আমাদের জিহ্বাটাকে সংযত রাখতে হবে

তারানা হালিম
Published : 15 Dec 2013, 04:52 PM
Updated : 28 June 2012, 05:48 PM

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে তৈরি হওয়া জটিলতায় জড়িয়ে গেছেন শিল্পীদের একাংশ। এ প্রেক্ষিতে আমাদের শিল্পীদের সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা শুধুমাত্র শিল্পীর মধ্যে নয়, দেশের যে কোনও সচেতন নাগরিকের মধ্যে থাকতে হবে। আমি মনে করি, সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য, সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। কাজ করতে হবে। শিল্পীর নিজস্ব মতাদর্শ থাকতে পারে। তিনি রাজনীতি করতে পারেন। কোনও না কোনও সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত থাকতে পারেন। তবে এটা যেন সমাজের সব মানুষের সামাজিক ন্যায়বিচার প্রাপ্তি বা সামাজিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার না করে। আইন কিন্তু তার নিজস্ব গতিতে চলে। ব্যক্তির কোনও বক্তব্য বা মন্তব্য যেন আইনের নিজস্ব গতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে।

সাগর-রুনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষেই কাজ করেছেন। আমি শুধু এ জন্যই বলব না যে, তাদের হত্যাকান্ডের বিচার হোক। তারা যদি ভিন্ন মতাদর্শের লোকও হতেন, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে। দেশের যে কোনও নাগরিকের, তা তিনি একজন সাধারণ মানুষ হন, কী বুদ্ধিজীবী হন, যে কোনও মতাদর্শে বিশ্বাসী হন, তার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের সমাজে সবসময় আমরা দেখেছি, যে কোনও ঘটনায় খুব সহজভাবে কিছু উক্তি করে ফেলি আমরা। খুব সহজেই উপসংহার টেনে দিই। এর প্রতিক্রিয়া বা প্রভাবের কথা না ভেবেই। এটা খুব দুঃখজনক। এটা মানবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

আমরা সামাজিক পরিবর্তনের কথা বলি। সামাজিক পরিবর্তনের এটাও একটা দিক। বিশেষ করে মৃত কোনও ব্যক্তি যিনি তার বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনও উত্তর দিতে পারছেন না, তাকে নিয়ে যা খুশি তাই বলে দেওয়াটাও একটা বড় অন্যায়। একজন মৃত ব্যক্তির চরিত্রহনন করা হলে এটা আমাকে মানুষ হিসেবে কষ্ট দেয়।

আরেকটি বিষয় হলো, নারী যখন কোনও ঘটনায় জড়িত হয়ে পড়েন, সেখানে ওই নারীটিকে অবমাননা করার চেষ্টা করা হয়। একজন নারীকে নিয়ে গালগল্প তৈরি করা হলে সেটা খুব উপাদেয় একটি বিষয় হয়ে ওঠে। যখন কোনও নারী তার স্বামীকে ডিভোর্স করেন, তখন তাকে যারা চেনেন তারা তো বটেই, যারা চেনেন না তারাও নানা গল্প ফেঁদে নেন। ওই নারীকে খুব সহজেই 'চরিত্রহীন' আখ্যা দিয়ে দেওয়া হয়। আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে গিয়েও আমি দেখেছি, মেয়েরা স্বামীদের ডিভোর্স দিতে ভয় পান। আদালতে এসে তারা বলেন, স্বামীকে তালাক দিলে তাদের চরিত্রহীন আখ্যা দেওয়া হবে। তাই স্বামীর শত নির্যাতন সয়েও সংসার করে যান তারা। এমনকি তাদের নিজেদের পরিবারও তাদের দিকে আঙ্গুল তোলেন। যখন কোনও নারী ধর্ষিত হন, তখনও দেখা যায় ধর্ষকের স্ত্রী স্বামীর পক্ষ নিয়ে নেন। তিনি স্বামীর ধর্ষণকর্মের ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য বলেন, তার স্বামীকে ওই নারী 'প্রলুব্ধ' করেছেন। বিপরীতে ধর্ষিতার স্বামী কিন্তু বলেন না তার স্ত্রী কোনও অন্যায় করেননি, তিনি নির্যাতিত হয়েছেন। ধর্ষিতার স্বামী স্ত্রীর পাশে না দাঁড়িয়ে তাকে 'অসতী' আখ্যা দিয়ে ত্যাগ করেন।

সমাজের সব শ্রেণীর নারীকেই এই বেদনা সইতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক স্বামীর হাতে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। তবুও সমাজের একটা পক্ষ তাকে 'চরিত্রহীন' আখ্যা দিয়ে দিলো। এভাবে গালগল্প ছড়ানো হলো যে, ওই শিক্ষকের পরকীয়া সম্পর্কের কারণেই তার স্বামী তাকে নিপীড়ন করতেন। এভাবে নারীর বিরুদ্ধে যে কোনও অন্যায়কে জাস্টিফাই করা হয়। ন্যায্যতা দেওয়া হয়।

যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে, ওই শিক্ষক অন্য কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তাই বলে তাকে নিপীড়ন করার অধিকার তো তার স্বামীর নেই। তিনি স্ত্রীকে ত্যাগ করতে পারতেন। এটা ছিল তার আইনি অধিকার। কিন্তু স্ত্রীকে নিপীড়ন করার অধিকার বা তার দুটো চোখ উপড়ে ফেলার মতো নিষ্ঠুর-নির্মম নির্যাতন করার অধিকার তাকে কেউ দেয়নি। আর এ ধরনের অন্যায়কে যখন ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, সেটার চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। আমরা নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করলে প্রগতিশীলতার সব শর্তই পূরণ করতে হবে। নিজেদের সুবিধামতো একবার প্রগতির পক্ষে, আবার প্রগতির বিপক্ষে যাব, তা হয় না।

আসলে আমাদের সংস্কৃতিতে অন্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা না বলার বোধটা তৈরি হয়নি। যতক্ষণ না একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন রাষ্ট্রের কোনও নীতিকে ভায়োলেট না করে, দুর্নীতিকে উৎসাহিত না করে ততক্ষণ পর্যন্ত এ বিষয়ে আমাদের নাক গলানোর কোনও সুযোগ নেই। এ ধরনের প্রবণতা সামাজিক অবিচারকে উৎসাহিত করে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। বিশেষ করে নারীর চরিত্রহনন করা হলে এটা ফতোয়াবাজি বা দোররা মারার মতো ঘটনাগুলোকে উৎসাহিত করে।

এ জন্যই কারও মর্যাদাহানি হয়, এমন কিছু বলা থেকে আমাদের জিহ্বাগুলোকে সংযত রাখতে হবে। আমি কিন্তু সংসদেও নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলি। মাঝে মাঝে সেখানে নারীদের নিয়ে নিকৃষ্ট ধরনের মন্তব্য করা হয়। আমি বারবার বলেছি, কোন নারী কী পোশাক পরলেন বা তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে কথা বলা উচিত নয়। বরং কোনও ব্যক্তির দ্বারা সমাজের বা রাষ্ট্রের কোনও ক্ষতিও হলো কিনা, তিনি কোনও অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত কিনা এটা দেখা উচিত। ব্যক্তিজীবন নয়, বিশেষ করে ব্যক্তিজীবন নিয়ে সমালোচনা করে কত নারীকে যে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় তা কি তারা ভেবে দেখেছেন?

আমি দেখিনি, শুধু শুনেছি যে, সাগর-রুনি হত্যা নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথাবার্তা লেখা হয়েছে অনেক পত্রিকায়। আমার কথা হচ্ছে, একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। সেটা কারা করেছে, আমাদের আলোচনা বা রিপোর্টিং তা নিয়ে হতে হবে। হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে হবে। আজ মেঘের মতো একটি অসহায় নিষ্পাপ শিশু তার জীবনের শুরুতেই সবচেয়ে মূল্যবান দুটি সম্পদ হারিয়ে ফেলেছে, আজ সে তার জন্মদিন উদযাপন করে মা-বাবাকে ছাড়া। তাই তার মা-বাবার হত্যাকারীদের খুঁজে বের করাটাই আমাদের দায়িত্ব। অন্য কিছু নয়।

আমরা যেন মেঘের জন্য ন্যায়বিচার এনে দিতে পারি। এ ব্যাপরে আইনগত দিকটি কতটা অগ্রসর হয়েছে জানি না। তবুও আমি কেন যেন আশাবাদী, সাগর-রুনি হত্যার বিচার হবে। এটা হতেই হবে। কারণ এটা হলে দল-মত-পেশা নির্বিশেষে সবার সামাজিক ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। হত্যার বিচার হলে নিহতের পরিবার স্বজনকে ফিরে পায় না। কিন্তু তাদের কাছে এটা একটা সান্তনা হয়ে থাকে। তাছাড়া সমাজে দৃষ্টান্ত তৈরি হয়। অপরাধীরা ভয় পায়।

সমাজের যে কোনও মানুষের হত্যার বিচার হওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধের সময় সংঘটিত নরহত্যা-ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্যও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে হবে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি জানি যে, সরকারও চান সাগর-রুনি হত্যার বিচার হোক। তবে যত দ্রুততার সঙ্গে এটা হবে ততই ভালো।

জনগণের কল্যাণ মূল উদ্দেশ্য হলে, ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনও ভেদাভেদ থাকতে পারে না। শিল্পী বা সাংবাদিক সমাজ, যারাই সাগর-রুনির হত্যার বিচার চাচ্ছেন তাদের মধ্যে কোনও বিভেদ থাকতে পারে না। সবাই তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় ঠিক থাকলে সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাবে।