বিতর্কিত নেতা ও জেনারেল এরশাদের এপিঠ-ওপিঠ

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 23 Jan 2019, 03:38 PM
Updated : 23 Jan 2019, 03:38 PM
সারাজীবনই তার বিরোধিতা করেছি। অমূলক কোনও কারণে তা  করিনি। বরং বলতে গেলে করার কারণগুলোই যৌক্তিক। আমাদের যৌবনকে তিনি প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সকালে এক কথা, বিকেলে আরেক কথা। একটা দেশের প্রেসিডেন্ট অথচ তার কথায় কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নাই, এটা কি মানা যায়? যেমন ধরুন, নিজের জীবন নিয়েও তিনি হাসিখেলা খেলতেন। রূপকথার গল্পে আমরা পড়েছি রাজা আটকুঁড়ে হলে নাকি অমঙ্গল হয়। এগুলো ধারণা মাত্র। আগের দিনে সংস্কার আর মানুষের বিশ্বাসই ছিল পুঁজি। কিন্তু ইনি এসেছিলেন আশির দশকে। দুনিয়া তখন অগ্রগামী। পাশের দেশ গণতন্ত্রের সুবাতাস পায় আর সীমান্তের এধারে আমাদের মাথার ওপর চেপে বসে এক পাথর। সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিনোদন সবকিছু তার কব্জা করতে হবে। নিরীহ প্রেমময় মাধ্যম কবিতাও বাদ গেল না। সরকারী টাকায় 'কনক প্রদীপ জ্বালো" নামের এক ঢাউস সুন্দর কবিতার বই লিখে কলকাতার দাদাদের ধরে এনে কবি বনে যাবার কি চেষ্টা! দেশের আমলা কবি, সরকারী কবি, স্তাবক কবিরাও জুটে গেলেন। বঙ্গভবনে কবিতা পাঠের লোভে তারাও দাঁড়িয়ে গেলেন লাইনে।
আগে এরশাদ সাহেবের ব্যক্তিজীবনের সেরা মিথ্যাটা বলি। দেশের মানুষ বলা নাই কওয়া নাই হঠাৎ কোনও নিশানা চিহ্ন ছাড়াই দেখলেন রাণীমাতা পুত্র সন্তানের জননী হয়ে গেলেন। পরে সেই পুত্র কোথায় বা কী করে আর কেউ ভালোভাবে জানতে পারলোনা। সেই  প্রেসিডেন্ট এখনও রাজনীতি করেন। আর আমাদের দেশের রাজনীতি মানেই তো বংশ পরম্পরা । রক্তের উত্তরাধিকার।
শেখ হাসিনা যেমন রক্ত ও আদর্শের ধারক হয়ে মন জয় করেছেন তেমনি উল্টোদিক থেকে পিতার দল ডুবিয়েছে মাতার আস্কারা পাওয়া বড় ছেলে তারেক। অথচ এরশাদ সাহেবের পুত্রের খবর নাই। আসল পুত্র হলে এতোদিনে সেই হতো জাতীয় পার্টির কান্ডারী।
বলছিলাম তার কবিতার কথা। কখন লেখেন, কোথায় লেখেন, কেন লেখেন- কেউ দেখেনি, জানেও না। একে রাষ্ট্রপতি তায় আবার জেনারেল ফলে কে না লিখে দিয়ে পারে? নিজে যদি এক স্তবক লিখেন তো বাকীরা লেখে হাজার লাইন। রাজনীতিতে ছাপোষা বিরোধী দলও দেখলাম প্রথমবার। বলা নাও কওয়া নাই একদা জাসদ নেতা তখনও বয়স এত হয়নি সেই আ স ম রব চলে এলেন সম্মিলিত বিরোধী দল, যার পোশাকী নাম ছিলো কপ বা কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি, তার নাম  ভূমিকায়। এ লোক তখন জেনারেলের তাঁবেদার।
তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া মানুষ। অথচ তিনিই বলতে শুরু করেছিলেন এই প্রেসিডেন্টও নাকি মুক্তিযোদ্ধা। কোনও সেক্টর বা কোনও যুদ্ধের নামগন্ধ নাই। আবার দেখুন গদি হারানোর পর রব কোনওদিন এরশাদকে মুক্তিযোদ্ধাও বলেন না, কোনও সম্মান করেন না।
