পারে। কিন্তু এটাওতো সত্যি যে আজকে যে শিশু আগামীকাল তাকে প্রতি মুহুর্তে নানারকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। তরুণীকে একা রাস্তায় হাঁটতে হবে। লক্ষ্ণী ছেলেটিকে পাড়ার মাস্তানদের শাসানির মুখোমুখি হতে হবে। তাই শিশুরা যদি এখন থেকেই ছোট ছোট চ্যালেঞ্জ নিতে না শেখে – হোক তা একা একা লিফট ব্যবহার করা অথবা বাজি ধরে দেওয়াল টপকানো, ভবিষ্যতের এই পরিস্থিতিগুলো তারা মোকাবিলা করবে কিভাবে? তাই শিশুদের ভবিষ্যত কল্যাণের কথা ভেবেই তাদের এখন থেকেই তৈরি করা প্রয়োজন। একটি এক বছরের শিশুর জন্য একা একা খাবার খাওয়া অনুশীলন করাও একটি চ্যালেঞ্জ। এটি তাকে ছোটকাল থেকেই স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করে। এক সঙ্গে থাকলে শিশুরা নানা রকম নতুন খেলা এবং সেগুলোর নিয়মকানুন উদ্ভাবন করে। তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়, মতানৈক্য হয়। সেগুলো তারা নিজেরাই সমাধান করে। এগুলোই সংকট যা শিশুদের মধ্যে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। দুষ্টু লোক যেন খারাপভাবে শিশুর গায়ে হাত দিতে না পারে সে বিষয়ে সচেতন থাকার পাশাপাশি বাবা-মায়ের উচিত তাকে খারাপ স্পর্শ আর ভালো স্পর্শের মধ্যকার পার্থক্য বোঝানো। আরও জরুরি এ রকম পরিস্থিতিতে করণীয়গুলো তাকে শেখানো, যেমন: জোরে চিৎকার দেওয়া, বাবা-মাকে নির্ভয়ে বিষয়টি খুলে বলা ইত্যাদি। তাহলে শিশুর সাহস বাড়বে। কখনো কেউ খারাপভাবে স্পর্শ করলে সেই মুহুর্তটি মোকাবেলা করা তার জন্য সহজ হবে।

কয়েক দিন আগে ঢাকার স্বনামধন্য একটি স্কুলে গেছিলাম। প্রথম শ্রেণির শিশুদের সেদিন প্রথম ক্লাস। সংখ্যায় তারা প্রায় দুশো জন। স্কুল ছুটির সময় বাবা-মায়েরা গেইটে ভিড় জমিয়েছেন। সবাই বেশ উদ্বিগ্ন। ছুটির ঘণ্টা বাজার পর স্কুলের গেইট খুলে দেওয়া হলো। দেখলাম ক্লাস ফাইভ-সিক্সের তিন/চারটি মেয়ে প্রথম শ্রেণির শিশুদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারাই বাবা-মায়েদের কাছে শিশুদের হস্তান্তর করবে। আশে-পাশে কোনও শিক্ষক দেখা যাচ্ছে না। গেইট খোলার কয়েক মিনিটের মধ্যে বাঙালি জাতির চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ি বাবা-মায়েরা হুড়োহুড়ি করে ভেতরে ঢুকে গেলেন। কে কার বাচ্চাকে আগে নেবেন তা নিয়ে প্রবল প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। দেখলাম, ওই কিশোরী মেয়েরা স্কুলের দারোয়ানদের সহায়তায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বার বার অভিভাবকদের অনুরোধ জানাচ্ছে, শান্ত হয়ে এক জন এক জন করে শিশুদের গ্রহণ করতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তারপরও খুব ধীর-স্থিরভাবে ওই কিশোরীরা পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছিল। অনেক অভিভাবক কিশোরী শিক্ষার্থীদের দিয়ে শিশুদের অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়ার এই পদ্ধতিকে বিরক্ত হচ্ছিলেন। আমি কিন্তু মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। কিশোরীরা কাজটি কত ভালোভাবে করতে পেরেছে বা পারে নি সেটির চেয়ে বড় কথা তাদের শিক্ষকরা বিশ্বাস করে এই কাজের দায়িত্ব তাদের দিয়েছেন। তারাও চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছে। এই অভিজ্ঞতা অবশ্যই তাদের ভবিষ্যতে আরও বড় দায়িত্ব গ্রহণে সহায়তা করবে। ঠাণ্ডা মাথায় কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাহসী করবে।

তাই আসুন আমরা বড়রা আমাদের সন্তানদের মানসিক ক্ষমতার উপর বিশ্বাস স্থাপন করি। তাদের ছোটখাট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার সুযোগ করে দেই। তাহলেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মানসিকভাবে শক্তিশালী এবং সাহসী হয়ে বেড়ে উঠবে। তাদের হাতে দেশ তথা বিশ্বের ভালো-মন্দের দায়িত্ব দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারবো।