কোন পথে বাংলাদেশ

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী
Published : 26 Jan 2019, 01:44 PM
Updated : 26 Jan 2019, 01:44 PM

সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভাবনীয় বিজয়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের আশাতীত কম আসন লাভ এবং আসনভিত্তিক বিজয়ী ও পরাজিতের ভোটের বিশাল ব্যবধান এই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। রাজনীতি সচেতন ও সমাজ ভাবনায় অভিজ্ঞ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন। সাধারণ মানুষও যার যার মতো করে এই প্রশ্ন উত্থাপন করছেন এবং এর উত্তর জানার চেষ্টা করছেন।

কোন পথে বাংলাদেশ?- এই প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার কারণ জানতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। গত কয়েক দশকের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করতে হবে। সে কাজ করতে পারেন রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা। আপাতত যে নির্বাচনকে ঘিরে এই প্রশ্নের নবতর উত্থান সে নির্বাচনকেই বরং অবলোকন করা যাক। তবে আগেই বলে রাখা ভালো, এই প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার কারণ উপলব্ধি করা সম্ভব হলেও উত্তর জানতে অপেক্ষা করতে হবে।

নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের বিশাল পরাজয় হয়েছে। এই পরাজয়ের কারণ খুঁজতে পারলেই বুঝতে পারা যাবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ব্যাপক বিজয় কেন। নির্বাচনে দেশের সাধারণ মানুষ ভোট দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে সরকার গঠন করতে একটি দল বা একটি জোটকে নিজেদের ক্ষমতা অর্পণ করেন। এই ক্ষমতা অর্পণের আগে ভোটাররা কিছু বিষয় বিবেচনায় নেন। যেমন- যাদের দায়িত্ব দেওয়া হবে তারা আসলেই দেশ পরিচালনায় যোগ্য কি না? তাদের অতীতের (যদি থাকে) সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা কী এবং সেই মেয়াদকালে জনসাধারণের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি কতটুকু।

এসব প্রশ্নের উত্তর মনে মনে খুঁজে নিয়ে ভবিষ্যতের দেশ পরিচালনার দায়ভার একটি পক্ষের হাতে তুলে দেন দেশের প্রকৃত মালিক তথা জনগণ। এখন দেখা যাক বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক অতীতে দেশ পরিচালনা এবং তাদের রাজনীতি বিষয়ে জন-অভিজ্ঞতা কী। সর্বশেষ বিএনপি-জামায়াত জোট ২০০১ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দেশব্যাপী বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা-নির্যাতন ও দেশছাড়া করার এক অমানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এসব নির্যাতনের সাথে ছিল ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগের মতো বর্বরতাও। রাষ্ট্র পরিচালনায় দুর্নীত, স্বজনপ্রীতি এবং ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা ও জঙ্গী পৃষ্ঠপোষকতার অভিজ্ঞতা এখনো জনমানস থেকে মুছে যায়নি।

২০০৮ সাল থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট দেশের বিরোধী দলের আসনে। নবম সংসদে তাদের কিছু অংশগ্রহণ থাকলেও দশম সংসদ নির্বাচনেই তারা অংশ নেয়নি। সে হিসেবে গত ১০ বছর ধরেই তারা সংসদের বাইরের বিরোধী দল। কিন্তু সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দল যে ভূমিকা রাখবে বলে মানুষ বিশ্বাস করে তার বিন্দুমাত্র তারা পূরণ করতে পেরেছি কি? এর উত্তর হলো- পারেনি। মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে সংশ্লিষ্ট দাবিগুলোর সাথে একাত্ম হয়ে গণআন্দোলনে নেতৃত্বে দেয়া এবং দাবি আদায়ের কোনো দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করতে পারেনি। উপরন্তু ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে লাগাতার অবরোধের ডাক দিয়ে তারা দেশ অচল করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। সে লক্ষ্য আদায় করতে জনগণকেই 'জিম্মি' হিসেবে নির্ধারণ করে তারা। শত শত জীবন্ত মানুষ দগ্ধ হয়ে নরক যন্ত্রণা ভোগ করে নিহত হয়, যা পুরো দেশের মানুষের মনে রাজনীতি সম্পর্কেই এক বিভীষিকাময় নারকীয় ধারণার জন্ম দেয়।

এরপরও বিরোধী দল হিসেবে গত চার বছরে তারা কোনও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং বিভিন্ন সময় ছাত্র-যুবকদের ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলনকেও ভুল পথে পরিচালিত করে সেসব আন্দোলনকে সরকার পতনের হাতিয়ার করতে চেয়েছিল। যাতে সেই সিঁড়ি বেয়ে নিজেরা ক্ষমতায় যেতে পারে। অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার-বয়সের মানুষের দাবির সাথে একাত্ম না হয়ে শুধুমাত্র লাভের গুড় তুলে ভক্ষণের মানসিকতা প্রদর্শন করেছেন। যেটা প্রকৃত বিরোধী দলের আন্দোলন প্রক্রিয়া তো নয়ই বরং কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়াই নয়।

এরকম একটি প্রেক্ষাপটকে হাজির রেখেই বারবার ঘোষিত 'আন্দোলন' গড়ে তুলতে না পারার চরম ব্যর্থতা মাথায় নিয়েই নির্বাচনে আসতে রাজি হয়ে গেল বিএনপি। এরমধ্যেও রাজনৈতিক দলের বৈধতা হারানো জামায়াতে ইসলামী রয়ে গেল বিএনপির সাথে। তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে ঘুর পথের সুযোগ সৃষ্টি করে দিল বিএনপি। ২০০৮ সালে য্দ্ধুাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার করে নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে ভয়ংকর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শেষ করে দণ্ড কার্যকর করেছে। এবং যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে দেশে একটি গণজাগরণও হয়ে গেছে। সেই যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী যারা কি না আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা থেকে একচুলও নড়েনি তাদের নিয়েই বিএনপি গড়লো নতুন নির্বাচনী জোট ঐক্যফ্রন্ট।

গত ১০ বছর ধরেই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে বিএনপি জোট দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে রাজি হয়ে গেল প্রধান নেত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই। যখন দলটির অন্যতম প্রধান নেতা এবং দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের কাছে ভবিষ্যতের কাণ্ডারী হিসেবে পরিচিত তারেক রহমান বিদেশে এবং দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত। বিএনপি জোট নির্বাচনের আগে জানাতেই পারলো না ভোটে জয়ী হলে কে হবেন তাদের সংসদীয় দলের নেতা। দলের ভিতর বিএনপি নেতাদের বিরোধ এতটাই স্পষ্ট ছিল যে, ভোটের আগেই বিভক্তির সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের মধ্যে দিয়ে সারাদেশের ভোটারদের কাছে পৌঁছে গেছে। তদুপরি আওয়ামী লীগের ভবিষ্যতমুখী সমৃদ্ধির অভিযাত্রা ঘোষণা করা ইশতেহারের বিপরীতে ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির ইশতেহার নিতান্তই শিশুসুলভ মনে হয়েছে ভোটারদের কাছে।