এখন যে বিএনপি নেতা মওদুদ কে দেখছেন ইনি ছিলেন তার তল্পিবাহক। রাতদিন তার ভজনা আর বন্দনা ছাড়া আর কিছু করতেন না। কিন্তু যেই কিনা গদি গেল তো, আম-ছালা হারানোর ভয়ে চলে গেলেন বিএনপিতে। এই প্রেসিডেন্ট দেশের রাজনীতির বারোটা তো বাজালেনই, তার আমলে বাকরুদ্ধ ছিল মিডিয়া।
আমরা খবরের কাগজ বা টিভিতে কাজ করার এমন সুযোগ দূরে থাকুক ন্যূনতম আশাও করতাম না। কারণ মিডিয়াই খোলার অনুমতি ছিলনা তখন। ফলে ছাত্র-যুবক আর সাধারণ মানুষের আন্দোলনের মুখে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তারপর আর যাই হোক বা না হোক হুড়মুড় করে মিডিয়ার দরজা খুলতে শুরু করলো। মুক্ত হতে শুরু করলো মানুষের জীবন।
মানুষটির ভালো দিক নাই? আছে। না থাকলে  কিভাবে পতনের পরপর জেলে থেকেও ভোটে জেতেন? রংপুর এলাকায় তাকে হারানোর মানুষ পয়দা হয়নি। যা প্রমাণ করে এলাকায় তিনি তুমুল জনপ্রিয়। প্রতি নির্বাচনে জিতে রেকর্ড করা জেনারেলের আরেক গুণ। কেউ তাকে বধ করতে পারেনি। সেটা অবশ্য আমরা চাইনা। দেশে খুনোখুনি আর হত্যার নায়ক ছিলেন আরেক জেনারেল । জিয়াউর রহমান গদি ঠিক রাখতে তিনি যে কতগুলো সামরিক বিচার আর হত্যার জন্ম দিয়েছিলেন গুণে শেষ করা যাবেনা। ইনিও করতেন। তবে কৌশলে।
মনে আছে ১৯৯৬ সালে ভোটে জিতে সংসদে দাঁড়িয়ে সগর্বে বলেছিলেন তাকে কোনদিন কোনও সামরিক বাহিনীর মানুষ মারবে না। এটা তিনি নিশ্চিত। এবং তা সত্য। এই নিয়ন্ত্রণ বা তার প্রতি তাদের এই আনুগত্য আছে। ভদ্রলোকের আরেক গুণ সুন্দর করে কথা বলা। সামরিক বাহিনী থেকে আসা নেতারা তার মতো সাধারণত ভালো করে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না। বিশেষত রাজনৈতিক ভাষণ দেওয়া তাদের কাজ না। তবে ইনি তা ভালোই শিখে গেছেন।
সবকিছু ছাপিয়ে তার যে গুণ বা দোষ তাকে বিখ্যাত করে রেখেছে তার নাম প্রেম অথবা সম্পর্ক। বাংলাদেশে এমন প্রেমিক, এবং স্পর্শকাতর এক্স প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয় কেউ নাই। তিনি নিজেই বলেন, তিনি যান না নারীরাই তার কাছে আসে। কথাটা মিথ্যা না।
কবিকন্যা বিদিশা থেকে মেরি মরিয়ম, গায়িকা-নায়িকা এমন কি শেষ বয়সে পাশে ভিড় করা রমণীরা বারবার জানিয়ে দিয়েছে তাকে তাদের কতটা পছন্দ। এর পেছনে নিশ্চয়ই নানাবিধ কারণ আছে। নারী নই বলে আমি তা বুঝিনা।
রাজনীতিতে টিকে থাকার আরেকটা কারণ হলো তার চতুরতা। সবাই যা বলে বলুক তিনি খুব ভালো বোঝেন, কখন কোথায় থাকতে হবে। এবারের আগের বারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা ও দেশকে বিপদে ফেলার জন্য বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত মিলে সেকি ধুন্দুমার কাণ্ড বাঁধিয়েছিল। মতিঝিল ও শাপলা চত্বরের ঘটনার রাতে  আমরা এমনও ভেবেছিলাম সকালে উঠে