‘আমার গ্রাম – আমার শহর’: সে শহর কেমন শহর?

হেলাল হোসেন ঢালী
Published : 22 Jan 2019, 01:23 PM
Updated : 22 Jan 2019, 01:23 PM

আমি গ্রামের ছেলে। গ্রামেই বড় হয়েছি। শিক্ষা জীবনের মাধ্যমিক স্তর গ্রামে থেকেই শেষ করেছি। আমার মা এখনো গ্রামে থাকেন, তাই গ্রাম আমার কাছে মায়েরই মতো। শিক্ষা ছুটিতে কানাডায় আসার আগে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময়ে যখনই বড় কোনও ছুটি পেয়েছি তখনই গ্রামে ছুটে গিয়েছি। কানাডায় আসার পরও মাঝে মায়ের কাছে গিয়ে দশদিন থেকে এসেছি। এ কারণে গ্রাম নিয়ে সরকারের কোন পরিকল্পনার কথা যখন শুনি তখন আলোড়িত হই।

আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে যখন গ্রামের উন্নয়ন প্রসঙ্গে দেখলাম, এবং কোন একটি বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী যখন গ্রাম উন্নয়নের ওপর বেশ গুরুত্ব দিলেন, তখন গ্রামের সন্তান হিসেবে খুশিতে আত্মহারা হয়েছি। ইশতেহারে এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া, সর্বত্র তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা, পাকা রাস্তা তৈরির মাধ্যমে গ্রামকে শহরের সাথে সংযুক্ত করা এবং সুপেয় পানি এবং উন্নতমানের পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। এছাড়াও ছেলেমেয়েদের উন্নত পরিবেশে লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি করা ও কর্মসংস্থানের জন্য জেলা/উপজেলায় কলকারখানা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সর্বোপরি সুস্থ বিনোদন এবং খেলাধুলার জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলারও অঙ্গীকার করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে সরকার গঠন করেছে। ইশতেহারের আলোকে উন্নয়ন ক্রমান্বয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা শুরু করবে। এশিয়া, ইউরোপ, ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ এবং শিক্ষা, উন্নয়ন ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক আমার পড়াশোনা, গবেষণা ও অভিজ্ঞতার আলোকে আমার গ্রামে আমি কেমন উন্নয়ন চাই, এ লেখায় তার একটা সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরতে চাই।
আমি যে গ্রামে বড় হয়েছি, যে গ্রামের পরিবর্তনগুলো আমি প্রতিনিয়ত দেখতে পাই, যে গ্রামের আনাচে কানাচে আমার নখদর্পণে আমার পুরো আলোচনা সেই গ্রামের আলোকেই করতে চাই।

গবেষণার সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার আরো প্রায় শ'খানেক গ্রামে আমি গিয়েছি, থেকেছি, সেখানের চিত্র বোঝার চেষ্টা করেছি। সুযোগ-সুবিধা ও সংস্কৃতির বিবেচনায় গ্রামভেদে কিছুটা ভিন্ন হলেও, মোটাদাগে তেমন কোনও পার্থক্য আছে বলে আমার মনে হয় না। তাই আমার এই আলোচনা আমার গ্রামের আলোকে হলেও তা বাংলাদেশের যেকোন গ্রামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলেই আমার বিশ্বাস।
গ্রাম উন্নয়ন প্রসঙ্গে উপর্যুক্ত যেসব সুবিধাদি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে তা বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের যে ধারণাটি প্রভাব বিস্তার করছে তার বিবেচনায় অত্যন্ত আদর্শ একটি ধারণা। এবং এই উন্নয়নই এখন আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের কাম্য। কিন্তু এই ধারার উন্নয়নে আমরা কী কী হারাতে পারি তার একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা প্রয়োজন। গ্রামের উন্নয়ন পরিকল্পনায় সম্ভাব্য এই ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনায় না থাকলে গ্রামগুলোও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এবং ইতিবাচক লক্ষ্যে করা উন্নয়ন শুধু নিষ্ফলই নয়, ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারক, পরিকল্পক, এবং সচেতন নাগরিকদের জন্য আমার বক্তব্য তুলে ধরছি।