এরকম পরিস্থিতিতে বিএনপি জোট যখন তাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করলো তা দেখেও হতাশ দেশের মানুষ। প্রার্থী নিয়ে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ এবং এ সংক্রান্ত ঘটনাপ্রবাহও জাতি প্রত্যক্ষ করলো দারুণ লজ্জায়। প্রতিটি আসনে গড়ে তিনজন করে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হলো। যাদের মধ্যে প্রায় প্রতি আসনে একজন করে মামলার আসামি। কোথাও কোথাও দুজনই মামলার আসমি। বাকি যে একজন থাকেন তিনি আওয়ামী প্রার্থীর সাথে লড়াই করার সামর্থ্য কতটা রাখেন সেটা বিএনপি নেতারাও ভালো করে জানতেন। বিএনপি প্রার্থীদের মধ্যে যারা মামলার আসামি ছিলেন তারা প্রধানত ঋণ খেলাপি এবং নাশকতা মামলার আসামী। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষমতায় থাকাকালে এবং পরে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার ঘটনা সত্য বলেই তারা এখন কারাগারে। আর দেশজুড়ে ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত নাশকতার প্রচুর ঘটনা ঘটেছে বলেই অনেকে নাশকতা মামলার আসামী। এটাও সত্যি যে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে এমন অনেক নাশকতার মামলা হয়েছে যা ভিত্তিহীন। মূলত আগের মামলাগুলোতে সম্পৃক্ততাই এসব নেতাকর্মীদের নতুন মামলায় অর্ন্তভুক্তির সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের বাছাই যখন শেষ হলো তখন বিএনপি জোটের প্রার্থী তালিকার দিকে তাকালে দেখা গেল- ঋণ খেলাপি ও নাশকতার মামলার আসামি অর্ধেক নেতাই নির্বাচনের অযোগ্য। বাকি ছাড়া হেভিওয়েট প্রার্থী মাঠে রইলেন তাদের মধ্যে অর্ধেকই গত ১০ বছর ধরে ধীরে ধীরে জনবিচ্ছিন্ন এবং রাজনীতির প্রতিই আকর্ষণহীন অবস্থানে। অর্থাৎ নির্বাচনের মাঠে নামার আগেই রাজনীতি অভিজ্ঞ মানুষের মনে ধারণার জন্ম নিল যে বিএনপি জোট ৭৫-৮০ আসন পেতে পারেন। অথবা এই সংখ্যক আসনে জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। ভোটাররা যখন এই ধারণা আগেই পেয়ে গেল এবং ভোট প্রাপ্তির মানদণ্ডে এতসব ব্যর্থতা সম্বল করে বিএনপি মাঠে নামল ততক্ষণে তাদের পরাজয় প্রায় সুনিশ্চিত হয়ে গেছে।

কিন্তু তবুও বিএনপি জোট শেষ পর্যন্ত যে নির্বাচনের লড়াইয়ে থাকলো সেজন্য অবশ্যই তারা ধন্যবাদ পেতে পারে। বিএনপির যে অংশটি দলে সুষ্পষ্ট বিভক্তির পরও ভোটের প্রশ্নে অবিচল ছিলেন এবং দলকে ভোটের দিকে নিয়ে এসেছেন তারা মূলত গণতন্ত্রের জন্যই নিবেদিত প্রাণ এমনটাই বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু প্রচারণা শুরুর পর থেকে বিএনপির সেই অর্ধেক সংখ্যক অনভিজ্ঞ, ভোটের মাঠে আনকোড়া এবং 'অগতির গতি' প্রার্থীরা মাঠেই ছিলেন না। প্রচারণা বলতে তাদের ছিল শুধু মাঝে মাঝে ভোটারদের কাছে গিয়ে ভোট প্রার্থনা। সেটাও অনেক ক্ষেত্রে হয়েছে একক নির্বাচনী প্রচারণা। এমন প্রার্থীদের সঙ্গে ছিল না দল, দলীয় নেতাকর্মী এমনকি সাধারণ সমর্থকরাও। আর রাজনীতির শক্তিময় মাঠে এমন দুর্বল প্রার্থী কী করে ভোটের জোয়ার সৃষ্টি করবেন। বাস্তবেই তারা ভোটের বিক্ষুব্ধ সাগরে নুড়ি পাথরও ছুড়তে পারেননি।