দেখবো সরকার নাই। নৈরাজ্য আর অরাজকতার সেই সময়ে তার ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। তবে নির্বাচনে যাবো না যাবো না করে হাসপাতালে গিয়ে শুয়ে পড়ে লোক হাসালেও তিনি এবং তার দল দেশকে সম্ভাব্য বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিল। অতি চালাকির কারণে বৌ সম্মানিত হলেও তিনি তার পাওনা আদায় করে বিশেষ দূত হতে ছাড়েননি।
আর একটা কথা- দেশে যারা মনে করেন কবিতা লেখা কেবল নারীর মনভোলানো কাজ। বা কবি ও কবিতার শক্তি শুধু প্রেম জাগানো তারা তার আমল জানলেই বুঝবেন কবিতা কত শক্তিশালী আর সাহসী ভূমিকা রাখতে পারে। তার আমলে কবিতা পরিষদ হয়ে উঠেছিল দেশজাগানো এক প্রাণশক্তি। প্রয়াত শামসুর রাহমান থেকে বড় বড় কবিদের আমরা দেখেছি রাজপথে নেমে আসতে। তিনি যত শক্ত হচ্ছিলেন, ততো কবিতা পাচ্ছিল প্রাণশক্তি। এত ভালো সময় আর আসেনি বাংলা কবিতার। আমার মতো তরুণ কবিকেও তখন কবিতা পড়ে ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। তার পতনের পর সে কবিতা জগতের বারোটা বাজিয়ে দিতে চেয়েছিল খালেদা জিয়ার দল। খালেদা জিয়া ও তার দলের সাথে এই প্রেসিডেন্ট এবং তার দলের মূল তফাৎ প্রথমটি মন-মেজাজে আর অন্তরে সাম্প্রদায়িকতা পোষার ক্ষেত্রে। এরশাদ নিজে সবসময় ছিলেন অসাম্প্রদায়িক তবে সুযোগসন্ধানী আর লোভী বলে ধর্মের এমন সব ইস্তেমাল করেছেন যা এখনো আমাদের গলার কাঁটা। দেশের মাথায় রাষ্টধর্ম চাপিয়ে তিনি যা করে গেছেন তার নিরসন অসম্ভব।
তেমনি এসমাজ ও দেশের কলঙ্ক তার পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। বলা কওয়া ছাড়া হিন্দুদের মূর্তি-মন্দির ভাঙার এক জান্তব উল্লাস দেখেছিলাম এক রাতে। কোনও প্রেক্ষাপট ছাড়াই এমন দাঙ্গা বা উত্তেজনার কারণ ছিল গদি বাঁচানো। অথচ এই ঘটনাই তার পতন ডেকে আনে তাড়াতাড়ি।
কেন তাকে নিয়ে লিখছি? সবাই জানেন তার এখন বয়স কতো। সামাজিক মিডিয়ায় মাঝে মাঝে ভুলভাল ট্রলে তার চলে যাবার খবরও আসে দু:খজনকভাবে। খবরে দেখলাম তিনি গুরুতর অসুস্থ। আমরা সাধারণত মৃত্যুর পর কাউকে নিয়ে লিখি। তাই মনে হলো আগেই লিখে রাখি ভালো-মন্দ মিলিয়ে সকলই। এই মানুষটির আর দুটি গুণের কথা বলে শেষ করবো।
নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন- ঘোরতর বিরোধিতা করতেন এমনকি বিরুদ্ধে কবিতা লিখতেন জেনেও তার কন্যা মৃত্তিকা গুণকে সেনাকুঞ্জের এক অনুষ্ঠানে এরশাদ কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলেন তিনি কতটা তার বাবার ভক্ত।
আজীবনই এরশাদ নেতা থেকে গেলেন। থাকলেন মিডিয়ার পাদপ্রদীপের আলোয়। তার মতো কথায় কথায় আলোড়ন তোলা নেগেটিভ-পজেটিভে মিডিয়া মাতিয়ে রাখা বিনোদনে ভরপুর কেউ নাই রাজনীতিতে।
তার সুস্থতা কামনা করি। এটা মানতেই হবে জেনারেল এরশাদ একাই একশ। 'একশতে এক'- একজন নেতা এবং রাজনীতিবিদ।