প্রথমে আসি উন্নয়নের সাথে রাস্তার যে ধারণা, সেই প্রসঙ্গে। উন্নয়নের একটা অন্যতম দৃশ্যমান দিক হলো রাস্তাঘাট, সেতু ইত্যাদি। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই গত এক দশকে অসংখ্য মাটির রাস্তা তৈরি হয়েছে, অনেক রাস্তা পাকা করা হয়েছে। কিন্তু রাস্তা নির্মাণে অত্যাধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে গ্রামে যে ছোট ছোট খাল ও নালা ছিল তার দিকে নজর দেওয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় লোকজন খালের জায়গা দখল করে মাটি ভরাট করে নিজেদের জায়গার সাথে মিলিয়ে নিয়েছে। এ কাজ শুধু গ্রামের প্রভাবশালীরাই করেছে, তা নয়। যাদেরই জায়গার পাশ দিয়ে খাল ছিল, তারাই এ কাজ করেছে। অথচ এই খালগুলোই ছিল এক সময়ের গ্রামের প্রাণ। এখনো সুষ্ঠু পানিপ্রবাহের জন্য এবং গাছ-পালা ফসলাদির বেঁচে থাকার জন্য এই খাল ও নালা গুলো বাঁচিয়ে রাখা জরুরী।

আমি ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে দেখেছি ওইসব দেশের লোকজন এখনও কীভাবে খালগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে। খালগুলো শুধু রেখেই দেয়নি, নিয়মিত পরিচর্যা করছে। রাস্তার মতো রাস্তা চলে গেছে, খালগুলো বয়ে চলেছে খালের মতো। গ্রাম উন্নয়ন পরিকল্পনায় এই খালগুলো উদ্ধার এবং পরিচর্যার বিষয়গুলো রাখা জরুরি।

ইশতেহারে সুস্থ বিনোদন ও খেলাধুলার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে থানায় থানায় স্টেডিয়াম নির্মাণের ঘোষণার কথা আমরা জানি। থানায় থানায় একটা করে স্টেডিয়াম নির্মাণ করলেও কী গ্রামের ছেলেমেয়েদের সুস্থ বিনোদন ও খেলাধুলার সুযোগ নিশ্চিত করা যাবে? গ্রামের ছেলেমেয়েদের সুস্থ বিনোদন ও খেলাধুলার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য দরকার পাড়ায়-মহল্লায় খেলাধুলার জায়গার ব্যবস্থা করা। আমার শৈশব ও কৈশোরে আমি দেখেছি আমাদের বাড়ির চারপাশে কতো খোলা মাঠ। প্রত্যেকটি মাঠেই ছেলে মেয়েরা দাড়িয়াবান্ধা, বউচি, ফুটবল, ক্রিকেট খেলতো। এখন সেসব মাঠের প্রায় সবগুলোই বেদখল হয়ে আছে। আমাদের বাড়ির থেকে কয়েক পা দূরেই ছিল বিশাল এক মাঠ। পুরোটাই সরকারের খাস জমি। সেখানে এক সময় ঘোড়াদৌড় হতো বলে শুনেছি। এখন সেই মাঠের ভেতর দিয়ে যাওয়া ছোট একটা রাস্তা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। পুরো মাঠটি মাঠের আশপাশের জমির মালিকেরা দখল করে নিয়েছে। ছেলে-মেয়েরা হারিয়েছে তাদের খেলার জায়গাটুকু। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামেই এরকম হাজারো মাঠ হারিয়ে গেছে স্থানীয় ভূমিদস্যুদের লোভের কবলে। গ্রাম উন্নয়ন পরিকল্পনায় এই মাঠগুলো উদ্ধারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া অত্যন্ত জরুরী। অন্যথায় খেলাধুলার জায়গা সংকটে গ্রামের ছেলেমেয়েরাও মাদকাসক্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

লেখাপড়ার সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে এখন প্রায় প্রতিটি গ্রামেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু ছেলে মেয়েরা যে পাঠ্য-পুস্তক পড়ছে তাতে গ্রামের প্রতিচ্ছবি নেই বললেই চলে। যতটুকুও আছে তা যথাযথ নয়। এতে করে গ্রামীণ যেসকল প্রতিষ্ঠান সক্রিয় ছিল যেমন: পারস্পরিক সৌহার্দ্যবোধ, মায়া মমতা এ বিষয়গুলো হারিয়ে যাচ্ছে। নাগরিক হিসেবে একজনের দায়িত্ব কি সে বিষয়েও সম্যক ধারণা সংক্রান্ত পাঠ থাকা জরুরী।

গ্রামের আরেকটি সংস্কৃতির দিকেও নজর দেয়া জরুরী। অনেকেই অবৈধভাবে টাকা পয়সা উপার্জন করে এলাকার মসজিদ মাদ্রাসায় দান করে গ্রামের একজন সম্মানিত ব্যক্তি হওয়ার চেষ্টা করে। এতে গ্রামের ছেলেমেয়েরা ও মানুষজন শিখছে – লেখাপড়া করা জরুরী নয়, যেকোনও উপায়ে টাকা-পয়সা উপার্জন করে দান খয়রাত করলেই মানুষ বাহবা দেয়। এতে করে একদিকে দুর্নীতি ও ঋণ খেলাপে উৎসাহিত হতে পারে এবং গ্রামের সৎ মানুষজন ও ছেলে মেয়েরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদ মাদ্রাসা নির্মাণে সরকারকেই ভূমিকা পালন করতে হবে। যদি কোনও ব্যক্তি এ ব্যাপারে অবদান রাখতে চায় তা সরকারের মাধ্যমেই করতে হবে। তাতে তার আয়-ব্যয়ের একটা হিসাব সরকারের কাছে থাকবে এবং অবৈধ পথে উপার্জনকারীর উল্লম্ফনের সুযোগ কমে আসবে।

বর্তমান সরকার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া এবং তথ্য প্রযুক্তি সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে একটা বিপ্লব ঘটিয়েছে। গ্রামে বসেও এখন মানুষ বিশ্বের খোঁজখবর নিমিষেই নিতে পারছে। মুহূর্তের মধ্যেই সারা বিশ্বের যেকোনও প্রান্তের সাথে সংযুক্ত হতে পারছে। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির এই অবাধ সুযোগ গ্রামের তরুণসমাজ কতোটা ইতিবাচক কাজে লাগাতে পারছে? এর ইতিবাচক ব্যবহারের দিকগুলো সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকায় অনেকেই শুধু গান আর ভিডিও দেখার কাজে ব্যবহার করছে। অনেক ক্ষেত্রেই আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে অলীক কিছুকেই পশ্চিমা বিশ্বের বাস্তব রূপ হিসেবে ধরে নিয়ে সেগুলো অনুকরণ করার চেষ্টা করছে। এতে করে নানারকম অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে। সুখি হওয়ার সব উপকরণ নিজের আশপাশে থাকার পরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও স্যাটেলাইট চ্যানেলের জৌলুস জীবনকে আদর্শ ধরে নিয়ে নিজেদের বঞ্চিত ভাবছে, অসুখি ভাবছে। অনেকে নারী নির্যাতনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাই আগামী দিনগুলোতে সরকারের উচিত এর ইতিবাচক দিক ও ব্যবহার কী কী তা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া। এবং এটাও সবাইকে বোঝানো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং স্যাটেলাইট চ্যানেলে আমরা যা দেখি তা মানুষের আসল জীবন যাপন নয়, আদর্শ জীবন যাপন নয়।

এটাও বোঝাতে হবে ইন্টারনেটের সব তথ্যই সত্য নয়। অর্থাৎ বিশাল এই অনলাইন জগতের সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ যাতে সবাই বুঝতে পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।
শেষ করবো গ্রামে গ্রামে কল-কারখানা নির্মাণ এবং পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার কথা দিয়ে। এটা হবে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছড়িয়ে দেয়ার মতো উদ্যোগ। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন বিষাক্ত উন্নয়ন ছড়িয়ে না পড়ে। কেননা দেশের কলকারখানাগুলো যেভাবে নদী-নালা, খালবিল, বায়ু সহ যেভাবে পরিবেশ দূষণ করছে, গ্রামে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত কলকারখানাগুলোও যদি একই ধারায় গড়ে ওঠে, তাহলে উন্নয়ন হবে ঠিকই কিন্তু এক সময় আসবে সেই উন্নয়ন চালিয়ে নেয়ার এবং ভোগ করার লোক থাকবে না। সবাই পরিবেশ দূষণের প্রভাবে নানা রোগ-শোকে মারা পড়বে।

তাই গ্রাম উন্নয়ন নীতিমালা ও পরিকল্পনা এবং এগুলো বাস্তবায়নে যদি উপর্যুক্ত বিষযগুলো বিবেচনায় রাখা হয় তাহলেই আমার গ্রাম শুধু আমার শহরই হবেনা। আমার গ্রাম হবে বসবাসের এক আদর্শ স্থান।