রাজনীতি অভিজ্ঞ যে প্রায় দেড়শতাধিক নেতা ভোটের মাঠে সক্রিয় ছিলেন তারাও প্রচার-প্রচারণায় অর্থ ব্যয়কে বোকামি ভেবেই এগুচ্ছিলেন ৩০ ডিসেম্বরে দিকে। সঙ্গে যোগ হয়েছিল প্রতিপক্ষের কৌশলে আরো গুটিয়ে যাওয়া। ফলে শেষ সপ্তাহে আওয়ামী জোটের প্রার্থীরা যখন মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বিএনপির প্রার্থীরা তখন বেশিরভাগই ঘরে বসা। তাহলে কেমন দিন শুরু হয়েছিল ভোটের সকালে তাতো অনুমান করাই যায় এখন।

ভোট শুরুর সকালে দেখা গেল অধিকাংশ ভোট কেন্দ্রেই বিএনপির এজেন্ট অনুপস্থিত। মাঠের খবর হলো হয় বিএনপির প্রার্থীরা এজেন্ট নিয়োগ দেননি অথবা নিয়োগপ্রাপ্ত এজেন্টরা ভয়-ভীতি ও ভবিষ্যত বিবেচনায় আর কেন্দ্রেই যাননি। যেসব কেন্দ্রে এজেন্টরা সারাদিন ছিলেন সেখানে ভোট অনেকটাই শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে হয়েছে।

এবার আসা যাক ভোটের চিত্রে। বিএনপির প্রার্থীদের প্রায় সবাই আগে থেকে হাল ছেড়ে দেওয়ায় ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই ভোট অর্ধেক 'শান্তিপূর্ণ' হয়ে গেছে। কিন্তু যেসব জায়গায় বিএনপি-জামায়াত জোট মাঠ ছাড়েনি? সেসব আসনের কয়েকটিতে সহিংসতার চিত্রই প্রমাণ করে জামায়াত এখনো বিএনপিকে কতটা পরিচালিত করে। সারাদেশে কমপক্ষে ১৭জন নিহত হয়েছেন। যাদের অধিকাংশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। শুধু সংখ্যা বিবেচ্য নয়, একটি প্রাণও মহামূল্যবান। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও নির্বাচনী সহিংসতায় ছিলেন। বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদেরও প্রাণ ঝরেছে। এই বাস্তবতা মেনেই প্রতিটি নির্বাচনী হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে ভবিষ্যতে তা অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে। থাকবে গণতন্ত্রের গায়ে কালো দাগ হয়ে।

পাশাপাশি বিএনপি জোটের যে অভিযোগ, তা হলো ২০ শতাংশ কেন্দ্রে ভোটে কারচুপি ও জাল ভোট হয়েছে। এবং আগের রাতেই বাক্স ভর্তি করে ফেলা হয়েছে সিল মেরে। বিএনপির অভিযোগ অনুসারে প্রতিটি কেন্দ্রে এরকমভাবে গড়ে পাঁচশ করে ভোট দেওয়া হয়েছে। এর একটি ঘটনাও যদি সত্য হয় অবশ্যই তার তদন্ত ও বিচার হওয়া প্রয়োজন। এই দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের। তা না হলে গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্থ হবে। গণতন্ত্রের অভিযাত্রা সফল করতে হলে নির্বাচনী অনিয়ম, জাল ভোট, কেন্দ্র দখল, ভোটকক্ষে ঢুকে জোর পূর্বক ভোট দিতে বাধ্য করা এবং সহিংসতার প্রতিটি ঘটনার বিচার হতে হবে।

এখন আসা যাক, ভোটের অঙ্কে। বিএনপির অভিযোগ মতে প্রতি কেন্দ্রে যদি ৫০০টি করে সিল মারা ব্যালট ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, সেটা যদি যুক্তির খাতিরে মেনেও নিই তাহলে গড়ে একশ থেকে দেড়শ কেন্দ্রে এরকম জাল ভোটের পরিমাণ হয় ৫০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার। কিন্তু আওয়ামী লীগ জোটের প্রার্থীর সাথে যদি বিএনপি জোটের প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান দেখি। প্রায় ক্ষেত্রে এই ব্যবধান দেড় থেকে দুই লাখের বেশি। তাহলেও অঙ্কের হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা এগিয়েই থাকেন। ভোটের মাঠে যেসব বিষয় প্রভাব হলে উপরের আলোচনায় আমরা দেখার চেষ্টা করেছি তার কোনোটাই বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে ছিল না। তাই বিএনপির সমর্থকরাও ভোটের দিন দুপুরের পর আর কেন্দ্রমুখো হননি। একারণেই ভোটে জয়ী ও পরাজিত প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান এত বিশাল। তার প্রমাণ স্বরূপ দৃষ্টান্ত হতে পারে আসাদুজ্জামান নূর এবং মাশরাফি বিন মর্তুজার আসনের ফল। এ দুটি আসনে ভোট শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে বলে সবাই স্বীকার করেছেন। এদের মধ্যে আসাদুজ্জামান নূরের সাথে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান প্রাায় এক লাখ এবং মাশরাফির ক্ষেত্রে তা প্রায় আড়াই লাখ।

ভোটের হিসেবে প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বিএনপির পরাজয়ের কারণ তো বুঝতে পারা গেল। এখন বিরোধী দলবিহীন দেশের রাজনীতি কেমন হবে। এবং এত বিশাল বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগ জোট কিভাবে দেশ পরিচালনা করবে সেটাই জনমনে প্রশ্ন। গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী বিরোধী দল থাকার প্রয়োজনীয়তা সকলেই জানে। সেই বিরোধী দল গত ১০ বছর ধরেই অনুপস্থিত। ২০১৯ সাল থেকে তা বাস্তবিক অর্থেই অনুপস্থিত থাকবে।

সেক্ষেত্রে একমাত্র এবং একমাত্র উপায় হতে পারে গণতন্ত্র এবং সুশাসন। কেউ যদি মনে করেন উন্নয়নের কাছে এই ভোটে গণতন্ত্র পরাজিত হয়েছে। তাহলে তা হবে গণতন্ত্রের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি এবং জাতির ভবিষ্যতের জন্য বিপদ সংকেত। সুশাসন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার মাধ্যমেই শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বিরোধী দলের অভাব পূরণ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি গতানুগতিক ধারার রাজনৈতিক রেষারেষি ও প্রতিহিংসা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিজয়ের প্রথম প্রহরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো ধরণের আনন্দ প্রকাশ না করে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়ার যে আহ্বান জানিয়েছে তা শুভ ইঙ্গিতবাহী।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে অসাম্প্রদায়িক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের যে ঘোষণা ইশতেহারে জানিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়েছে এরকম নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের পথ ধরে তা কিভাবে অর্জিত হবে। তখন এটাও মনে রাখতে হবে যে রাজনীতি কোনও শুদ্ধাচারে ভরা শান্তি নিকেতন নয়। বরং এটি একটি শ্বাপদ সংকুল স্থান। এখানে কখনো কখনো শক্তির প্রদর্শন হয়। তবে সেটা যদি ভালো কিছুর উদ্দেশ্যে হয় তাহলে জনগণ তা মেনে নেবে। তাই এ কথা বলাই যায়, বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে একটি অসাম্প্রদায়িক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হয়ে ওঠার পথেই হাঁটতে চায়। বাংলাদেশ এখন সেই পথেই। একটি নির্বাচন এক মেয়াদে একজন সাধারণ রাজনীতিবিদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হয়তো, কিন্তু একজন রাষ্ট্রনায়ক যিনি দেশকে পথ দেখাতে চান তার রাজনৈতিক নীতি-আর্দশের সফলতা-ব্যর্থতার সামগ্রিক বিচার করবে ইতিহাস। তাই এই পথে বাংলাদেশের এবারের যাত্রা সফল হবে কি না সে বিচারের ভার আপাতত দেয়া থাকলো ভাবিকালের হাতে।